Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভার্চুয়াল আদালতের বাস্তবতা সফলতা ও গুরুত্ব

ড. মো. রেজাউল করিম | প্রকাশের সময় : ২ জুলাই, ২০২১, ১২:০৬ এএম

‘ভার্চুয়াল আদালত’ বর্তমানে বিচার অঙ্গনে ব্যাপক পরিচিত দু’টি শব্দ। সাধারণের মধ্যেও এ শব্দ যুগল এখন কম পরিচিত নয়। বাংলাদেশে ‘ভার্চুয়াল আদালত’ শব্দ দু’টির উৎপত্তির মূলে রয়েছে আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০ (যা ৭ জুলাই ২০২০ তারিখে জাতীয় সংসদে আইন হিসেবে পাস হয়)। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে যখন চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে করোনাভাইরাসজনিত রোগ কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ দেখা দেয় এবং তা দ্রæত বিভিন্ন দেশে বিস্তার লাভ করতে থাকে তখন বিশ্বব্যাপী নানান উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা বাড়তে থাকে। এ রোগ সম্পর্কে সঠিক তথ্য না থাকা, গুজব, কোন ওষুধ বা টিকা না থাকা সব মিলিয়ে বিশ্ববাসী দিশেহারা হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী মানুষের শুধু করণীয় ছিল বার বার সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়া/হ্যান্ড স্যানিটাইজড করা, মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশ সরকারও তখন করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে থাকে। তা সত্তে¡ও ২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম তিনজন করোনা রোগী সনাক্ত হয় এবং জ্যামিতিক হারে এ রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৮ মার্চ এ রোগে বাংলাদেশে একজনের মৃত্যুর পর জরুরি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ব্যতিত সকল অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা, শিল্প প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটিসহ দেশে লকডাউন ঘোষণা করতে বাধ্য হয় সরকার। সাধারণ ছুটির মধ্যে সারাদেশেই জরুরি সেবা, পণ্য পরিবহণ, চিকিৎসা ইত্যাদি অতিপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলো ছাড়া গণপরিবহণ চলাচলও বন্ধ করা হয়। তাতেও করোনা পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকায় সরকার দফায় দফায় সাধারণ ছুটি ও লকডাউনের মেয়াদ বাড়াতে থাকে। এতে দীর্ঘদিন আদালতের বিচারকাজ বন্ধ থাকায় বিচারপ্রার্থী জনগণ যেমন ভোগান্তিতে পড়তে থাকেন, তেমনি আইন পেশার উপর নির্ভরশীল সীমিত আয়ের ব্যক্তিগণ চরম আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হন। এ ছাড়া কারাগারগুলোতে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত হাজতি (কারাবন্দী) থাকায় এবং তাঁদের মধ্যে নির্দিষ্ট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব না হওয়ায় সরকারকে বাড়তি চিন্তায় পড়তে হয়।

এমনি এক বৈরী পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী ভার্চুয়াল আদালত পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তখন বাংলাদেশে ভার্চুয়াল আদালত পরিচালনার ব্যাপারে কোন আইনি বিধান না থাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সম্পর্কিত অধ্যাদেশ প্রণয়নে উদ্যোগী হন এবং অধ্যাদেশের খসড়া প্রণয়নের জন্য আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হককে নির্দেশ দেন। আইনমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রণালয়ের উভয় বিভাগের সচিবকে নিয়ে দ্রæততম সময়ের মধ্যে ভার্চুয়াল আদালত পরিচালনা সম্পর্কিত ‘আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০’-এর খসড়া প্রণয়ন করে দেন। এ অধ্যাদেশের খসড়া ৭ মে মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হয় এবং ওইদিনই তা মন্ত্রিসভার অনুমোদন লাভ করে। এরপর ৯ মে রাষ্ট্রপতি তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করলে উক্ত অধ্যাদেশের পাঁচ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতা বলে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সীমিত পরিসরে ভার্চুয়াল আদালত পরিচালনার লক্ষ্যে ১০ মে বিশেষ প্রাকটিস নির্দেশনা জারি করেন। এদিকে অধ্যাদেশ জারির আগ থেকেই এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) প্রোগ্রাম ভার্চুয়াল আদালত পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও অ্যাপস্ প্রস্তুতকরণসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করে। ফলে ১১ মে থেকেই বাংলাদেশে নতুন ধারার এ আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়। এরপরও থেমে থাকেনি এটুআই। বিচার বিভাগের ডিজিটাল যাত্রাকে সফল করে তোলার জন্য নিরন্তর কাজ করতে থাকে। এটুআই মুক্তপাঠ-ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ‘আমার আদালত: ভার্চুয়াল কোর্ট’ এর ব্যবহার বিধির উপর স্বল্পতম সময়ে বিচার ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট ১০ হাজার ২১৩ জনকে অনলাইনে প্রশিক্ষণ প্রদান করে।

ফলে গত ১ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভার্চুয়াল আদালতের মাধ্যমে লাখো মানুষ স্বল্প ব্যয়ে, সহজে ও দ্রæত ন্যায়বিচার পেয়েছেন। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের তথ্য অনুযায়ী, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর প্রথম দফায় ২০২০ সালের ১১ মে থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত মোট ৫৮ কার্যদিবসে সারাদেশের অধঃস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালে ভার্চুয়াল শুনানির মাধ্যমে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৯টি জামিন আবেদন নিষ্পত্তি হয়। এর মধ্যে ৭২ হাজার ২২৯ জন ব্যক্তি জামিন আদেশ প্রাপ্ত হয়ে কারামুক্ত হয়েছেন। আর দ্বিতীয় দফায় ২০২১ সালের ১২ এপ্রিল হতে ৯ মে পর্যন্ত মোট ১৯ কার্যদিবসে সারাদেশের অধঃস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালে ভার্চুয়াল শুনানির মাধ্যমে ৬৩ হাজার ১০৯টি জামিন আবেদন নিষ্পত্তি হয়। এর মধ্যে ৩৩ হাজার ৮৫০ জন ব্যক্তি জামিন আদেশ প্রাপ্ত হয়ে কারামুক্ত হয়েছেন। অর্থাৎ ২০২০ সালের ১১ মে থেকে ২০২১ সালের ৯ মে পর্যন্ত দুই দফায় দেশের অধঃস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালে ভার্চুয়াল শুনানির মাধ্যমে ২ লাখ ১০ হাজার ৪৪৮টি জামিন আবেদন নিষ্পত্তির মাধ্যমে ১ লাখ ৬ হজার ৭৯ জন ব্যক্তি জামিন আদেশ প্রাপ্ত হয়ে কারামুক্ত হয়েছেন। এছাড়া ভার্চুয়াল মাধ্যমে চলা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ, চেম্বার আদালত ও হাইকোর্ট বিভাগে বিপুল সংখ্যক জরুরি মামলার শুনানি, আদেশ ও রায় হয়েছে।

উপরিউক্ত তথ্য ও পরিসংখ্যান অবশ্যই ভার্চুয়াল আদালতের সফলতার কথা বলে। এ সফলতা অর্জনের মাধ্যমে একদিকে বিচার বিভাগের দক্ষতা ও সক্ষমতা প্রমাণিত হয়েছে। অন্যদিকে ভার্চুয়াল আদালত পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশাল অভিজ্ঞতাও অর্জিত হয়েছে। যেহেতু এ অভিজ্ঞতা অর্জনের ক্ষেত্র ব্যাপক ও বিস্তৃত এবং সরাসরি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ অভিজ্ঞতা অর্জন করা হয়েছে তাই এর গুরুত্ব অনেক বেশি। এটা বাস্তব অভিজ্ঞতা। এ অভিজ্ঞতার আলোকে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে তা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গোটা বিচার বিভাগকে ডিজিটাইজেশনের জন্য আইন মন্ত্রণালয় যে ই-জুডিসিয়ারি প্রকল্প হাতে নিচ্ছে তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এ অভিজ্ঞতা বড়ো প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে। সুতরাং বাংলাদেশে ভার্চুয়াল আদালত প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটুআই প্রোগ্রামের অবদান অনস্বীকার্য। আর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পথে ভার্চুয়াল আদালত যে বড়ো একটা ভূমিকা রেখে চলেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন