পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
জাতিগত বৈষম্য ভারতে নতুন কোনো সমস্যা নয়। এ সমস্যা সেখানে আবহমান কাল থেকে বিরাজমান। এর ফলে ভারতের নানা স্থানে ‘দলিত’ নামের একটি শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে। তাদেরই তিন হাজারেরও বেশি মুসলিম হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বলে প্রকাশিত এক খবরে জানা যায়। অপর এক প্রকাশিত খবরের প্রতিও অনেকেরই দৃষ্টি আকৃষ্ট হওয়ার কথা, তাতে বলা হয়েছে যে, ‘জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করলে ভারতে একজনও হিন্দু থাকত না।’
প্রথম খবরটি দৈনিক ইনকিলাব গত ২৯ ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রথম পৃষ্ঠায় এবং দ্বিতীয় খবরটিও একই তারিখের আন্তর্জাতিক পাতায় বর্ণিত শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। আলোচনার সুবিধার জন্য আমরা দুইটি খবরের পর্যায়ক্রমিক আলোচনা নিম্নে তুলে ধরতে চাই:
এক. ভারতের তামিলনাড়–র কোয়েম্বান্টুরের কাছের একটি গ্রামের তিন হাজারেরও বেশি দলিত জাতিগত বৈষম্যের অভিযোগ তুলে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে মুসলিম হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। অঞ্চলটি হিন্দু অধ্যুষিত হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে তাদের সাথে সামাজিক বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয় বলে অভিযোগ এই দলিত বাসিন্দাদের।
ঘটনার সূত্রপাত একটি দেয়াল ভেঙে পড়ে ১৮ জন দলিতের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল খবরে তার বিবরণ এবং বর্ণ হিন্দুদের দলিতদের প্রতি অন্যায় আচরণের কথা উল্লেখ করে বলা হয় যে, উচ্চবর্ণ হিন্দুদের দ্বারা নিপীড়নে অতিষ্ঠ দলিতদের কূয়া থেকে পানি আনতে দেয় না, মন্দিরের ধারে কাছে যেতে দেয় না, রাস্তায় ধরে মারে, আবার মামলাও দেয় এবং রাস্তায় মোবাইলে ফোন করতেও নিষেধ করে। এসব অন্যায় আচরণ ও নিপীড়নের কারণে এ দলিতরা হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হওয়ার কথা ঘোষণা করেছে।
ভারতের নানা স্থানে অহরহ এ ধরনের নিপীড়ন চলছে। বহির্বিশে্বএসব ঘটনার খবর না পৌঁছালেও ছিটে ফোটা খবর বের হয়ে যায়। ভারতে এসব দলিতের সংখ্যা কত, তা জানা না গেলেও তাদের প্রতি নিপীড়নের ধারা থেমে নেই। পরিস্থিতির শিকার এসব দলিত ভয় ভীতির কারণে হয়ত প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করতে পারেন না, তাদের অনেকেই অনুধাবন করতে পারেন যে, এ নিপীড়ন হতে একমাত্র ইসলামই তাদের রক্ষা করে তাদের শান্তি ও জীবনমান উন্নত করতে পারে, কিন্তু সেখানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ প্রতিক‚ল। সাহস করে যারা শান্তির ধর্মে আসতে চায়, তিন সহস্রাধিক দলিত হিন্দুর মুসলমান হয়ে যাওয়ার ঘটনা তারই একটি দৃষ্টান্ত। তাদের প্রতি মুসলিম সমাজের সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসার এবং সহানুভূতি প্রদর্শনের এটাই উপযুক্ত সময়। কেননা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে ইসলাম গ্রহণের যে নজির তারা স্থাপন করেছেন, ভারতে ইসলাম প্রচারের অতীতের দৃষ্টান্ত পুনরাবৃত্তি করেছেন। এ জন্য তারা মুসলমানদের পক্ষ হতে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
মজার ব্যাপার এই যে, যখন বিজয়ীবেশে ভারতে মুসলমানদের আগমন ঘটে এবং তাদের সাথে উল্লেখিত ‘অচ্ছুৎদের’ যোগাযোগ, মেলামেশা ঘটে তখন হিন্দু, মুফতী, পন্ডিতগণ তাদেরকে ‘অচ্ছুৎ’ ‘ম্লেচ্ছ’ ভাবতে থাকেন। ওরা মুসলমানদের অধীনস্ত হয়ে বাস করতে থাকেন, অনেকে হয়ে যান খোশামোদী এবং বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে পদ মর্যাদা লাভ করে এবং বিস্তর ‘লাখেরাজ’ (নিস্কর) সম্পত্তি লাভ করেন। কিন্তু এসব সত্তে¡ও তারা মুসলমানদের কেবল ‘অচ্ছুৎ’ ই মনে করেননি, ‘ম্লেচ্ছ’ খেতাবও দিয়েছেন।
দুই. যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী ও ভাষাতাত্ত্বিক অধ্যাপক শেলডন পোলক বলেছেন, ‘মুসলমান শাসকগণ জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করালে ভারতে একজনও হিন্দু থাকত না।’ কারণ হিসেবে মুসলমান শাসকদের প্রায় ১২০০ বছর শাসন করার ইতিহাস তুলে ধরেছেন। একজন অমুসলিম বুদ্ধিজীবী ও ভাষাতাত্ত্বিকের এ সত্য ভাষণের জন্য প্রথমেই তাকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। ভারতে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে আরো যারা এরূপ সত্য প্রকাশ করতে সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে থাকেন, তারা সবাই মুসলমানদের প্রশংসা ও ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। এরূপ প্রশংসনীয় সত্য উপলব্ধি যাদের নেই, তারা বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
শেলডন পোলক কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ের অধ্যাপক। তিনি নিজেকে ‘ইহুদি ব্রাহ্মণ’ বলে পরিচয় দেন। সংস্কৃতে পারদর্শী এই অধ্যাপক হার্বার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মূর্তি ক্ল্যাসিকাল লাইব্রেরি ইন্ডিয়া প্রকল্পের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। সম্প্রতি রাজস্থানের সাহিত্য উৎসবে এসেছিলেন তিনি, তাকে প্রশ্ন করা হয় যে, অনেকে বলেন, ‘ইসলামি আক্রমণের পর সংস্কৃতের পতন হল, শাসকের দাপটে সবাই উর্দু, ফার্সি শিখতে ছুটলো।’ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাজে কথা’। শেলডনের পরিচয়ে দেখা গেছে, তিনি ইহুদি ব্রাহ্মণ। তিনি উত্তম রূপেই অবগত আছেন যে, ইসলামের প্রবর্তকের সাথে এবং ইসলামের সাথে ইহুদিরা কী নির্মম আচরণ করেছিল এবং আজো ইসলামের বিরোধিতায় তারাই শীর্ষ স্থান অধিকার করে রেখেছে। এহেন ইসলামের বড় দুশমনও বলেনি যে, ইসলাম জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করেছে, এমনকি মহানবী (সা.) এর যুগে বেশ কিছু ইহুদি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং ইসলাম প্রচারে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানও রয়েছে। পরবর্তীতে ইসলামের উদারতা, ন্যায়বিচার এবং মানবিক গুণাবলীতে মুগ্ধ হয়ে হাজার হাজার ইহুদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। মুসলিম সুলতান শাসকগণ কোনো প্রকারের বল প্রয়োগ করেননি, এমনকি খেলাফতে আব্বাসীয় যুগে বহু ইহুদি বহু গুরুত্বপূর্ণ রাজকীয় পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, অবশ্য এ বিষয়ে অধ্যাপক শেলডন কোনো মন্তব্য করেননি।
যেখানে অভিজাতশ্রেণি যাদের দৈনন্দিন সেবাদাস হিসেবে ব্যবহার করত, মুসলমান সুলতান-শাসকগণ তাদের মর্যাদার আসন প্রদান করেন, তাদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন, এমনকি হিন্দু রাজা-প্রজারাও স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন, ভারতের ইতিহাসে এরূপ অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। মুসলমান সুলতান শাসকদের গুরুত্বপূর্ণ দিকটিকে বিকৃত করার প্রয়াস যুগে যুগে লক্ষ করা গিয়েছে। আর সে অপপ্রচারের ধারা কখনো থেমে নেই। কেবল মুসলমান সুলতান শাসক নয়, অজস্র আওলিয়া-মাশায়েখের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, তাদের তবলীগ, তলকীন ও এরশাদ ওয়াজে মুগ্ধ হয়ে ভারতে দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ করেছে, তাদের মুরীদ হয়েছে এবং তাদের আস্তানা, খানকাহের লংগরখানা হতে খাদ্য গ্রহণ করেছে। এ ব্যাপারে হজরত খাজা আজমিরী (রহ.) ও তার খলিফাগণ এবং তাদের খলিফাগণের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।
উপমহাদেশে প্রসিদ্ধ তরিকা চতুষ্টয় ছাড়াও আরো বিভিন্ন সঠিক তরিকার প্রবর্তক অনুসারীদের প্রচার পদ্ধতির ফলে বিধর্মী, বিভ্রান্তরা ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে মুসলমান হয়েছে, তাদের অনেকের কারামত বা অলৌকিক ক্ষমতা দেখে অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেছে, তাদেরকে যুদ্ধ বা সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে হয়নি, তবে ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে যারা শত্রুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন সেখানেও তাদের কারামতের ভ‚মিকা ছিল শক্তিশালী। এ ক্ষেত্রে সিলেটের হজরত শাহজালাল (রহ.) এর ঘটনা উল্লেখযোগ্য। ইতিহাসের বাস্তব সত্য এই যে, বহিরাগত আওলিয়ায়ে কেরাম এ দেশে কোনো যুদ্ধাস্ত্র সঙ্গে করে আনেননি, তারা এসেছিলেন বুকে তওহীদের বাণী ধারণ করে এবং কোফরিস্থানে কোরআন ও হাদীসের অমিয় বাণী ছড়িয়ে দিতে তারা পদে পদে মোশরেক, পৌত্তলিক বৃন্দের কঠোর প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছেন। ইসলামের সাম্য, মানবতাবোধ, উদারতা, ন্যায়নীতি, সুবিচার, তাদের অলৌকিক ক্ষমতা প্রভৃতি বৃহৎ গুণ এদেশে ইসলাম প্রচারের নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।
মাশায়েখ ও সুফিয়ায়ে কেরামের তবলীগ প্রচারের পদ্ধতিতে বিভিন্নতা লক্ষ্য করা গেলেও তাঁরা শরীয়তের ওপর কঠোরভাবে আমল করতেন এবং ইসলামী শরীয়তের অন্যতম দিক মানবতার সেবা যাকে বলা হয় ‘খেদমতে খালক’। উপমহাদেশে আওলিয়া কেরামের আগমন ছিল দুর্গত, বঞ্চিত, নির্যাতিত ও দলিত-মথিত মানবতার জন্য সৌভাগ্যের প্রতীক। পৌত্তলিকতা কবলিত, বহুত্ববাদী সমাজে আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করা ছিল সুকঠিন কাজ। তখনকার প্রতিকূল পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী সুফিয়ায়ে কেরাম পথভ্রষ্ট গোমরা জাতিগুলোর মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যের আলোকে তাদের প্রচার পদ্ধতি ইসলামী শরীয়তভিত্তিক নির্ধারণ করেন। এ পর্যায়ে বিশেষভাবে চিশতিয়া তরিকার প্রভাবের কথা উদাহরণ হিসেবে পেশ করা যায়। এতে কথার চেয়ে কাজের অর্থাৎ আমলের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, যার সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করে গুমরাহ জাতিগুলো আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল। সুফিয়ায়ে কেরাম নিজেদের আমল দ্বারা গুমরাহ জাতিগুলোকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করেছেন। তাই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, জোরপূর্বক বা বল প্রয়োগ করে তারা ইসলাম প্রচার করেননি, বরং দলে দলে হাজার হাজার লোক তাদের উত্তম চরিত্রগুণে মুগ্ধ হয়ে মুসলমান হয়েছিল।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।