পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও ধর্ষণ শেষে হত্যার ঘটনা ক্রমশ: গ্রাস করছে আমাদের সমাজকে। নিত্যই ব্যভিচার ও ধর্ষণকামিতার ঘটনা ঘটছে , ঘটছে হত্যার ঘটনা। রোধ হচ্ছে না। এক ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়িয়ে দিয়েছে। ধর্ষণের সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। দেশে প্রতি ২১ মিনিটে একটি করে ধর্ষণকান্ড ঘটে। প্রকৃত সংখ্যাটা সম্ভবত এর চাইতে বহু গুণ, কেননা ৯০ শতাংশ ধর্ষণই লোকলজ্জায় কিংবা পরিবারের অমতে গোচরে আনা হয় না। এই বিপুল পরিমাণ ধর্ষণের যারা শিকার, তাদের ১৮ শতাংশই নাবালিকা, অনেকেই চার-ছয় বছরের শিশু। সর্বোপরি নথিভুক্ত ধর্ষণকান্ডগুলির ৯৮ শতাংশ ক্ষেত্রেই ধর্ষকরা ধর্ষিতাদের আত্মীয়, স্বজন, নিকট প্রতিবেশী বা পূর্বপরিচিত। আর এখানেই সামাজিক ভরসা ও বিশ্বাসের সনাতন, সযত্নে লালিত ধারণাগুলি ভাঙ্গে পড়ার প্রসঙ্গটি উঠে পড়ে। দেহরক্ষীর হাতে নিহত হওয়ার মধ্যে যেমন বিশ্বাসহানি রযেছে, তেমনই বিশ্বাসভঙ্গের ব্যাপার আছে আত্মজনের হাতে যৌননিগ্রহের ঘটনায়ও। যাকে রক্ষা করার কাজে নিযুক্ত, তাকেই হত্যা করা যেমন বিশ্বাসঘাতকতা, আত্মীয়তা কিংবা পূর্বপরিচয়ের সূত্রে অর্জিত বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ধর্ষণ করাও সমান বিশ্বাসঘাতকতা। শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে ধর্ষণের পরিণতি এক ও অভিন্ন হলেও এ ধরনের ধর্ষণকে ইদানীং ‘পারিবারিক হিংসা’র পর্যায়ভুক্ত করা হয়। পরিবারের ভিতরে পুরুষ আত্মীয় ও গুরুজনদের দ্বারা বা পরিবারের বাহিরে নিকট প্রতিবেশীদের দ্বারা যৌননিগ্রহের শিকার হওয়া মহিলারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের দুর্গতির কথা মুখ ফুটে বলতে পারেন না, পুলিশের কাছে অভিযোগ করা তো দূরের কথা। কারণ পরিবারই সেই নিগ্রহ-লাঞ্ছনার কথা চেপে যায়, লাঞ্ছিতাকে পরিবারের সামাজিক মর্যাদাহানির ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখে, প্রায়শ তাাদের দূরে কোথাও পঠিয়ে দেয়। তাতে পরিবারের ‘মর্যাদা’ অক্ষত থাকে, ধর্ষক পুরুষ আত্মীয়ও নিষ্কলঙ্ক থাকে যায়।
ধর্ষিতাকে নিয়ে আজে বাজে কথাও রটনা করা হয়। ধর্ষকদের পক্ষ নেওয়া ক্ষমতাধরগণ ধর্ষিতা নারীর পোশাক-আশাক, ‘স্বভাব-চরিত্র’, ‘একাকী’, ‘অসময়ে’ পথে চলার দুঃসাহস নিয়ে কটাক্ষ করে কার্যত ধর্ষকদের অপরাধ লঘু করতে দেখা যায়। তখন তাতে ধর্ষিতা নারীর মর্যাদা ও সম্মান ভূলুণ্ঠিতই হয় বটে! পুলিশ যখন ধর্ষণকারী দুর্বৃত্তের সাথে ধর্ষিতা মহিলার ‘আগে হতেই সম্পর্ক থাকা’র অজুহাত দেয়, তখনও দুষ্কৃতি-দমন অপেক্ষা তার শিকারদের দোষ ধরার কদর্য চেষ্টা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এটা ধর্ষকদের প্রশ্রয় দেয়ার শামিল।
এ কারণেই ধর্ষণ বাড়ছে। গত ২০১৯ সালে ধর্ষণ বেড়েছে দ্বিগুণ। ২০১৯ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৪১৩ জন নারী। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৩২ জন। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ যা ভয়াবহ। এটা কিন্তু সরকারি হিসাব। বেসরকারি হিসাব এর চাইতে বহুগুণ বেশি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ধর্ষণ তো বেড়েছেই। বেড়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতাও। কঠোর আইন, প্রচার ও উচ্চ আদালতের নানা নির্দেশনার পরও নারীর প্রতি সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতা কমানো যাচ্ছে না। ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে কম। যাদের আইনের আওতায় আনা হয় তাদের (ধর্ষণকারী) কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না। আইন আছে কিন্তু তার প্রয়োগ নেই।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে তবে সে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হবে। একই আইনের ৯ (২) ধারায় আছে, ‘ধর্ষণ বা ধর্ষণ পরবর্তী কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে ধর্ষকের মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড হবে।’ একই সঙ্গে জরিমানার কথাও আছে। সর্বনিম্ন জরিমানা ১ লাখ টাকা। ৯(৩) ধারায় আছে, ‘যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং উক্ত ধর্ষণের ফলে কোনো নারী বা শিশু মারা যায় তাহলে প্রত্যেকের যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা মৃত্যুদন্ড, কমপক্ষে ১ লাখ টাকা জরিমানা হবে’। মহিলা আইনজীবী সমিতির এক জরিপে জানা যায়, নানা কারণে ধর্ষণ মামলার ৯০ শতাংশ আসামী খালাস পেয়ে থাকে। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে ‘প্রশাসনে দলীয় লোক থাকার কারণে এসব ঘটনার অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যাওয়ার আরেক কারণ। এছাড়া ফৌজদারি আইনের দুর্বলতার কারণে অপরাধীর উপযুক্ত শাস্তি হয় না।
সব কিছুতেই আজ দলবাজি চলে। আর তাতে কিছু মানুষ এ ধরনের অপরাধ করার সাহস পাচ্ছেন। যৌন নির্যাতনের সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক আছে। নারীর ওপর বলপ্রয়োগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটতে পারে। কখনও দেখা যায়, সামাজিকভাবে কোনঠাসা কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ার আশায় অলীক কল্পনা করতে থাকে। কিন্তু কাক্সিক্ষত সমাধান না পেয়ে, বলপ্রয়োগের পথ বেছে নেয়।
যাঁরা উচ্চবিত্ত, সমাজের ওপর তলার মানুষ, এই জাতীয় বিপদ তাঁদের ছুঁতে পারে কম। এদেশে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে নিন্মবিত্ত আর মধ্যবিত্তরাই বেশি। যাঁরা নিম্নবর্গের বাসিন্দা, তাঁরা সম্ভবত এখনও ধর্ষণকে স্বাভাবিক জ্ঞান করেন। ভয়ে চুপ থাকেন। ইজ্জত হারিয়েও মুখ খোলেন না। তারা জানেন আইন আদালত করলে তাদের ভাগ্যে উল্টো বিপত্তি ঘটবে। অন্যায় করে অপরাধিরা এভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে বলেই দেশে ধর্ষন বেড়ে গেছে। বর্তমানে আমরা ঈমানী শক্তি হারিয়েছি। দেশপ্রেম, সততা, নৈতিক মূল্যবোধ ইত্যাদি হারিয়েছি। তাই সমাজ থেকে সুখ, শান্তি বা আনন্দ হারিয়ে যাচ্ছে। নিঃশর্ত ভালবাসা বা ভক্তি কমে যাওয়ার কারণে আমাদের গঠন মূলক মনোভাব বা সৃষ্টিশীলতা নষ্ট হচ্ছে।
ধর্ষণের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে হলে কেবল আইনের কঠোর প্রয়োগও কোনো কাজ হবে না। এর জন্য প্রয়োজন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যার যার পারিবারিক বলয়ে ধর্মানুশীলনে একনিষ্ঠতা, পোশাকের শালীনতা, অশ্লীল সংস্কৃতিচর্চার পরিবর্তে শিক্ষণীয় বিনোদনমূলক ও শালীন সংস্কৃতি চর্চার প্রচলন নিশ্চিতকরণ। নারীকে মর্যাদার আসনে বসাতে হবে। পর নারীকে কখনো মা, কখনো বোন, কখনোবা মেয়ে ভাবতে হবে। তাদের উপর লুলুপ দৃষ্টি নয়; মায়ামমতার দৃষ্টি দিতে হবে। তবেই ধর্ষন কমে আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।