শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
সা¤প্রদায়িকতা বা ঈড়সসঁহধষরংস হচ্ছে এক ধরণের মনোভাব। কোন ব্যাক্তির মনোভাবকে তখনই সা¤প্রদায়িক বলে আখ্যা দেয়া যায় যখন সে এক বিশেষ ধর্মীয় স¤প্রদায়ের পক্ষপাত হয়ে অন্য ধর্মীয় স¤প্রদায় বা তার অন্তর্ভূক্ত ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধাচারণ এবং ক্ষতি সাধন করতে বদ্ধ পরিকর থাকে।মোট কথা সা¤প্রদায়িকতা হচ্ছে স¤প্রদায় ভিত্তিক চিন্তা ভাবনা ও কর্মকান্ড।আমি যে স¤প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত সেটি বিশ্বে সবচেয়ে সেরা এবং আর সব স¤প্রদায় নিকৃষ্ট, এ ধারণায় বিশ্বাস স্থাপনই সা¤প্রদায়িকতা।
ট.ঈ.গড়হফধষ তাঁর উরপঃরড়হধৎু ড়ভ চঁনষরপ অফসরহরংঃৎধঃরড়হ গ্রন্থে বলেছেন, ‘সা¤প্রদায়িকতা বলতে আমরা বুঝি, ধর্মীয় স¤প্রদায়ের একে অপরের বিরোধীতা।’ তাই বলা যায় যে, সা¤প্রদায়িকতা হলো কোন বিশেষ স¤প্রদায়ের প্রতি বিরাগভাজন হয়ে কারও অধিকার সুসংহত না করা এবং অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে কোন বিশেষ স¤প্রদায়ের উপরে কোন বিশেষ স¤প্রদায়কে প্রাধান্য দান।’
বহুত্ববাদী সমাজ ব্যাবস্থায় একটি জন স¤প্রদায় নিজেদের অভিন্ন পরিচয় অভিব্যাক্তির জন্য রাজনীতির ক্ষেত্রে দৃঢ়তার সঙ্গে নিজেদের জাহির করতে উদ্যোগী হয়, এই উদ্যোগী হওয়াটাই হল সা¤প্রদায়িকতা।
সাহিত্যে সা¤প্রদায়িকতা বলতে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুলাহ বলেছেন: ‘সাহিত্যে সা¤প্রদায়িকতা বলতে আমি বুঝি সাহিত্যের ভিতর দিয়ে অন্য স¤প্রদায় বা ধর্ম বিশেষের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালান, কোন জাতির ঐতিহাসিক চরিত্রকে বা কোনও ধর্মালম্বীর সম্মানিত পুরুষদের হীন বা বিকৃত করা। দেশের সা¤প্রদায়িক বিভেদের মুলে এই সা¤প্রদায়িক সাহিত্য। দুঃখের সঙ্গে আমি বলতে বাধ্য যে,বাংলার হিন্দু লেখকেরা এর সূত্রপাত করেন।তারপর মুসলিম লেখকরা গালির বদলে গালি শুরু করেন। এর জন্য অবশ্য ব্রিটিশের ভেদনীতি ছিল অনেকটাই দায়ী।’ বাংলা সাহিত্যের হিন্দু ঐতিহাসিকগণ, দু’একজন ব্যতিক্রম ব্যতিত, প্রধানত মুসলমান সাহিত্যিকদের উপেক্ষা করতেই অভ্যস্থ। বিখ্যাত ঐতিহাসিক জ.ঈ.গড়লঁসফবৎ তাঁর ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঋৎববফড়স গড়াবসবহঃ রহ ওহফরধ গ্রন্থে বলেছেন : ইসলামের উদার ধর্মনীতি বর্ণাশ্রম-পীড়িত হিন্দু জনসাধারণ; বিশেষত নিম্নবর্ণের হিন্দুগণ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেন। এর ফলে,উ’চ শ্রেæীর হিন্দুরা সবসময় মুসলমানদের নিম্ন বর্ণের হিন্দুর সমান জ্ঞান করতেন।’
বাংলা কাহিনী কাব্যে সা¤প্রদায়িকতার বিষ বাষ্প প্রথম বপন করেন কবি রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায়।তার ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ কাব্যটি পুরোই উগ্রতার দোষে দুষ্ট।মুসলিম সুলতান আলাউদ্দীন হুসেন শাহকে মারাত্মক নীচুভাবে উপস্থাপনের নোংরা প্রয়াস তার কাব্যের প্রতিটি চরণে। রঙ্গলাল তার কাব্যের কাহিনী গ্রহণ করেছেন কর্নেল টডের ‘রাজস্থান’গ্রন্থ থেকে। আর কর্নেল টড ছিলেন মুসলিম বিদ্ধেষী হীন চরিত্রের এক ইংরেজ। ঐতিহাসিক কালিকারন্জন কানুনগোর দৃষ্টিতে টডের ‘রাজস্থান’ কাহিনী ‘ঃড়ড় ষবমবহফধৎু ভড়ৎ যরংঃড়ৎরপধষ ঢ়ঁৎঢ়ড়ংবং.’
বাংলা কাব্যে দস্যু শিবাজীকে নিয়ে অনেক কাহিনী কাব্য,কবিতা রচিত হয়েছে।মোগল সম্রাট আওরেঙ্গজেবের সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা প্রচারণারর জন্য দস্যু শিবাজীকে নায়ক হিসেবে প্রতিষ্টিত করতে অনেকেই কাব্য লেখেন। এর মধ্যে সা¤প্রদায়িকতার উগ্রতায় পরিপূর্ণ যোগিন্দ্রনাথ বসুর ‘শিবাজী’ গ্রন্থটি। যে হিংগ্র দস্যুর ভয় দেখিয়ে বাংলার শিশুদের ঘুম পাড়ানো হত সেই মারাঠা দস্যু শিবাজীকে এদেশের হিন্দু কবি, সাহিত্যিকরা নায়ক হিসেবে উপস্থাপনের জন্য প্রানান্ত চেষ্টা চালায়। দস্যু শিবাজীকে প্রথম আলোচনায় আনেন উগ্রপন্থী মারাঠী কংগ্রেস নেতা বাল গঙ্গাধর তিলক।তিনি তার মারাঠী পত্রিকার মাধ্যমে মিথ্যা গল্প উপস্থাপন করে বর্বর শিবাজীকে নায়ক বানাতে হীন প্রচেষ্টা শুরু করেন। উগ্র হিন্দুত্ববাদের শিখা প্রজ্বলন করতে ১৮৯৫ সালে ‘শিবাজী উৎসব’ চালু করেন। তিলকের শিবাজী উৎসবে অনুপ্রানিত হয়ে, ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গ-বিভাগকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে উগ্র হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন শুরু করেন। এমন কি শিবাজী উৎসবে অনুপ্রানিত হয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ‘শিবাজী উৎসব’ কবিতা ছাড়াও ‘প্রতিনিধি’, ‘বন্দীবীর’, ‘মানী’, ‘শেষ শিক্ষা’, ‘হোরী খেলা’, ‘বিচারক’ ইত্যাদি মারাঠা ও শিখ জাগরণ বিষয়ক কবিতা রচনা করেন।
যুগ সন্ধিক্ষণের কবি ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত সা¤প্রদায়িকতা বিস্তারে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে কাজ করেন। তার প্রকাশিত বাংলা ভাষায় প্রথম প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা ‘সংবাদ প্রভাকরের’ মাধ্যমে তিনি এই কাজটি করেন। ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত তার বিভিন্ন কবিতাতেও মুসলমানদের সম্পর্কে বাজে মন্তব্য ও মিথ্যা অপপ্রচার অবতারণা করেন।তিনি মুসলমানদের বিদেশী, অবাঙ্গালী ও অভারতীয় চিন্তা করতেন। মুসলমানদের খারাপ ভাবে উপস্থাপনের জন্য যবন, ¤েøচ্ছ প্রভৃতি গালি বাংলা কবিতায় তিনিই প্রথম প্রয়োগ করেন। যেমন:
হিন্দু ম্লে’ছ যবনাদি যত জাতি আছে।
এ যবন প্রিয়তম সকলের কাছে।।
ভূমিতলে না হইলে যবনের চারা।
যবনের দেশে নারে প্রানে যেত মারা।।
সিপাহী বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোন বলে গন্য করা হয়। কিন্তু ১৮৫৭ সালের এই সংগ্রামকেও ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত মুসলিম যবনদের সংগ্রাম বলে বিশ্বাস করতেন।তিনি ‘সংবাদ প্রভাকরের’ মাধ্যমে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লিখনি লিখে ইংরেজ সরকারের চাটুকারিতা করেছেন। যেমন :
চিরকাল হয় যেন,ব্রিটিশের জয়।
ব্রিটিশের রাজলক্ষী, স্থির যেন রয়।।
সিপাহী বিদ্রোহে যখন ভারতবাসী জীবন বাজি রেখে ইংরেজের বিরুদ্ধে অগ্র ধারন করছে স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার জন্য,তখন রাজভক্ত ঈশ্বর গুপ্ত ইংরেজের তোষামোদে কাব্য সাধনা করে রাজভক্তির প্রমান দিতে মরিয়া।এর নমুনা:
ভারতের প্রিয় পাত্র হিন্দু সমুদয়।
মুক্ত মুখে বল সবে ব্রিটিশের জয়।।
কবি নবীন চন্দ্র সেন মুসলমানদের ভিনদেশী, যবন, পামর প্রভৃতি শব্দে চিহ্নিত করেছেন। তিনি মনে করেন মুসলিম শাসনামলে অশেষ যন্ত্রণা ভোগার পর বাঙ্গালী হিন্দু সমাদরের সঙ্গে ইংরেজদের আহŸান করেছিল।এক ঐতিহাসিক সত্যকে নবীন চন্দ্র সেন তুলে ধরলেন তার ‘ মহারানীর দ্বিতীয় পুত্র ডিউক অব এডিনবরার প্রতি’ কবিতার মাধ্যমে।যুবরাজকে অভ্যর্থনা জানাতে গিয়ে তিনি লিখেছেন:
নিরাশ্রয় অনাথিনী,যবনের করে/সহি কত শত বর্ষ অশেষ যন্ত্রনা/অবশেষে তোমাদের ডাকি সমাদরে/লইনু আশ্রয় যেন অনাথা ললনা।/সে অবধি রহিয়াছি অধীনীর মত/এই রুপে শত বর্ষ হইয়াছে গত।
হিন্দু পূনর্জাগরণবাদের উদগাতা বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার রচিত গদ্য আনন্দমঠ (১৮৮২),রাজসিংহ(১৮৮২) প্রভৃতি উপন্যাসে মুসলিম চরিত্র প্রকাশে যে বিদ্বেষ তৎপরতা দেখিয়েছেন তা বাংলা সাহিত্যের জন্য কলঙ্কজনজ। যে ‘বন্দে মাতরম’ সঙ্গীত হিন্দু- পূনর্জাগরণের মূলমন্ত্র, ‘আনন্দমঠ ‘ উপন্যাসে মূলত তা মুসলিম নিধনের উদ্দীপন গীতি।তিনি তার রচিত গদ্যের ন্যায় পদ্যে ও হিন্দু-জাতীয়তাবাদী চিন্তার প্রকাশ করতে গিয়ে মুসলিম প্রসঙ্গে মিথ্যা,কাল্পনিক কু মনোভাব প্রকাশ করেন। বঙ্কিমের১৮৭৮ সালে প্রকাশিত ‘কবিতা পুস্তক’ কাব্যের দুটি কবিতা হল ‘সংযুক্তা’ ও ‘আকবর শাহের খোশরোজ’। দুটি কবিতার কাহিনীই গ্রহন করা হয়েছে মুসলিম বিদ্বেষী টডের ‘রাজস্থান’ গ্রন্থ থেকে। ‘সংযুক্তা’ কবিতায় বঙ্কিম মুসলমানদের পামর,বানর প্রভৃতি হীন ভাষায় গালিগালাজ করেন।যেমন:
আসে আসুক না পাঠান পামর
আসে আসুক না আরবী বানর
আসে আসুক না নর বা অমর
কার সাধ্য তব শক্তি সয়।
হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে রবীন্দ্র মানসের পরিচয় পাওয়া যায় বঙ্গভঙ্গ ও তার পরবর্তী সময়ের রচিত কবিতা, প্রবন্ধ ও বক্তৃতায়।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গের ঘোর বিরোধী ছিলেন। কারন বঙ্গভঙ্গের ফলে তার কায়েমী স্বার্থ জমিদারীর সিংহভাগ পূর্ব বাংলায় পড়ে যায়। (অসমাপ্ত)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।