Inqilab Logo

শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

ধর্ষণের মহামারী রোখার উপায় কী

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ২৮ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০২ এএম

ধর্ষণ ও গণধর্ষণ মহামারীতে রূপ নিয়েছে। দেশব্যাপী চিন্তাশীল ব্যক্তিরা এটাকে এখন জাতীয় সমস্যা বলে মনে করছেন। সরকার কঠিন কঠিন আইন করছে। কিন্তু ধর্ষণ রোধ হচ্ছে না। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদে ধর্ষকদের ক্রসফায়ারে দেয়ার দাবি উঠেছে, যদিও হাইকোর্ট তা সমর্থন করেনি। যাদের দ্বারা সরকার আইন প্রয়োগ করে অর্থাৎ পুলিশ বাহিনীর সদস্যের মধ্যে কেউ কেউ ধর্ষণে অভিযুক্ত হচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানের উপায় বের করতে না পারলে কোনো নারীই নিরাপদ থাকবে না। একজন ঋণগ্রস্ত পিতা যখন ঋণদাতার হাতে তার মেয়েকে উপভোগের জন্য তুলে দেয়, তখন সে অবস্থা বা পরিস্থিতিকে কী বিশেষণে জাতি ও সমাজ বিবেচনা করবে? ১৬ জানুয়ারি ২০২০ জাতীয় পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, যা এখানে প্রকাশ করা হলো।

‘রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে এক ব্যক্তি মহাজনের কাছ থেকে নেয়া টাকা শোধ করতে না পারায় নিজের কিশোরী মেয়েকে তার হাতে তুলে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। মহাজন মেয়েটিকে একাধিকবার ধর্ষণ করেছেন বলে জানা গেছে। ধর্ষণের শিকার ওই কিশোরীকে গত মঙ্গলবার রাতে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ভিকটিম তার বাবার সঙ্গে কামরাঙ্গীরচর এলাকায় থাকত। ওই লোক এক মুরগি ব্যবসায়ী মহাজনের দোকানে চাকরি করতেন এবং পাশাপাশি ভ্যান চালাতেন।’

অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রতিটি মানুষের অত্যন্ত প্রয়োজন। সরকার বা সরকারের মুখপাত্র দেশে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা ফলাও করে প্রচার করছে। কিন্তু দেশে নারীদের মধ্যে এখন পর্যন্ত কাউকে কাউকে দেহ বিক্রি করে অর্থনৈতিক চাহিদা মেটাতে হয়। একই কারণে অনেকে বিদেশে পাচার হচ্ছে। এর পরও কী সরকারের ভাষ্যমতে, গোটা জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে প্রকৃতপক্ষেই সমৃদ্ধ? একজন নারী যখন ধর্ষিত হয় তখন ধর্ষকের চেয়ে ধর্ষিতাকে কলঙ্কের বোঝা বেশিই বহন করতে হয়, (যদিও সমাজের তথাকথিত উপরতলায় বিষয়টি ভিন্নতর)। সমাজ ধর্ষিতাকে গ্রহণ করতে চায় না, তার বিয়ে করাও দুষ্কর হয়ে পড়ে। বিয়ে হলে হতে হয় স্বামী পরিত্যক্তা। ধর্ষিতা যখন প্রতিরোধ বা প্রতিশোধ নিতে চায় তখন সমাজ থেকে আশানুরূপ সমর্থন, সহযোগিতা বা সাড়া পায় না। রাষ্ট্রীয় বেতনভুক্ত কর্মচারী, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যারা ধর্ষিতার পক্ষে দাঁড়ানোর কথা তারাও ধর্ষিতাকে নিয়ে উপহাস করে। ফলে ধর্ষকের বিপক্ষে প্রতিরোধ সৃষ্টি করার মানসিক শক্তি ভুক্তভোগীরা হারিয়ে ফেলে।

ধর্ষণ বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে আকাশ সংস্কৃতি, ফেসবুকসহ বিভিন্ন মিডিয়ার অনেক অবদান রয়েছে। অন্য দিকে, রাষ্ট্র আকাশ সংস্কৃতি ও ফেসবুকের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। নারী জাতিকে ধর্ষণ থেকে রক্ষার সামাজিক অবস্থান সৃষ্টি করা, অভাবগ্রস্ত, ঋণগ্রস্ত, হতদরিদ্রদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানের জন্যই ইসলাম ধর্মে জাকাত প্রথার বিধান করা হয়েছে, যা প্রতিটি সচ্ছল মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক। জাকাতপ্রথা সামাজিক নিরাপত্তার একটি নিশ্চয়তা, সে নিশ্চয়তা কিভাবে প্রয়োগ করা যায়, এ নিয়ে রাষ্ট্রের বাস্তবমুখী একটি পদক্ষেপ থাকা দরকার, যা বর্তমানে নেই। ঋণের দায়ে মানুষের আত্মহত্যার কথা শোনা যায়, জীবিকার জন্য নিজ সন্তান বিক্রির কথাও নতুন কথা নয়। দেহ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করা পৃথিবীর আদি প্রথা। তবে ঋণের দায়ে নিজ কন্যাকে তুলে দেয়া, গণমানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অনিশ্চয়তার একটি বাস্তব চিত্র মাত্র, যা কোথাও প্রকাশ পায়, কোথাও পায় না। এক দিকে ধর্ষণ প্রতিরোধের জন্য কঠিন কঠিন আইন প্রণয়ন, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আকাশ সংস্কৃতির দৌরাত্ম্য সরকারের পরস্পরবিরোধী একটি পন্থা। উভয় পক্ষকে খুশি রেখে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা যায় না, এ ব্যাপারে সরকারের বোধোদয় হওয়া দরকার।

ধর্মের কথা উঠলেই বলা হয়, সা¤প্রদায়িকতা। ধর্মনিরপেক্ষতা আর ধর্মহীনতা এক কথা নয়। কিন্তু ধর্মহীনতাকেই একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী উৎসাহিত করে আসছে। মুক্তচিন্তার নামেও একশ্রেণীর ব্লগার ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে অবাধ অনাচারকে সমর্থন করছে। ধর্ষণের মহামারী নিয়ন্ত্রণে আনার প্রশ্নে এ বিষয়গুলো রাষ্ট্রযন্ত্রকে বিবেচনায় নিতে হবে। ধর্ষণের মহামারী প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, এ মর্মে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ একটি কমিশন গঠনের নির্দেশ দিয়ে কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়িত হলে সরকার শুধু আইন প্রণয়ন নির্ভর না হয়ে বাস্তবমুখী একটি কর্মপন্থা খুঁজে নেয়ার পথ পাবে, যদিও বিষয়টি সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। হাইকোর্টের নির্দেশনায় সব স্তরের প্রতিনিধি রাখার ওপর গুরুত্ব দেয়া হলেও (পত্রিকার ভাষ্যমতে) ধর্ম বিশারদদের রাখার নির্দেশনা নেই। আমি মনে করি, ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ধর্মের একটি ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। অন্য দিকে, ধর্মশিক্ষার সাথে যারা জড়িত তাদের মধ্যেও ধর্ষণের অভিযোগে অনেকে অভিযুক্ত হয়েছে। তার পরও ধর্ষণের মহামারী রোধে ধর্মীয় বিধানে যে শাস্তির কথা উল্লেখ রয়েছে তার প্রতি জনদৃষ্টি আকৃষ্ট হওয়ার ব্যবস্থা নেয়া একান্ত আবশ্যক। যে পরিবারে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয় সে পরিবারের সন্তানরা সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করে, ব্যতিক্রম কিছু হতে পারে, তবে তা নগণ্য বটে। পারিবারিক শৃঙ্খলা বোধ, অন্য দিকে কন্যাসন্তানদের শালীনতাপূর্ণ জীবনযাপন, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সমর্থনযোগ্য পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহার, ব্যবহারিক আচরণও মেয়েদের যৌন নির্যাতন থেকে রক্ষার একটি হাতিয়ার হতে পারে। কথিত আধুনিকতা সমাজ ও পারিবারিক জীবনে কতটুকু শান্তি এনে দিয়েছে, তা ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবে।

সামাজিক নিরাপত্তার অভাবের কারণেই নারী তার সতীত্ব রক্ষার জন্য কখনো আত্মহত্যা করে বা কখনো প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। কোনো কোনো নারী নিজেকে রক্ষার জন্য উপায়ন্তর না পেয়ে সতীত্ব রক্ষার জন্য প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। এ ধরনের একটি ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাধীন দ্বিতীয় অতিরিক্ত দায়রা আদালতে বিচারাধীন দায়রা মোকদ্দমা নং-১৩০/২০১৪ (বাঞ্ছারামপুর থানার ৬(১২)২০১২ মামলা ধারা-৩০২/২০১/৩৪ দ. বি.) মোকদ্দমায় ধর্ষকের হাত থেকে নিজের সতীত্ব রক্ষার জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া অতিরিক্ত জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফাতেমা ফেরদৌসের কাছে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬৪ ধারা মোতাবেক হেলেনা বেগম নামে এক গৃহবধূ একটি জবানবন্দী দিয়েছেন। তা এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো: ‘আমি হেলেনা, স্বামী-আফজালের সাথে ৮-৯ বছর আগে বিয়ে হয়েছিল। আমাদের দাম্পত্য জীবনে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে আছে। ভিকটিম শুক্কুর আলী, থানা-রূপগঞ্জ, গ্রাম-খাদুন, জেলা-নারায়ণগঞ্জ আমাকে ৮-৯ বছর যাবত চেনে, আমার বিয়ের দিন থেকেই তাকে চিনি। সে আমার শ্বশুরবাড়ির লোক। ভিকটিম শুক্কুর মেয়েদের কাছ থেকে টাকা পয়সা নিয়ে, মেয়েদের ইজ্জত নষ্ট করত। শুক্কুর বিবাহিত ছিল, তার ৩ ছেলে ও ১ মেয়ে। তার বউ খারাপ কাজে বাধা দিলে সে তার বউকে প্রচন্ড মারধর করত, সে আমাকে আমার স্বামীর অনুপস্থিতিতে শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দিত। আরো বলত, আমি যদি রাজি না হই তবে সে আমার স্বামীকে খুন করে ফেলবে। আমি সবসময় ঘরে তালা মেরে ঘুমাতাম তার ভয়ে। আমি আমার স্বামীকে শুক্কুরের কুপ্রস্তাবের কথা বলি। শুক্কুর প্রায়ই মদ খেয়ে বেশ্যা নারী নিয়ে আসত। এক দিনের জন্য শুক্কুর আলী আমাকে যৌন কাজে রাজি হতে বলে, আমি রাজি হই নাই, ফলে সে আমার স্বামীকে আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপায়। সে মোবাইলে তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করত বলত। আমি অস্বীকার করি। বিগত ০৭-১২-২০১২ ইং তারিখে আমাকে জোর করে মোবাইলে শারীরিক সম্পর্ক করতে বললে আমি অভিনয় করে রাজি হই। আমি তাকে নিয়ে মরিচ্যাবাতায় থেকে সোজা পশ্চিমে নদীর পাড়ে যাই। তার অন্ডকোষে আমার হাত লাগায়। তাকে নিয়ে সন্ধ্যায় হাঁটতে থাকি। আমার সাথে কেউ ছিল না। আমার স্বামীকে গাঙের পাড়ে থাকতে বলি। আমি তাকে গাঙের পাড়ের রাস্তায় শোয়াই, আমি ওড়না দিয়ে তার মুখ ঢেকে ফেলি। আমার সাথে থাকা চাকু দিয়ে তার অন্ডকোষ কেটে ফেলি। আমি আমার স্বামী আফজালসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ কেটে ফেলি। আমরা আগে তার মুখ চেপে ধরেছিলাম। ফলে সে কিছুই করতে পারে নাই। সে হাজার হাজার মেয়ে মানুষের ইজ্জত নষ্ট করেছে ও আমার ইজ্জত নষ্ট করতে চেয়েছে বলে আমি এ কাজ করেছি। আমি হেলেনা ও আমার স্বামী আফজাল শুধু ইজ্জত অর্থাৎ আমার ইজ্জত বাঁচানোর জন্য এ কাজ করেছি।’

ধর্ষকের হাত থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য যে ঝুঁকি হেলেনা নিলো তার সপক্ষে আইন, সমাজ, রাষ্ট্র, বিচারব্যবস্থা অথবা কেউ কি দাঁড়াবে? হেলেনা যদি ধর্ষকের বিরুদ্ধে বিচারপ্রার্থী হতো, তবে সমাজ কি ধর্ষকের প্রতিরোধ করত? তা না করে হেলেনা যদি নিজেকে ধর্ষকের কাছে সঁপে দিত, তবে তার পরিণতি কী হতে পারত? ধর্ষণের মহামারীর এ যুগে সচেতন সমাজের কাছে এ প্রশ্নগুলো পর্যালোচনার দাবি রাখে।
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী



 

Show all comments
  • jack ali ২৯ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:২৬ পিএম says : 0
    When we so called muslim rule our country By The Magnificent Rule of Allah... then all sort of crime will be uprooted...
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ধর্ষণ


আরও
আরও পড়ুন