পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
চরম সংকটে নিপতিত ভারত। করোনা মহামারি, অর্থনৈতিক চরম মন্দা, পঙ্গপালের হানা, আমফানের আঘাত ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে যুদ্ধাভাব ইত্যাদি কারণে সংকটে পতিত দেশটি। করোনা সংক্রমণে বিশ্বের অন্যতম ভারত। আক্রান্তের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে ভারতে। তাই করোনা সহসাই বিদায় না নিলে মৃত্যু ও আক্রান্তের দিক দিয়ে ভারত হতে পারে প্রথম। বর্তমানে শীর্ষ দেশগুলোর অনেকটির সংক্রমণ কমছে আর ভারতে বাড়ছে। দেশটির নিমহ্যান্স’র চিকিৎসকদের অভিমত, ‘২০২০ সাল শেষে ৬৭ কোটি ভারতীয় করোনায় আক্রান্ত হবে।’ অন্যদিকে, দেশব্যাপী দীর্ঘ লকডাউন ও বৈশ্বিক মহামন্দার কারণে দেশটির অর্থনীতি ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। গত ২৮ মে এনডিটিভিতে প্রকাশ, ‘বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি বছর ভারতের প্রায় ১.২০ কোটি নাগরিক চরম দারিদ্র্যের মুখে পড়বে। তাদের দৈনিক আয় হবে ১.০৯ মার্কিন ডলারের কম। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনোমি’র তথ্য অনুযায়ী, শুধু এপ্রিলেই চাকরি হারিয়েছে প্রায় ১২.২০ কোটি ভারতীয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিম্ন শ্রেণির মানুষ। আইপিই গ্লােবালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অশ্বজিত বলেন, ‘দারিদ্র্য দূরীকরণে ভারতীয় সরকারের কয়েক বছরের প্রচেষ্টা মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। এবছর কর্মসংস্থান পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। করোনার চেয়ে ক্ষুধায় আরও বেশি মানুষের মৃত্যু হতে পারে। বর্তমানে ভারতের ৮১.২০ কোটি বা ৬০% মানুষ দারিদ্র্যে বসবাস করছে। করোনার কারণে এটা বেড়ে হবে ৯২ কোটি বা ৬৮%। লকডাউনে ভারতের ৮০% পরিবারের আয় কমেছে। কোনো সহায়তা ছাড়া তাদের অনেকের পক্ষেই আর বেশি দিন জীবিকা নির্বাহ করা সম্ভব নয়।’ করোনা দীর্ঘস্থায়ী হলে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা হবে আরও করুণ। মুডিজ’র আশঙ্কা: ‘চার দশকের মধ্যে এই প্রথম ভারতের অর্থনীতি শূন্যের তলায় চলে যাবে।’
এদিকে, মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে প্রবাসী আয়। আইওএম প্রতিবেদন-২০১৯ মতে, ‘২০১৮ সালে ভারতের প্রবাসীরা ৭,৮৬১ কোটি ডলার পাঠিয়েছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। আর চীনের প্রবাসীরা পাঠিয়েছে ৬,৭৪১ কোটি ডলার, যা দ্বিতীয়।’ করোনার কারণে ভারতের লাখ লাখ প্রবাসীর উপার্জন চরম ঝুঁকিতে পড়েছে বিভিন্ন দেশে। শুধুমাত্র কুয়েতেই চরম ঝুঁকিতে পড়েছে প্রায় ৯ লাখ ভারতীয়। এরূপ অবস্থা কম-বেশি মধ্যপ্রাচ্যসহ সারাবিশ্বেই। গত মে মাসে ৩ লাখ প্রবাসী ফেরত এসেছে। মোট প্রবাসীদের যদি অর্ধেকও ফেরত আসে, তাহলে দেশটির বেকারত্ব ও আর্থিক সংকট আরও বাড়বে।
অন্যদিকে, ফসল ধ্বংসকারী পঙ্গপাল ব্যাপকভাবে হানা দিয়েছে ভারতে। পঙ্গপাল মারতে এবার জলকামান ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বর্তমানে এই পঙ্গপালের দখলে রয়েছে রাজস্থানের ২০টি, মধ্যপ্রদেশের ৯টি, গুজরাটের দু’টি ও পাঞ্জাবের একটি জেলা। পঙ্গপাল মারতে রাজস্থানে ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে। পঙ্গপাল ইতোমধ্যেই প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি ধ্বংস করেছে। তাই চির শত্রু পাকিস্তানের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে দু’দেশ একত্রে পঙ্গপাল মোকাবেলার জন্য। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ৪ কোটি পঙ্গপালের ঝাঁক এত শস্য সাবাড় করতে পারে, যা দিয়ে ৩৫ হাজার মানুষের খাবার জোগানো সম্ভব। এছাড়া, এ বছর কয়েকটি রাজ্যে চরম খরায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করায় চরম ক্ষিপ্ত কাশ্মিরীরা। তাদের দমনে প্রায় এক লাখ সেনা মোতায়েন করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। রাজ্যটির সবকিছুই এখন বন্ধ। তবুও রাজ্যটি স্থিতিশীল হয়নি। এক এটিকে কেন্দ্র করে চরম ক্ষিপ্ত হয়েছে পাকিস্তান। তেমনি সারা বিশ্বের মুসলমানরাও। এই ক্ষোভ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে ভারতের মুসলমানদের নাগরিকহীন ও বিতাড়ন করার প্রক্রিয়ায়। এসব নিয়ে ওআইসি ও জাতিসংঘও নিন্দা জানিয়েছে। তবুও ভারতে ইসলামবিদ্বেষ বন্ধ হয়নি। বরং বেড়েছে। যেমন: করোনা চিকিৎসায় ধর্মীয় বিভাজন করা হচ্ছে! উপরন্তু কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলকে কেন্দ্র করে পাক-ভারতের মধ্যে নতুন করে যুদ্ধাভাব সৃষ্টি হয়েছে। এক নাগাড়ে দেখা দিয়েছে সীমান্তে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ। এই অবস্থায় শুরু হয়েছে চীনের সাথে যুদ্ধাভাব। গত ৫ মে চীন ও ভারতের সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ হওয়ার পর থেকে পূর্ব লাদাখে উত্তেজনা বিরাজ করছে। দুই দেশের কমান্ডাররা আলোচনা করে বিষয়টি মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও উত্তেজনা কমেনি। ডয়চে ভেলের খবরে প্রকাশ, ‘সম্প্রতি পূর্ব লাদাখ ও সিকিমে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় চীনের সেনার সঙ্গে ভারতীয় সেনার হাতাহাতি হয়েছিল। তারপর চীন পূর্ব লাদাখে জল ও বায়ুসীমা লঙ্ঘন করে বলে ভারত অভিযোগ করেছে। উপগ্রহ থেকে নেওয়া ছবিতে দেখা যায়, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে সেনা ঘাঁটিতে চীন সম্প্রতি প্রচুর নির্মাণকাজ করেছে। সেখানে চারটি ফাইটার জেট নিয়ে আসা হয়েছে। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখাতেও দুই দেশ সেনার সংখ্যা বাড়িয়েছে। যুদ্ধাস্ত্রও মোতায়েন করেছে। চীনের প্রেসিডেন্ট যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য দেশের সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন। উত্তেজনা প্রবল হওয়ার পর অবশ্য প্রথমে বিদেশমন্ত্রক ও পরে ভারতে চীনের রাষ্ট্রদূত সুন ওয়েডং সুর অনেকটাই নরম করেছেন। ওয়েডং বলেছেন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে প্রভাব পড়ে এমন কোনো কাজ করা হবে না।’ ভারতীয় মিডিয়া জানিয়েছে, ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার কাছে চীন অন্যান্য বারের তুলনায় এবার আলাদা প্রস্তুতি নিয়েছে। লাদাখের কাছে চীন বিমানবন্দর সম্প্রসারণের কাজ চালাচ্ছে। কয়েকটি যুদ্ধবিমানও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্যাংগং সো ও গালওয়ান উপত্যকায় বাড়তি দুই থেকে আড়াই হাজার সেনা মোতায়েন করেছে চীন। তৎপ্রেক্ষিতে ভারতও সীমান্তে সেনা উপস্থিতি বাড়িয়েছে। চীনের চেয়ে ভারতের সেনা উপস্থিতি বেশি।’ এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী মোদির মন ভালো নেই বলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানিয়েছেন গত ২৮ মে। এর আগের দিন তিনি চীন ও ভারতের দ্ব›দ্ব মেটাতে মধ্যস্থতা করতে চান বলে জানিয়েছিলেন। এর আগে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের কাশ্মির নিয়ে বিরোধের সময়ও তা মিটিয়ে দিতে স্বেচ্ছায় মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ট্রাম্প। তা প্রত্যাখ্যান করেছিল ভারত। এবারের প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেছে চীন ও ভারত। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, ‘চীন এবং ভারত আলোচনা ও পরামর্শের মাধ্যমে বিষয়গুলির যথাযথভাবে সমাধান করতে সক্ষম। আমরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আমাদের মধ্যে হওয়া সমস্যাগুলোর যথাযথভাবে সমাধান করতে সক্ষম। এ বিষয়ে আমাদের তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের কোনও দরকার নেই’। আর ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, ‘কূটনৈতিক স্তরে দিল্লি ও বেইজিং আলোচনা চালাচ্ছে। পাশাপাশি সামরিক স্তরে উত্তেজনা কমাতে আলোচনা করছে দুই দেশের বাহিনী। সীমান্তে শান্তি ও স্থিতি বজায় রাখতে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ভারত ও চীন। দুই দেশের মধ্যে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু সেই পার্থক্যের ছায়া যাতে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে না পড়ে, পারস্পরিক বোঝাপড়া যাতে নষ্ট না হয়, সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে। আমরা আশাবাদী, আলোচনার মাধ্যমে এই মতপার্থক্য মিটিয়ে ফেলা সম্ভব হবে।’
স্মরণীয় যে, ভারত ও চীনের মধ্যে বৈরিতা চলছে স্বাধীনতাত্তোরকাল থেকেই, যা সম্প্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর প্রধান কারণ যৌথ সীমান্ত ও আধিপত্য। ভারত ও চীনের মধ্যে প্রায় ৩.৫ হাজার কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। যা লাদাখ থেকে আসাম পর্যন্ত। এর মধ্যে এক চিলতে করে নেপাল, সিকিম ও ভুটান আছে। আকসাই চীন অঞ্চলের ১৫ হাজার বর্গমাইল এলাকাকে ভারত তাদের এলাকা বলে দাবি করে। অন্যদিকে ভারতের অরুণাচলকে চীন তার এলাকা বলে মনে করে। ১৯৬২ সালে সীমান্ত নিয়ে দুদেশের মধ্যে যুদ্ধ হয়। তাতে ভারত পরাজিত হয়। চীন বিশাল অংশ দখল করে নেয় ভারতের। তখন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রি হার্টফেল করে মারা যান। এটা পরাজয়ের কারণেই হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। সর্বোপরি ২০১৭ সালে ভুটানের সীমান্তে দোকলাম এলাকায় চীনের রাস্তা তৈরি নিয়ে চীন ও ভারতের সৈন্যরা ৭২ দিন মুখোমুখি ছিল। এই অবস্থায় চীনের চরম হুমকির প্রেক্ষিতে ভারত দোকলাম থেকে সৈন্য সরিয়ে নিলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। স্মরণীয় যে, কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে কেন্দ্রের শাসন প্রতিষ্ঠা করার সময় আকসাইকে কাশ্মিরের অন্তর্ভুক্ত করেছে ভারত। চীন এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। এমনকি বিষয়টি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও নিয়ে গেছে চীন। বরফ সম্বলিত এই অঞ্চলটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৪ হাজার ফুট উঁচুতে। ভারতের সাথে চীনের বিরোধ শুধু সীমান্ত নিয়েই নয়। এক পথ এক অঞ্চল ও এশিয়ান অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক নিয়েও বিরোধ রয়েছে। চীনের অত্যন্ত সাড়া জাগানো এই দুই কার্যক্রমের ঘোর বিরোধী ভারত। উপরন্তু তিব্বতের ধর্মগুরু দালাই লামা ভারতে আশ্রয় নেয়া নিয়েও দু’দেশের বিরোধ রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের সাথে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ, দেশটির একক পরাশক্তিত্বে পথের কাটা হয়ে উঠছে চীন। বিশেষ করে এশিয়ায়। তাই চীনকে দমন করার জন্য এশিয়ায় ইসরাইল ও ভারতকে সঙ্গী করেছে আমেরিকা। দেশটি ইসরাইলকে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে এবং ভারতকে দিয়ে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়াকে কাবু করার চেষ্টা করছে। এ ব্যাপারে কুয়ালালামপুরস্থ মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব চায়নার অধ্যাপক সৈয়দ মাহমুদ আলীর অভিমত হচ্ছে: ‘চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রতিপত্তিকে বাগে আনার চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র গত এক দশকে যে একটি ‘অক্ষশক্তি’ তৈরি করেছে, ভারত তার অগ্রভাগে। আমেরিকা মনে করে, চীনকে শায়েস্তা করার ক্ষেত্রে যে দেশটি তাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারে সেটি হলো ভারত। এজন্য গত দশ বছরের তারা ভারতের কাছে ২০০ কোটি ডলারের মতো অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র বিক্রি করেছে।’ আর ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য দেভাশ দ্য উইককে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চীন বিরোধী জোটে ভারত শামিল হোক তা বেইজিং চায় না।’
ভারতের সংকটের আরও কারণ হচ্ছে, দাদাগিরি, যা নতুন নয়; স্বাধীনতাত্তোরকাল থেকেই চলছে। তাই পার্শ্ববর্তী প্রায় সব দেশের সাথে সম্পর্ক খারাপ। তবুও ভারত দাদাগিরি ত্যাগ করেনি। গত ৩ এপ্রিল ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রেস নোটে বলা হয়, ‘প্রতিবেশী দেশগুলোকে সহযোগিতা করতে নৌবাহিনীর ৬টি জাহাজকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও আফগানিস্তানে মোতায়েন করার জন্য ৫টি মেডিকেল টিম স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে।’ কিন্তু সাথে সাথে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কা করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় সামরিক সহায়তা গ্রহণ না করার কথা ঘোষণা করে। তৎপ্রেক্ষিতে ভারত তার অবস্থান পরিবর্তন করে বলেছে, ‘যদি অনুরোধ আসে’ শুধু তখনই ভারতীয় সেনাবাহিনীর র্যাপিড রেসপন্স মেডিকেল টিম মোতায়েন করা হবে। এর প্রেক্ষিতে গত ২৮ মে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, ভারতে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার শান্তিতে হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। ভারতের ‘আগ্রাসী’ ও ‘সম্প্রসারণবাদী’ নীতির কারণে শুধু ইসলামাবাদ নয়, এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশও দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
ভারতের দাদাগিরিতে চরম অতিষ্ঠ হয়ে নেপালও যুদ্ধের হুমকি দিয়েছে সম্প্রতি। অথচ নেপাল সবকিছুতেই ভারতনির্ভর ছিল। সে সুযোগ দেশটির সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতো ভারত। কিন্তু রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে গণতন্ত্র প্রবর্তনের পর থেকে সেই নেপাল বিগড়ে গেছে। কারণ, নেপালের নতুন সংবিধান পরিবর্তন করতে বাধ্য করতে অবরোধ আরোপ করেছিল ভারত। এতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশটি। উপরন্তু সংবিধান পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। প্রতিশোধ স্বরূপ দেশটি চীনমুখী হয়েছে। আর এখন তো যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে। এ জন্য ভারতের সেনাপ্রধান তৃতীয় পক্ষকে দায়ী করেছেন। এই নতুন বিবাদের সূত্রপাত নেপালের নতুন ম্যাপ, যাতে কালাপানি, লিপুলেখ ও লিমপিয়াধুরার ৩৩৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা নেপালের অংশ বলে দেখানো হয়েছে। কালাপানি নিয়ে ভারত ও নেপালের দ্ব›দ্ব প্রাচীন। ১৮১৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে নেপালের রাজার সুগাউলির চুক্তি হয়েছিল যে, ‘মহাকালী নদীর পূর্বাংশ নেপালের, পশ্চিমাংশ ভারতের।’ তবুও এ নিয়ে বিরোধ ছিলই। কালাপানির যে অংশের দাবিদার ভারত, গুরুত্বপূর্ণ লিপুলেখ গিরিপথের অবস্থান সেখানেই। এই গিরিপথই কৈলাস-মানস সরোবরের যাত্রাপথ। ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের এই দুর্গম পথ সুগম করতে লিপুলেখ পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা তৈরি করেছে ভারত, যা নেপাল মেনে নেয়নি। তাদের কাছে এটা নেপালের ‘সার্বভৌমত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ’। তাই এ নিয়ে নেপালজুড়ে দেখা দেয় ভারতবিরোধী প্রচন্ড বিক্ষোভ। সংসদেও সৃষ্টি হয় চরম উত্তেজনা। তাই নতুন ম্যাপটি প্রকাশ করে সরকার। এর প্রেক্ষিতে ভারতীয় সেনাপ্রধান বলেন, ‘ভারত ও নেপালের মধ্যে গোলমাল বাধানোর চেষ্টা করছে অন্য এক শক্তি।’ পরোক্ষভাবে তিনি চীনের দিকেই আঙুল তুলছেন। নেপালের উপ-মুখ্যমন্ত্রী পোখরেল ‘দ্য রাইসিং নেপাল’ পত্রিকাকে বলেন, ‘ভারতীয় সেনাপ্রধান নারাভানে নেপালের গোর্খাদের ভাবাবেগে আঘাত হেনেছেন। ভারতের জন্য বহু বলিদান দিয়েছেন গোর্খারা। কিন্তু তৃতীয় কোনও শক্তির প্ররোচনায় আমরা কালাপানি সীমান্তে বিবাদ করছি বলে যে অভিযোগ করেছেন তিনি, তা নিন্দনীয়। প্রয়োজনে নেপালি সেনারা যুদ্ধ করবে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোর্খা সৈন্যরা স্বজাতির কাছে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবেন না। ব্রিটিশ আমল থেকেই ভারতীয় সেনাবাহিনীতে সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে আসছেন গোর্খা সৈন্যরা। বর্তমানে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে প্রায় ৪০টি গোর্খা ব্যাটালিয়ন রয়েছে।’ এই অবস্থায় নেপাল ও পাকিস্তান সীমান্তেও ভারত অতিরিক্ত সেনা প্রেরণ করেছে। অপরদিকে, নেপালের সংসদের নিম্নকক্ষ ‘হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস’-এ ‘ম্যাপ আপডেট বিল’ পেশ করা হয়েছে গত ৩১ মে। এতে ভারত-নেপাল সীমান্তের লিমপিয়াধুরা, কালাপানি ও লিপুলেখকে নেপালের অংশ হিসাবে দেখানো হয়েছে। উপরন্তু সেখানে সেনা মোতায়েনের এবং নেপালে প্রবেশের জন্য উন্মুক্ত সীমান্ত বন্ধ করে নির্দিষ্ট সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রবেশ পথ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নেপাল সরকার। কিন্তু ভারতের দাবি, এই তিনটি অংশই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং উত্তরাখন্ড রাজ্যের পিথোরাগড় জেলার অন্তর্ভুক্ত। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, ‘বিষয়টি আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।’ উল্লেখ্য, বর্ণিত এই এলাকা দিয়ে ভারত তার সেভেন সিস্টার খ্যাত রাজ্যগুলোর সাথে যোগাযোগ করে। কিন্তু এটা নেপালের হয়ে গেলে দেশটির অনুমতি ছাড়া আর ব্যবহার করতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে সেভেন সিস্টারের সাথে যোগাযোগ করার একমাত্র পথ হবে বাংলাদেশ। তাই নেপাল-ভারত পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠবে নিঃসন্দেহে। নেপাল-ভারতের সীমান্ত দৈর্ঘ্য ১,৮০০ কিলোমিটার। অন্যদিকে, লেপুলেক ভারত-চীনের যোগাযোগের একমাত্র পথ। এ কারণেও বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতকে তার প্রতিবেশীদের উপর দাদাগিরি করতে গিয়ে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি করতে হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে। ফলে দারিদ্র্য বিমোচনে তেমন গুরুত্ব দিতে পারেনি দেশটি। তাই সামরিক শক্তিতে বলিয়ান হলেও দেশটির অর্ধেকের বেশি মানুষ গরীব রয়েছে! উপরন্তু যুদ্ধ বাঁধলে তা শুধুমাত্র সীমান্তের মধ্যেই সীমিত থাকবে না, তা অভ্যন্তরেও বিস্তৃত ঘটবে। যুদ্ধের ব্যয় বহন করা বর্তমান করোনাকালে সকলের জন্যই কঠিন। তবে, ভারতের জন্য বেশি কঠিন। সামরিক শক্তিতে চীন শক্তিশালী ভারতের চেয়ে। পিডাব্লিউআর’র র্যাংকিং মতে, সামরিক শক্তির র্যাংকিংয়ে ১৩৮টি দেশের মধ্যে চীন ৩ নম্বরে ও ভারত ৪ নম্বরে। যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ও রাশিয়া দ্বিতীয়। চীনের সৈন্য সংখ্যা ২১.২৩ লাখ আর ভারতের ১৪.৪৪ লাখ। তবে রিজার্ভ সৈন্য চীনের ৫.১০ লাখ আর ভারতের ২১ লাখ। অপরদিকে সাইবার যুদ্ধে চীন বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক শক্তিশালী। ভারতের চেয়ে আর্থিক শক্তিও পাঁচগুণ বেশি চীনের। বর্তমানে চীন-ভারতের বাণিজ্যের পরিমাণ ৯,২০০ কোটি ডলার, যা অনুকূলে বেশি চীনের। চীনের সাথে গভীর সম্পর্কের দেশও আছে অনেক, যারা বর্তমানে সামরিক ও আর্থিকভাবে উঠতি শক্তিশালী দেশ। এমনকি ভারতের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে গভীর সম্পর্ক চীনের। বিশেষ করে পাকিস্তান। পাকিস্তানের সৈন্য সংখ্যা ১২ লাখের মতো। সর্বোপরি ভারত, চীন ও পাকিস্তানে রয়েছে বহু পরমাণু বোমা। এই অবস্থায় যুদ্ধ বাঁধলে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে সমগ্র এলাকায়। এমনকি চীন-পাকিস্তানের সাঁড়াশি আক্রমণে ভারতের পরিণতি হতে পারে মারাত্মক, যা সুদূর থেকে যুক্তরাষ্ট্র আসার আগেই ঘটে যাবে। সর্বোপরি ভারতের অভ্যন্তরীণ ভয়াবহ সংকট তো রয়েছেই।
তাই বর্ণিত সংকটগুলোর সুরাহা করতে হবে ভারতকে। এ জন্য প্রধান উপায় হচ্ছে, সামরিক ব্যয় হ্রাস করে তা দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যয় করা, হিন্দুত্ববাদী নীতি ত্যাগ করে বহুত্ববাদের ও গণতন্ত্রের ঐতিহ্য অটুট রাখা, পার্শ্ববর্তী সব দেশের সাথে সমমর্যাদাপূর্ণ বন্ধুত্ব ও কোন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, সীমান্ত সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা এবং সার্ককে শক্তিশালী করা। তাহলে নিজের যেমন কল্যাণ হবে, তেমনি পার্শ্ববর্তী সব দেশেরও কল্যাণ হবে। আধুনিক যুদ্ধ মানে সমূলে ধ্বংস হওয়া। তাই এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট অন্য দেশগুলোরও সংযমী হওয়া ও আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসন করা আবশ্যক। কেননা, যুদ্ধ হলে লাভ হবে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের আর সংশ্লিষ্টরা হবে ফতুর।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।