Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নারী কন্যা-জায়া-জননী রূপে গড়ে উঠুক

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৮ মার্চ, ২০২০, ১২:০২ এএম

আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। রাষ্ট্র, সমাজ ও জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে এবং স্তরে পুরুষের সমপর্যায়ে নারীর অধিকারবাদের এক উজ্জ্বল দিন। অবশ্য বলতে হয়, সমানাধিকারের দাবি যেন পাশ্চাত্য দেশের প্রগতির অন্তিম ধারায় পর্যবসতি না হয়। তাদের মতো যেন বলতে না হয়, আমরা পুরুষের চেয়ে কম কীসে? শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, দক্ষতা-যোগ্যতা, কোনো বিষয়ে যখন কম নই, তখন পুরুষের কাছে নতমস্তক হব কেন? সুতরাং দেশে-বেশে, আচারে-ব্যবহারে, আহারে-বিহারে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে বাধা কোথায়? 

অবশ্য বলতে হয়, নারী শিক্ষা-দীক্ষায় পুরুষের পাশে দাঁড়াবার অধিকার লাভ করলেও পরিবার ও সমাজজীবনে বহু নারী আশানুরূপ শান্তি ও সন্তোষ লাভ করতে পারেনি। নারীর অধিকার বিষয়ে রাষ্ট্রও সজাগ। নারী-পুরুষ ভেদাভেদ যাতে না-থাকে সে ব্যাপারে আইনের ব্যবস্থা আছে। এত কিছুর পরও নারী নির্যাতন, অপহরণ, ধর্ষণ, খুন ইত্যাদি ঘটনা বেড়েই চলছে। বহু নারী যেমন অনেক ক্ষেত্রে নারীত্বের মর্যাদা হারিয়েছে। একদল পুরুষের ক্ষেত্রে নারী শুধুই ভোগ-লালসার সামগ্রী। শিক্ষিত-অশিক্ষিত দুটি দিক একই অবস্থায় আছে। উচ্চশিক্ষিত এবং উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত পুরুষের ভোগ-লালসার যে চিত্র পাওয়া যায় তাতে দেখা যায়, লালসার শিকার যেমন রুচিমার্জিতা নারী হচ্ছে, ঠিক একদল নারী শিকার ধরে দেবার ফাঁদও তৈরি করে পুরুষকে প্রলোভিত করছে।
বিকৃত মানসিকতার নারী-পুরুষ যেমন আছে সুস্থ মানসিকতার নারী-পুরুষও আছে, যারা কোনোদিন-কারও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে না। বরং দেখা গেছে, বহু পুরুষই নারীকে বেশি সম্মান দেয়। বলতে অসুবিধা নেই যে, এ দেশের অনেক পরিবারই নারী-পুরুষের সম্মিলিত শক্তিদ্বারা সুষ্ঠু রূপে গড়ে উঠেছে। তা ছাড়া বহু পুরুষই ঘর গৃহস্থলিতে নারীর অবদানকে অগ্রাহ্য করে না। সেই সঙ্গে বহু স্বামী তার রোজগারের টাকা আগেও যেমন স্ত্রীর হাতে তুলে দিত, বর্তমানেও দিচ্ছেন।
বলতে দ্বিধা নেই, বহু-স্ত্রী তার স্বামীকে পদানত রাখার নজির যেমন আছে, তেমনি বহু স্বামীও তার স্ত্রীকে পদানত রেখে অত্যাচার করার নজিরও আছে। তাহলে মানুষ নামক জীব, সে পুরুষই হোক বা নারীই হোক, সুখ-শান্তি ভোগ করতে পারে না। ব্যক্তি স্বাধীনতার মূল অর্থ না বুঝে স্বাধীনতার কথা অনেকেই বলে। কিন্তু স্বাধীন সত্তার অর্থই অনেকে জানে না; পুরুষ স্বাধীনতা ও নারী স্বাধীনতা বলতে যে আলাদা কোনও স্বাধীনতা নেই।
একই জীবন সত্তার কথা আজ প্রচার করার সময় হয়েছে। পুরুষতন্ত্র ও নারীতন্ত্র বলতে কিছু নেই, তা পরিষ্কার করা দরকার। পুরুষহীন নারী যেমন থাকতে পারে না, নারীহীন পুরুষও থাকতে পারে না। এই উভয়কে নিয়েই আছে মানবতন্ত্র। যা বাঁচা-বাড়ার ক্ষেত্রে একান্ত প্রয়োজন।
পুরুষতন্ত্র পুরুষের এক মনগড়া তন্ত্র। স্নায়ুতন্ত্রে ওই তন্ত্রকে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়ায় পুরুষ জন্ম থেকে হয়ে উঠে ক্ষমতাশালী এবং নারীর রক্ষক। আসলে কেউ কারও রক্ষক নয়। সবাই নিজে নিজেই রক্ষক হবার ক্ষমতা অর্জন করে। সত্যি সত্যি নারী জাগরণ যদি ঘটে, তাহলে প্রতিটি ঘরের মনুষ্যত্বহীন পুরুষগুলোর পৌরুষ জাগবে। খুন-ধর্ষণ, অসাধুকর্মকান্ড, দুর্নীতি পৌরুষের প্রতীক নয়। পুরুষ কখনও নারীহীন ঘরে থাকে না। পুরুষের অপৌরুষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না থাকায় খুনী, ধর্ষক, দুনীর্তিবাজ, অসাধুপুরুষ ঘরে এসে আশ্রয় নেয়। আর সেই আশ্রয় দেবার অপরাধ থেকে নারী মুক্ত হতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, গৃহিণীর মন-মেজাজ-অহংকার বজায় রাখতে পুরুষকে দুর্নীতির প্রশ্রয় নিতে হয়। গৃহবিবাদের মূলেও অনেকাংশে নারী, তারও অনেক প্রমাণ আছে।
শিক্ষা-দীক্ষায় নারী এখন অনেক এগিয়ে। তা ছাড়া নারী যে পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি সহানুভূতিপ্রবণ এবং শৃঙ্খলাপরায়ণ, তা আর বলেতে হয় না। দেখা গেছে, একটা ছেলেকে নিয়ে পরিবার যত বিব্রত হয়, মেয়েকে নিয়ে কিন্তু ততটুকু নয়। মেয়েরা বোঝে মা-বাবার দুঃখ-কষ্ট। নারীজীবন মুখ্যত তিন ভাগে বিভক্ত। কন্যা, জায়া ও জননী। তাই নারীশিক্ষা বলতে নারী জীবনের এই তিনটি অঙ্গকে সুন্দরভাবে বিকশিত করে তুলতে হবে। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নারী জাতিকে আদর্শ জায়া ও জননীরূপে গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগ নেই। অথচ, তাদেরও কোনোদিন সংসারের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জ্ঞান নেওয়ার প্রয়োজন আছে। দেখা যায়, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় যেসব বিষয় আছে তা অধ্যয়ন করে শেষে চাকরি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে অর্থার্জনের সুযোগ-সুবিধা নিতে চায় নারী। কিন্তু জীবনের পূর্ণতা যে শুধু অর্থ উপার্জনের মধ্যেই নয়, বিবাহের মধ্যে দিয়ে পরিসমাপ্তি হয় সেটা বুঝার চেষ্টা করে না কউে কেউ। পাশ্চাত্যের অনুকরণ করে অনেক নারীই অশান্তিকে বরণ করে। এ দেশ থেকে যে পারিবারিক প্রথা এখনও লুপ্ত হয়ে যায় নি, সে জ্ঞান তাদের থাকা দরকার। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হোক নারী, কিন্তু মানসিক ও শারীরিক বৃত্তিকে যেন সুন্দর পথেই পরিচালিত করে।
সমাজে পুরুষের যে অধিকার আছে, নারীরও সেই অধিকার আছে। বিবাহিত জীবনেও নারীর সমান অধিকার। কোনও নারী যদি সেইসব অধিকার লাভ থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে সেইসব অধিকার তার লাভ করতে হবে পুরুষের সাথে হাত মিলিয়ে তার নারীত্বের মহিমাকে জাগ্রত করে। নারী শিক্ষায় উন্নত হোক, নারীত্ব জাগুক। অধিকার আপনা থেকেই আসবে। অধিকার কেউ দেয় না, অধিকার অর্জন করতে হয়।
বিশ্বায়নের বাজার ধরে রাখতে নারীর দেহ-প্রদর্শন, ইন্টারনেটের মাধ্যমে নারীর অশ্লীল ছবি বিতরণ, বিশ্ব সুন্দরীর খেতাব জয়ে নারী জাগরণ নারীকে স্বাধীন করে না, বরং পুরুষের ভোগ-লালসাকে বাড়িয়ে দেয়। সে কারণে বাংলাদেশি সকল নারীই বুঝবে নারীর কর্তব্য কী। বিশ্বায়ন বলতে এই নয় যে, দেশের প্রাচীন কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে বিশ্বের বাজারে বিক্রি করে দিতে হবে। উন্নতি বলতে এই নয় যে, বিশ্বের বাজার থেকে নিজের দেশের উপযোগী নয় এমন আদর্শ টেনে আনতে হবে। শিক্ষার অর্থ এই নয় যে, ভোগ-বিলাসে গা ভাসিয়ে দেবে। দেখা গেছে, উন্নতশীল দেশে নারী-পুরুষ শিক্ষা দীক্ষায় উন্নত হয়েছে, প্রচুর অর্থ রোজগার করতে পারছে, ভোগ-বিলাসে নিজকে ভাসিয়ে আনন্দ উপভোগ করতে পারছে। কিন্তু সত্যি কী তারা সুখী? সুখ কুড়িয়ে আনতে গিয়ে কুড়ানো সুখ থেকে কেন উঠে আসছে কাড়ি কাড়ি হতাশা? উচ্ছৃঙ্খল স্বাধীনতা এবং বোধহীন শিক্ষা জীবনের প্রকৃত মমার্থ অনুধাবন করাতে পারে না।
নারী-পুরুষ উভয় ক্ষেত্রেই প্রকৃত শিক্ষা ফলপ্রসূ হোক। সমপর্যায় আসবে। তবেই মনে হবে নারী ভোগের বস্তু না, নারী প্রতিটি পুরুষের ক্ষেত্রে তিন ভাগে বিভক্ত কন্যা-জায়া ও জননী রূপে সেই সৃষ্টির শুরু থেকেই। আর কন্যা-জায়া-জননী হলেই যে নারী গৃহবন্দি হয়ে পড়ে তাও সত্য নয়। সেই অধিকার খর্ব হওয়ারও কথা নয়। সেই অধিকার বলে যৌতুকের মতো সামাজিক ব্যাধি নির্মূল করতে হবে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সরব হতে হবে। ভুললে চলবে না, নারীর তেজ-বীর্যের কথা। সেই ক্ষমতা নিয়ে কন্যা-জায়া-জননী জাগ্রত হলেই ঘটবে নারীর জাগরণ সুখ-শান্তি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নারী

১৫ জানুয়ারি, ২০২৩
২৮ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন