পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলা ভাষার রকম মোটা দাগে সাধু ও চলতি ভাষা হলেও অঞ্চল ভিত্তিক এর বিভিন্ন প্রকার রয়েছে। বাংলাদেশে এমন কিছু আঞ্চলিক ভাষা রয়েছে, যা বুঝে উঠা অন্য অঞ্চলের মানুষের পক্ষে অনেক সময় সমস্যা হয়ে পড়ে। তারপরও প্রমিত বাংলা ভাষাই এদেশের মানুষের মাতৃভাষা, প্রাণের ভাষা। পৃথিবীতে মাতৃভাষার স্বীকৃতির জন্য অনেক রাষ্ট্রেই আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। কিন্তু বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা ঘোষণা করার জন্য যে সংগ্রাম হয়েছে পৃথিবীর অন্য কোনো রাষ্ট্রে তা হয় নাই। এর পিছনে রয়েছে বিবিধ প্রেক্ষাপট।
ভারত স্বাধীনতা আইন, ১৯৩৫ মোতাবেক ১৯৪৭ সালের আগস্টে যখন দ্বিজাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীনতা লাভ করে, তখন অবিভক্ত বাংলা ভারতের একটি অংশ ছিল। ১৯৪৭-এ পাকিস্তানের অংশ হিসাবে পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রীয় নাম পূর্বপাকিস্তান হিসাবে স্বীকৃত হয়। পূর্বপাকিস্তান স্বাধীন পাকিস্তানের অংশ হলেও পশ্চিম পাকিস্তানই পূর্ব বাংলা অর্থাৎ পূর্বপাকিস্তানকে শাসন-শোষণ করেছে। ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ কায়দে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর এ ঘোষণার মধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বীজ রোপিত হয়।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালিত হয়। এটি ছিল পাকিস্তানোত্তর প্রথম হরতাল। তমদ্দুন মজলিস ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ যৌথভাবে এই হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করে এবং সমগ্র পূর্ব বাংলায় সফলভাবে হরতাল পালিত হয়। ১১ মার্চ হরতালের দিন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা হবে মর্মে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি লিখিত চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ১৯৫২ সালের আগ পর্যন্ত প্রতি বছর ১১ মার্চকে রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হতো। কিন্তু খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা করেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ফলে ভাষা আন্দোলন একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে। নতুন মাত্রা লাভ করে। শুরু হয় নতুন অধ্যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই ঘোষণার প্রতিবাদে ধর্মঘট পালন করে। এর এক মাসেরও কম সময়ে আন্দোলন তার চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে এবং ২১ ফেব্রুয়ারির বিয়োগান্তক ঘটনার মধ্য দিয়ে সাফল্য আসে। ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবানে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরিতে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে সর্বদলীয় বৈঠক হয়। বৈঠকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য ৪০ সদস্যের একটি সর্বদলীয় কর্মপরিষদ গঠিত হয়।
একটি বিরাট জনগোষ্ঠিকে নিরক্ষর রেখেই প্রতি বছর ভাষা দিবস উৎযাপিত হচ্ছে। নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় নাই। তবে প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ এটাই ছিল ভাষা আন্দোলনের মূল বক্তব্য। আন্দোলনটির ইতিহাস রক্তের অক্ষরে লেখা। কিন্তু বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে স্বীকৃত লাভের পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার কাজ অথবা ফাউন্ডেশন ওয়ার্ক তথা ভিত প্রস্তুতিকরণ কাজটি সেভাবে শুরু করা হয় নাই। এর মূল কারণ বিশ্বব্যাপী রয়েছে ইংরেজি ভাষার ব্যাপক প্রভাব। যেমন পুলিশের গুলিতে ১৯৫২ সালে হত্যা কান্ডটি ঘটেছিল ৮ ফাল্গুন। কিন্তু তারিখটি প্রতিষ্ঠিত হলো ইংরেজি দিন পঞ্জিকা মোতাবেক অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি। বাঙ্গালী জাতি তো বটেই, পৃথিবীর অন্য রাষ্ট্রেও ইংরেজি পঞ্জিকা অনুসরণেই দিনটি অমর একুশে নামকরণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ বিষয়টি যদি অমর ফাল্গুন নামে প্রতিষ্ঠিত হতো এবং প্রতি বছর ৮ ফাল্গুনকে অনুসরণ করেই অন্যান্য রাষ্ট্রে দিবসটি পালিত হতো, তবে কি বাংলার প্রতি বিশ্ব জগতের দৃষ্টি আরো গভীরভাবে আকৃষ্ট হতো না? এমনিভাবে ইংরেজির অনেক প্রভাব বাংলাতে রয়েছে এবং দিনে দিনে ব্যাপক আকারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’। এখানে ‘ফাল্গুন মানে মাথা নত না করা’ বলে কথাটি প্রতিষ্ঠিত বা প্রচলন করলে কি বাংলার প্রতি আরও যত্নবান হওয়া যেতো না? ৮ ফাল্গুনকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ কি এখন আর নাই? এ সুযোগ বা সম্ভবনা কি শেষ হয়ে গেছে? পৃথিবীতে অনেক রাষ্ট্র রয়েছে যেখানে জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করে জাতির আশা আকাক্সক্ষা ও ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে।
বাংলা ভাষার উপর বিদেশি ভাষার প্রভাব অনেক বেশি। ভিন্নদেশি সংস্কৃতিকে অনুসরণ করে অনেক মানুষই নিজেকে অভিজাত শ্রেণিভুক্ত করার আশা পোষণ করে। এদেশের মাঠে-ঘাটে খেটে খাওয়া মানুষ, পথে পথে ঘুরে বেড়ানো বাউল, দরবেশ, ফকিররা বাংলার সংস্কৃতিকে যেভাবে লালন করে দেশের অভিজাত শিক্ষিত সমাজ সেভাবে খাঁটি বাঙ্গালীয়ানার পরিচয় বহন করে না। পক্ষান্তরে কাঁটা চামচে খাওয়া, আধা বাংলা আধা ইংরেজি অর্থাৎ মিশ্র ভাষায় অনর্গল কথা বলাকে অনেকে অভিজাত শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্তির তৃপ্তি পায়। পোশাক-পরিচ্ছদেও অনুরূপ মানসিকতা বর্তমানে অভিজাত শ্রেণির লোকেরা লালন করছে। ফলে ভাষা হিসাবে বাংলার প্রচলন ও সংস্কৃতিতে বাংলাকে লালনের পরিবর্তে বাঙ্গালীরা দিনে দিনে মিশ্র সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। হালে বাংলা সংস্কৃতি একটি আনুষ্ঠানিকতায় রূপান্তরিত হয়েছে। যেমন, পয়লা বৈশাখ, নবান্ন, শীতের পিঠা উৎসব, গ্রামে গঞ্জে পৌষ মাসের মেলা প্রভৃতি। রাষ্ট্র দেশীয় খেলাধুলাকে অবমূল্যায়ন করে বিদেশি খেলাধুলার প্রতি বেশি বেশি নজর দিচ্ছে এবং ঢালছে কোটি কোটি টাকা। দেশীয় ক্রীড়া নৌকা বাইচ, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগ লড়াই, হাডুডু, কাবাডি প্রভৃতি পরিচালনায় রাষ্ট্রীয় কোনো প্রকার পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া যাচ্ছে না।
বাংলা সংস্কৃতিকে লালন করার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে যে প্রতিষ্ঠানটি দায়িত্বপ্রাপ্ত তা হলো, বাংলা একাডেমি। একাডেমি শব্দটি বাংলা নয়। প্রতিষ্ঠানটি এখন সরকারি দলের একটি অঙ্গ সংগঠনে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিন যাবৎ সরকারি দল প্রতিষ্ঠানটি দখল করে রেখেছে, সেখানে কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি নাই এবং সরকারি দল ভিন্ন অন্য কোনো মতাদর্শের লেখক বা লেখার স্থান তারা দিচ্ছে না। ফলে বাংলা একাডেমি কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ সবগুলিই একপেশে এবং সরকারের গুণ কীর্তন ভিত্তিক। বই প্রকাশনা বা গবেষণার মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে সরকারি আনুগত্যকেই বেশি প্রধান্য দেয়া হচ্ছে, অথচ সৃজনশীল সৃষ্টিকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে না। রাষ্ট্রের মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার, যাদের সরকারি প্রভাবমুক্ত রাখা জরুরি। সরকার সামাজিক, পেশাভিত্তিক, সংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলির দখল নিয়ে তা একপেশে করে ফেলছে, যার ফলে দেশি সংস্কৃতি সার্বিক ও সার্বজনিনভাবে গড়ে উঠতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। বাংলা একাডেমি দলীয়করণ হওয়ার কারণে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধনে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকায় বাঙ্গালীর যেমন একটি ইতিহাস আছে, মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করার যেমন ঐতিহ্য রয়েছে, অন্যদিকে আপোষকামিতার জন্য একটি শ্রেণির উৎসাহ উদ্দীপনা চোখে পড়ার মতো। সংস্কৃতি ও ভাষার সাথে এক শ্রেণির লোকের আপোষকামিতার কারণেই মনে পড়ে যায়, একদিন বাঙ্গালী ছিলাম রে গানের সৃষ্টি ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে।
মাতৃভাষা, রাষ্ট্র ভাষা, আন্তর্জাতিক ভাষা, ধর্মীয় ভাষা প্রভৃতি জাতিগতভাবে প্রতিষ্ঠিত করা প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত জরুরি। মাতৃভাষাকেই হতে হবে রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু মাতৃভাষা রাষ্ট্র ভাষা হওয়ার কথা এই নয় যে, আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজিকে গুরুত্বহীন করে দিতে হবে। কারণ আর্ন্তজাতিক বিশ্বে প্রতিটি রাষ্ট্র একে অপরের সাথে বৈরী সম্পর্কের চেয়ে সুসম্পর্কের মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া বাঞ্চনীয়। এর ফলে শিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজিকে গুরুত্বহীন করলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। বাঙ্গালীর ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য বাংলার উপর গবেষণা এবং বাংলাভাষার প্রয়োগ ও প্রচলন অত্যান্ত জরুরি, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ভাষাকে আবশ্যকীয়ভাবে শিক্ষার ও প্র্যাকটিসের উপর গুরুত্ব দেয়াও জরুরি। অন্যদিকে একজন মানুষকে মানবিক ও নৈতিকতাপূর্ণ মানসিকতায় গড়ে তোলার জন্য ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। কোনো ধর্মীয় বাণীই বাংলা ভাষায় রচিত হয় নাই। বাংলাদেশে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃস্টান ধর্মাম্বলীসহ অন্যান্য ধর্মাম্বলী রয়েছে, যাদের নিজ নিজ ধর্মীয় ভাষা আছে। যেমন, মুসলমানদের আল কোরআন আরবী ভাষায়, হিন্দুদের বেদ সংস্কৃতি ভাষায় রচিত প্রভৃতি। নিজ নিজ ধর্মীয় ভাষার প্রতিও সমভাবে গুরুত্ব ও শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের দাবি উঠেছে।
অন্য কোনো ভাষায় পারদর্শী হওয়া মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা নয়। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অনেকগুলি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। আল্লামা ইকবালের পান্ডিত্য শুধু উর্দু ভাষায় ছিল না। ভাষাভিত্তিক ঐতিহ্য লালন করা বা নিজ ভাষার প্রতি যত্নশীল ও মর্যাদাশীল হওয়ার পাশাপাশি বিশ্বের অন্য চলমান ভাষার শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব প্রদান অত্যন্ত জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে বা উচ্চ আদালতে বাংলা চালু করার দাবি উঠেছে এবং এ মর্মে কমিটি গঠিত হয়েছে। স্মরণ রাখা দরকার, বিজ্ঞান, গবেষণা বা অনুসন্ধানমূলক যে সকল গ্রন্থ রচিত হয়েছে তা বাংলা ভাষায় খুবই নগন্য। উচ্চ আদালত ও উচ্চ শিক্ষায় ইংরেজিকে পরিহার করার পূর্বে এ বিষয়গুলিও চিন্তা করা আবশ্যক।
লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।