পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
হর্ষ বর্ধন শ্রীংলা ভারতের একজন ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট। বর্তমানে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব। এর আগে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তার আগে ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৩ বছর বাংলাদেশে ভারতের হাই কমিশনার ছিলেন। তারও আগে তিনি থাইল্যান্ডে ভারতের হাই কমিশনার ছিলেন। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন জয়শঙ্কর। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জয়শঙ্করকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দেন। জয়শঙ্কর ঠান্ডা মাথার মানুষ এবং বিজেপির হিন্দুত্বের আদর্শের অনুসারী। হর্ষ বর্ধনও ঠান্ডা মাথার মানুষ। তিনিও বিজেপির আদর্শের অনুসারী। তবে জয়শঙ্করের আদর্শের দিকটা যতখানি প্রকাশিত, হর্ষ বর্ধনের আদর্শিক দিকটা ঠিক ততখানিই অপ্রকাশিত। নরেন্দ্র মোদি জয়শঙ্করকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বানান, আর জয়শঙ্কর হর্ষ বর্ধনকে পররাষ্ট্র সচিব বানিয়েছেন। এখন নরেন্দ্র মোদি, জয়শঙ্কর এবং হর্ষ বর্ধন তাদের পররাষ্ট্রনীতি ফরমুলেট করছেন।
বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের নীতি নির্ধারণে ৪ জন আমলার নাম স্মরণ করা যেতে পারে। এরা হলেন দুর্গা প্রসাদ ধর বা ডিপি ধর, পি এন হাকসার, সুজাতা সিং এবং হর্ষ বর্ধন শ্রীংলা। ডিপি ধর এবং পিএন হাকসার পরলোকগত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আস্থাভাজন ছিলেন এবং সে সময় থেকেই বাংলাদেশের ব্যাপারে প্রো-আওয়ামী লীগ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেন। সুজাতা সিংয়ের কথা এতই মশহুর যে, সেই কথা আর নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না। ইনিই সেই সুজাতা সিং, যিনি ২০১৪ সালের নির্বাচনকে জায়েজ করার জন্য ঢাকায় এসে এরশাদকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য বাধ্য করেছিলেন। তখন ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস এবং প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ড. মনমোহন সিং। আর কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট ছিলেন সোনিয়া গান্ধী। সেদিন যদি সুজাতা সিং তথা ভারত সর্বশক্তি প্রয়োগ করে এরশাদ তথা জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে না আনতেন তাহলে আজ হয়তো বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ইতিহাস সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে লেখা হতো। সবশেষে হর্ষ বর্ধন শ্রীংলা। তিনি পররাষ্ট্র সচিব হিসাবে নতুন হলেও তার ডিপ্লোম্যাটিক ক্যারিয়ার অনেক দীর্ঘ। বাংলাদেশে দীর্ঘ ৩ বছর ধরে ভারতীয় হাই কমিশনার হিসাবে কাজ করার ফলে তিনি বাংলাদেশের নাড়ি নক্ষত্র জানেন। পররাষ্ট্র সচিব হিসাবে বাংলাদেশে প্রথম সফরে এসে তিনি তার ৩ বছরের নলেজ এবং অভিজ্ঞতাকে মোক্ষমভাবে কাজে লাগিয়েছেন।
দুই দিনের জন্য বাংলাদেশ সফরে এসে ভারতের নব নিযুক্ত পররাষ্ট্র সচিব সরকারের কর্ণধারদের কাছে বৈঠকে কী বলেছেন, সেটি জানা যায়নি এবং জানা সম্ভবও নয়। তবে তার মনে কী আছে, সেটি কিন্তু তিনি প্রকাশ করেছেন। মনে যখন কিছু আছে এবং সেটি যখন একটি সেমিনারে তিনি প্রকাশ করেছেন তখন সেসব কথা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে তিনি কথা বলেছেন এবং প্রস্তাব দিয়েছেন, সেটি ধরে নেওয়া যায়। বাংলাদেশ সরকার কী জবাব দিয়েছে, সেটি জানা যায়নি। তবে সেটিও ধরে নেওয়া যায়। এব্যাপারে আরও বেশি কথা বলার আগে, আসুন জেনে নেওয়া যাক, হর্ষ বর্ধন শ্রীংল কী বলেছেন। তিনি যা বলেছেন তার বিস্তারিত একটি বা দুটি পত্রিকা ছাড়া আর কেউ প্রকাশ করেনি। তবে ইংরেজি দৈনিক ‘নিউ এজ’ সেই খবরটি প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশ করেছে।
ইংরেজি নিউ এজ পত্রিকা সেই খবরটি গত ৩ মার্চ প্রকাশ করেছে। খবরে বলা হয়েছে, বাংলা-ভারত সম্পর্ক নিয়ে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে গত ২ মার্চ ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বক্তব্য পেশ করেন। তিনি বলেন, ভারত তাকিয়ে আছে দুই বন্ধু প্রতীম দেশের মধ্যে মিলিটারি টু মিলিটারি কো-অপারেশন, অর্থাৎ দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতার দিকে। এই সামরিক সহযোগিতার মধ্যে থাকবে ভারতে প্রস্তুত সামরিক সরঞ্জমাদি বাংলাদেশে বিক্রয়। তিনি বলেন, আমাদের দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিশাল গভীর এবং ঘনিষ্ঠ অংশীদারিত্ব গড়ার জন্য আমরা দুই দেশ যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছি, সেটি প্রমাণ করে যে, আমাদের দুই দেশের মধ্যে পারস্পারিক আস্থা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। মি. শ্রীংলার এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতার আলাপ-আলোচনা এখনো চলছে। তিনি আরও বলেন যে, আমাদের দেশে যত রকম যুদ্ধাস্ত্র তৈরি হয় তার সবগুলোই আমরা আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই।
দুই
শুধুমাত্র সমরাস্ত্র বিক্রিই নয়, বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর জন্য ভারতে ট্রেনিংয়ের সুযোগ-সুবিধা উন্মুক্ত বলেও তিনি মন্তব্য করেন। উভয় দেশের শীর্ষস্থানীয় সামরিক প্রতিষ্ঠানসমূহে সর্বস্তরের সামরিক অফিসারদের প্রশিক্ষণের দুয়ার খোলা থাকবে। তিনি দাবি করেন যে, আসামে নাগরিক পঞ্জি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এবং নাগরিকত্ব আইন সংশোধন (সিএএ) হচ্ছে ভারতের সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কাজেই সেগুলির কোনো প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের সরকার এবং জনগণের ওপর পড়বে না। তিনি আরও বলেন, তিস্তুাসহ ৬টি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন সম্পর্কে আলোচনা চলছে, পানি প্রবাহের সর্বশেষ অবস্থা রেকর্ড করা হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে যে, এসম্পর্কিত একটি চুক্তি এবছরের শেষের দিকে স্বাক্ষরিত হতে পারে। তিনি বলেন, তিস্তার পানি বণ্টন সম্পর্কিত চুক্তিটি এখনো আলোচনার টেবিলে আছে। দুই দেশের পানিসম্পদ সচিবরা এসম্পর্কে আরও আলোচনার জন্য খুব শীঘ্রই একটি বৈঠকে বসবেন।
এখানে ভারতের নতুন পররাষ্ট্র সচিব মনে হয় পানি বণ্টন ইস্যুটিকে ভিন্নমাত্রা দিতে যাচ্ছেন। তিস্তা নদীর সাথে তিনি বাকি নদীগুলো অর্থাৎ দুধকুমার, ধরলা ইত্যাদিকে গুলিয়ে ফেলছেন। ঐ ৬টি নদী সম্পর্কে কী কী বিষয় আলোচনা হয়েছে এবং কী কী বিষয় আলোচনা হয়নি সেগুলি ভিন্ন বিষয়। তিস্তা চুক্তিকে তিনি খুব কৌশলে এড়িয়ে গেছেন এবং বাংলাদেশের কাছে তিস্তার গুরুত্ব কমে যাওয়ার জন্য অতীতের ঘটনাবলী ইচ্ছে করেই স্মরণ করেননি।
ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রীংলা হয়তো ভুলে গেছেন যে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন ঢাকায় এসেছিলেন তখন তিনি তিস্তা চুক্তি চূড়ান্ত করেই ঢাকা এসেছিলেন। তখন শুধু একটি বিষয়ই বাকি ছিল। সেটি হলো, দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের বা সচিবদের স্বাক্ষর করা। শেষ মুহূর্তে মমতা ব্যানার্জী আসেননি। তখন ভারতীয় পক্ষ থেকে বলা হয় যে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার যখন অন্য কোনো দেশের সাথে কোনো চুক্তি স্বাক্ষর করবেন তখন সেই চুক্তিটি যদি ভারতের কোনো প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্য সংশ্লিষ্ট হয় তাহলে সেই রাজ্যের সম্মতি প্রয়োজন। মনমোহন সিং যে চুক্তির খসড়া এনেছিলেন, ঢাকায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর অনুপস্থিতিই বলে দেয় যে, ঐ চুক্তিতে মমতা ব্যানার্জীর সম্মতি নাই। সেই কারণে ২০১১ সালে ড. মনমোহন সিংয়ের আমলে চুক্তিটি আর সই হয়নি।
তারপর ৯ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি আর আলোর মুখ দেখেনি। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রীংলা যতই আশ্বাস দিন না কেন যে চলতি সালের শেষের দিকে তিস্তা নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে, সেই আশ্বাস নেহায়েৎ বাংলাদেশের মন ভুলানো কথা। এই ৯ বছরে পানি অনেক দূর গড়িয়েছে। এর মধ্যে মমতা ব্যানার্জী রুদ্র নামক এক ব্যক্তিকে দিয়ে একটি কমিশন গঠন করেছিলেন। মিস্টার রুদ্র নাকি পশ্চিমবেঙ্গ সবচেয়ে বড় ওয়াটার এক্সপার্ট। রুদ্র কমিশন রিপোর্ট দিয়েছে যে, উজানে অর্থাৎ সিকিমে, যেখান থেকে তিস্তা নদী উৎসারিত, সেখানে অর্থাৎ সিকিমে একাধিক বাঁধ দিয়ে তিস্তা নদীর পানি আটকে দেওয়া হয়েছে। সিকিমের চাহিদা মিটিয়ে যতটুকু পানি পশ্চিমবঙ্গে আসে সেই পানি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের চাহিদাই মেটানো সম্ভব হয় না। সেই পানির একটি হিস্যা বাংলাদেশকে দিলে পশ্চিমবঙ্গের কিছুই থাকে না।
তিন
মমতা ব্যানার্জী এখন যা বলছেন, সেগুলো হয়তো সত্য। কিন্তু সেগুলো তো বাংলাদেশের মাথা ব্যাথা নয়। সেগুলো ভারতের মাথা ব্যাথা। তিস্তা নদীর পানির নায্য অংশ বাংলাদেশ চায়। যেন তেন প্রকারে একটি চুক্তি করলেই বাংলাদেশ খুশি হবে কেন? সিকিম বাঁধ দিয়ে তিস্তার পানি আটকালে সেখানেই তো ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ করা উচিত ছিল। ২০১৪ সাল থেকে নরেন্দ্র মোদি ভারতের ক্ষমতায় আছেন। এই ৯ বছর ধরে সিকিম তিস্তার পানি আটকালো এবং তিস্তার মোট পানি কমে গেল, সেখানে বাংলাদেশ উচ্ছিষ্টের মতো যে টুকু পানি চুঁইয়ে চুঁইয়ে বাংলাদেশে আসবে, সেটুকু গ্রহণ করবে কেন? যেন তেন প্রকারের একটি তিস্তা চুক্তি বাংলাদেশ সরকারের নিকট গ্রহণযোগ্য হলেও বাংলাদেশের জনগণের নিকট তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।
সীমান্ত হত্যা সম্পর্কে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব যে কথা বলেছেন, বাংলাদেশের নিকট তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো রকম পরিসংখ্যানের আশ্রয় না নিয়েই হর্ষ বর্ধন শ্রীংলা ঢালাওভাবে বলেছেন যে সীমান্তে যে, হত্যাকান্ড হচ্ছে সেটার অনুপাত নাকি দুই দেশের মধ্যে ৫০ঃ৫০। কাকে কী বোঝাচ্ছেন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব? বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর গুলিতে কয়জন ভারতীয় মারা গেছে? তার পরিসংখ্যান দেওয়া হোক। দেখা যাবে, সেই অনুপাত ৯৫ঃ৫ও নয়। অর্থাৎ ভারত ৯৫ জন বাংলাদেশি হত্যা করে থাকলে বাংলদেশ ৫ জন ভারতীয়কেও হত্যা করেনি। আর হর্ষ বর্ধন শ্রীংলা এক লাফে বাড়িয়ে দিলেন ৫০-এ। বাংলাদেশের জনগণ এতটা আহম্মক নয় যে, যা বোঝাবেন তাই বুঝবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।