Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জীবনযাপনের প্রয়োজনে বৃদ্ধি পাচ্ছে ভার্চুয়াল

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ৬ জুলাই, ২০২০, ১২:০১ এএম

করোনা মহামারী পরবর্তী বিশ্বের চেহারা কি হবে? কি হাল হবে অর্থনীতির? এ নিয়ে দেশে দেশে ভাবনা-গবেষণা চলছে। সকলেই আশা করছে, মহামারি একদিন ঠিকই নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। তার আগ পর্যন্ত বিশ্ব অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে, তা আরও বাড়বে। এ ক্ষতি পোষাতে বহু বছর লেগে যেতে পারে। সে সময় পর্যন্ত দেখা যাবে, এক নতুন নতুন বিশ্ব। যার আলামত এরইমধ্যে স্পষ্ট। জীবনহানির সঙ্গে জীবিকার দুর্বিপাক মোকাবেলায় দেশে-দেশে মানুষ তথ্যপ্রযুক্তিতে ভর করেছে। বাধ্য হয়েই তাদের এই নির্ভরতা। কেনাকাটা, চিকিৎসা, পড়াশোনা, অফিস-ব্যবসা সব কিছুতে ভার্চুয়ালনির্ভরতা এখন মানুষের নিত্যসঙ্গী। তা গড়িয়েছে রাজনীতি থেকে আদালত পর্যন্ত। ধারণা করা হচ্ছে, মহামারির এ সময়ের তথ্যপ্রযুক্তির শটকাট পদক্ষেপ জনজীবনে পাকাপাকি হয়ে যেতে পারে। স্থায়ী ব্যবস্থায় রূপ লাভ করতে পারে। সামনের দিনগুলোতে সামাজিকতা এবং বিশ্ব অর্থনীতির কী দশা হবে, তার শঙ্কাজনক পূর্বাভাস এরইমধ্যে দেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, ১৯৩০ এর দশকের বিশ্বমন্দার পর এরকম খারাপ অবস্থায় আর বিশ্বঅর্থনীতি পড়েনি। আইএমএফ এর মতে, এবছর বিশ্বঅর্থনীতি সংকুচিত হবে তিন শতাংশ। মহামারি দীর্ঘায়িত হলে বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন দেশের সরকার আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে অগ্নিপরীক্ষার মুখে পড়বে। আর ধনী দেশগুলোর অর্থনীতি ২০২২ সালের আগে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে না।

মানুষের আচরণে মানবিক পরিবর্তণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মানুষে-মানুষে সংস্পর্শ কমে গেছে। অন্যের সংস্পর্শে আসার ক্ষেত্রে মানুষের মনে ভর করা ভয় কবে কখন কাটবে, কেউ বলতে পারে না। আর মানুষের এই আচরণের কারণে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর নতুন ধরণের সেবা, শিল্প, বিজ্ঞান থেকে শুরু করে অনেক কিছু গড়ে উঠবে। কম্পিউটার বিজ্ঞান আর সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের এ প্রাধান্য আরো বাড়বে। সময়ের প্রয়োজনেই নতুন পদ্ধতি ও ব্যবস্থার উদ্ভব হয়। করোনায় প্রথম আক্রান্ত চীনে ইতোমধ্যে অনলাইননির্ভরতা শুরু হয়ে গেছে। অন্যান্য ব্যবসার তুলনায় চীনে অনলাইন ব্যবসা বাড়ছে দ্রুত গতিতে। বিশেষ করে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটিতে এই বছরের শুরুতে কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণের পর অনলাইনে দেশটির ব্যবসার প্রবৃদ্ধি আকাশ ছুঁয়েছে। এর কারণ, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর তা যাতে ছড়িতে পড়তে না পারে, তা নিশ্চিত করতে দেশটির সরকার সাধারণ মানুষের চলাফেরার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় অনলাইন ব্যবসা দ্রুত প্রসার লাভ করে। সাধারণ মানুষ তাদের নিত্যদিনের কেনাকাটার জন্য অনলাইনের দিকে ঝুঁকেছে। চীনের অভিভাবকরা সন্তানদের পড়াশুনার জন্য বিরাট একটা অংশ অনলাইনে ব্যয় করেন এবং সেখানে অনলাইন শিক্ষার প্রিমিয়ার সার্ভিস হিসেবে ভিআইপিকিডসের মতো ইংরেজি শিক্ষার সার্ভিস জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দেশটির পুরো জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা অনলাইন কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। চীনের বিনোদন ব্যবসাও অনলাইন ভিত্তিক হয়ে গেছে। দেশটির নববর্ষের আগ মুহূর্তে সিনেমা হলগুলোর পাশাপাশি সিনেমার মুক্তি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে চীনের নতুন বছরের সিনেমা লস্ট ইন রাশিয়া এবং এন্টার দ্য ফ্যাট ড্রাগন এখন অনলাইনেই স্ট্রিমিং করে দেখছেন দেশটির নাগরিকরা। এই সময়টাতে অনলাইন ভিডিও প্ল্যাটফর্ম বিশেষ করে বাইডুর ইকি কিংবা টেনসেন্ট ভিডিওর জনপ্রিয়তা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় অনলাইন গেমস এবং টিকটকের মতো ভিডিও অ্যাপগুলোও বেশ উপকারী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ভাইরাসের হানায় জিম কিংবা খেলাধুলা করে সময় কাটানোর সুযোগ না থাকায় লোকজন এগুলোর বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করছেন। কীভাবে বাসায় বসেই জিম করবেন এমন তথ্যদানকারী অ্যাপ কিংবা লাইভ ক্লাসে যোগদান করে ঘরে বসেই জিম বা ইওগা ব্যায়াম করার মতো বিষয়গুলোর প্রতি ঝুঁকছে মানুষ। ভার্চুয়ালের এ জয়জয়কারে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। ক্ষেত্র বিশেষে কারো কারো চেয়ে এগিয়ে। বদলে গেছে শহুরে লাইফস্টাইল। অনলাইনে ঘর থেকেই চলছে অফিস, বাচ্চাদের স্কুলের ক্লাস। নতুন এই জীবনে মানুষের মৌলিক চাহিদার মতো প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে একটি মোবাইল সেট আর উচ্চ গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সংযোগ। সীমিত চলাচলের এই সময়ে জীবনকে গতিশীল রেখেছে প্রযুক্তির স্পর্শ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অনলাইনের মাধ্যমে সারাদেশে মিটিং করছেন। ব্রিফিং, সংবাদ সম্মেলন সবকিছুই চলে এসেছে অনলাইনে। শুধু তাই নয়, গানের অনুষ্ঠান, বিশেষজ্ঞদের বাজেট ভাবনাসহ সব কিছু আলোচনা হচ্ছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। এমনকি টেলিভিশনের টকশোগুলোতে সবাই অংশ নিচ্ছেন যার যার ঘরে বসেই। হাটবাজারও চলে আসছে ঘরে। করোনা আক্রান্তরা হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে চিকিৎসকদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক টেলিফোনে যোগাযোগ রেখেছেন। অনেকে অনলাইন চিকিৎসা নিচ্ছেন। সময়ের প্রয়োজনেই বদলে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা প্রচলিত ব্যবস্থা ও মানুষের আচরণ। বদলে যাচ্ছে, অফিস-আদালতেরও স্বাভাবিক নিয়মকানুন। মূলত সময় এবং জীবনযাপনের কারণেই সবকিছু বদলে যাচ্ছে। সশারীরে কাছে যাওয়ার সুযোগ না থাকায় ডিজিটাল প্ল্যাটফরমই এখন মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। সবাইকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।

করোনার কারণে দেশের রাজনীতির প্যাটার্নও বদলে গেছে। রাজপথের রাজনীতি ও রাজনৈতিক কর্মসূচিভিত্তিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এ নিয়ে ক্ষমতাসীন জোটের শরিক দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা বিবৃতি দিয়ে লকডাউন সীমিত করার সমালোচনা করেছেন। ইতোমধ্যে কয়েকটি দল কারফিউ ঘোষণারও দাবী করেছে। যদিও ক্ষমতাসীন দলের কেউ কেউ লকডাউন শিথিল করার পক্ষে গণমাধ্যমে যুক্তি তুলে ধরেছেন, আবার কোনও কোনও গুরুত্বপূর্ণ নেতা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কায় তা না করতে বলেছেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সমালোচনা করার ক্ষেত্রেও তথ্যপ্রযুক্তি এখন ব্যবহার করা হচ্ছে। ভার্চুয়ালে প্রচারিত তথ্য সত্য না মিথ্যা, তা প্রমাণের সুযোগ খুব কম থাকছে। এর আগেই তা সত্য বা অসত্য হিসেবে প্রচার-প্রসারের উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যাচ্ছে। একটি ইস্যুর বাদ-প্রতিবাদের মধ্যেই আরেকটি ইস্যু হাজির হয়ে যাচ্ছে। ভার্চুয়াল জগতের এ ক্যারিশমায় অনেকে উদ্ভুদ্ধ হয়ে উঠেছে। কখনো কখনো পক্ষ-বিপক্ষের প্রতিযোগিতা যেমন একতরফা হয়ে যাচ্ছে, তেমনি মনগড়ায়ও পরিণত হচ্ছে। প্রতিপক্ষকে গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করছে না। এ প্রতিযোগিতায় কখনো কখনো মূল বিষয় প্রাধান্য পায়, কখনো কখনো তা আড়ালে ঢাকা পড়ে। কখনো আধা সত্যকে পুরো সত্য করার চেষ্টা, কখনো সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রন থাকে। আবার কখনো আজগুবি-অবান্তর বিষয় নিয়েও তোলপাড় শুরু হয়। যে যেদিক দিয়ে পারছে নানা তথ্য, জরিপ, গবেষণা রিপোর্ট, ছবি ছড়িয়ে দিচ্ছে। কখনো বিদেশি কোনো প্রচারমাধ্যম বা সংস্থার বরাত দিয়ে তথ্যবিভ্রাট সৃষ্টি করছে। এ থেকে অর্থনীতি ও রাজনীতি বাদ যাচ্ছে না। আবার অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় ও অনাকাক্সিক্ষত বিষয় নিয়েও ট্রল হয়। দেশের অর্থনীতি, শিল্প, পরিবেশ নিয়ে জরিপের কোনো শেষ নেই। রাজধানী ঢাকার সৌন্দর্য্য, বাসযোগ্যতা নিয়েও একেবারে সাংঘর্ষিক তথ্যসমৃদ্ধ জরিপ নজরে পড়ছে। ভার্চুয়াল জগতে পরস্পরকে ঘায়েল করার এ প্রতিযোগিতায় যেন সবাই বিজয়ী, এমন প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। ভার্চুয়ালে নানা জরিপে সরকারের আকাশ ছোঁয়া সাফল্যের প্রচারণার পাশাপাশি বিপরীত চিত্রও দেখা যায়। সরকারের কারণে যেন দেশের মহাসর্বনাশে মানুষ মাথায় হাত দিয়ে ফেলছে। বিভিন্ন দলকে জেতানো-হারানোর ভার্চুয়াল এ প্রতিযোগিতায় মানুষের আগ্রহও কম নয়। একে পুঁজি করে জরিপ করা ও প্রচারকারী সংস্থাগুলোর কদর বাড়ছে। জরিপ মন মতো হলে একপক্ষ বেজায় খুশি। ধুমছে প্রচার শুরু করে। তখন পাল্টা জবাব দেয়া যেন প্রতিপক্ষের দায়িত্ব হয়ে পড়ে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভার্চুয়াল নির্ভরতা মানুষের মানসিক মনোযোগ, সময় ও স্মৃতি ক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দিচ্ছে। স্মার্টফোনসহ ভার্চুয়াল ব্যস্ততার নেতিবাচক দিকগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অগ্রাহ্য হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিখ্যাত লেখক যাযাবারের বিখ্যাত সেই মন্তব্য বেশ প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন, আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ। কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ। তাতে আছে গতির আনন্দ, নেই যতির আয়েস।› সেই আবেগ হলো কাগজের চিঠি, মনোযোগ, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা, কাজের প্রোডাকটিভিটি, মেধার বিকাশ হওয়ার ক্ষমতা, ভালো স্মৃতিশক্তি, রাতের ঘুম, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, সামনে বসে গল্প করার আনন্দসহ অনেক কিছু। শিশুদের বিকাশে এর নেতিবাচক প্রভাব বাদে কেবল বড়দের জীবনে এই নেশা মাদকের চেয়ে কম ক্ষতিকারক নয়। এরপরও প্রয়োজন ও বাস্তবতার নিরিখে প্রযুক্তিকে অস্বীকার কারার উপায় নেই।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভার্চুয়াল


আরও
আরও পড়ুন