Inqilab Logo

শনিবার ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ২৯ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

ব্যাংকের কল্যাণমূলক ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৭ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০৫ এএম

সরকার ব্যাংকের পক্ষে থাকবে, না কি জনগণের সঙ্গে থাকবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। ব্যাংক-মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) এবং ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সঙ্গে এক বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আগামী এপ্রিল থেকে সব ব্যাংক ঋণে ৯ শতাংশ সুদ কার্যকর হবে। আর আমানতের বিপরীতে ব্যাংকগুলো কাউকে ৬ শতাংশের বেশি সুদ দিতে পারবে না। অর্থমন্ত্রীর এই ঘোষণা, যার মধ্যে সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিফলন রয়েছে, আমানতকারীদের জন্য দুঃসংবাদ বয়ে এনেছে। বিভিন্ন মেয়াদে যারা ব্যাংকে আমানত রাখেন এবং এই আমানত থেকে প্রাপ্ত মুনাফায় জীবনযাত্রা নির্বাহ করেন, তাদের এখন কঠিন দুঃসময়ের মধ্যে পড়তে হবে। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী, প্রবাসীর আত্মজন, স্বল্পপুঁজির অধিকারী, বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে অনভিজ্ঞ বা অক্ষম ব্যক্তি বিশেষভাবে ব্যাংকে আমানত রাখেন। কেউ সন্তানের লেখাপড়া বা বিয়েশাদির জন্যও আমানত রাখেন। ব্যাংকের বাইরেও বিপুল সংখ্যক মানুষ বিভিন্ন সঞ্চয়পত্রে অর্থ বিনিয়োগ করে মুনাফার অর্থে চলেন। চলতি বাজেটে ৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে উৎসে ১০ শতাংশ কর কাটার যে বিধান করা হয়েছে, তাতে সঞ্চয়পত্র বিক্রী তিন ভাগের এক ভাগ কমে গেছে। সঞ্চয়পত্রের মুনাফা যাদের জীবন চলার একমাত্র অবলম্বন, তারা বড় রকমের বিপাকে পড়েছে। তারা বিনিয়োগ কমিয়েছে নিতান্তই বাধ্য হয়ে। ব্যাংকের বিভিন্ন মেয়াদী আমানতে ৬ শতাংশ সুদহার কার্যকর হলে আমানতকারীরা অনীহ ও নিরূৎসাহিত হয়ে পড়বে এবং তার ফল হিসাবে আমানত কমে যাবে। এতে সঙ্গতকারণে একটা বড় সমস্যায় পড়বে গোটা ব্যাংকখ্যাত। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত আমানতে ১০-১২ শতাংশ হারে মুনাফা পাওয়া যেতো। এই ক’বছরে তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। এই সময়ে বাড়িভাড়া, পণ্যমূল্য, সেবামূল্য ইত্যাদিও বেড়েছে। সব মিলে জীবনযাত্রার ব্যয় অন্তত দ্বিগুণ হয়েছে, অথচ আয় নেমে এসেছে অর্ধেকে। এমতাবস্থায়, আমানতের মুনাফানির্ভর লাখ লাখ পরিবার কোথায় যাবে?

ব্যাংকের অর্থের উৎস আমানত। ব্যাংকে মানুষ যে আমানত রাখে, তাই বিনিয়োগ করে ব্যাংক আয় করে। আয়ের একাংশ ব্যাংক আমানতাকারীদের দেয়, অপরাংশ তার মুনাফা, যা দিয়ে পরিচালনব্যয় নির্বাহ ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদান ইত্যাদি হয়। আমানতে নেতিবাচক প্রভাব পড়লে ব্যাংকের আয়ে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। এটা স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করা যায়, ৬ শতাংশ মুনাফায় আমানত পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এমত ক্ষেত্রে ব্যাংকের আয়ই কমবে না, তার ঋণদান সক্ষমতা হ্রাস পাবে যার বিরূপ প্রতিক্রিয়া শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যে পড়বে। একজন বিশিষ্ট ব্যাংকার বলেছেন, ৬ শতাংশ সুদ নির্দিষ্ট করে দিলে গ্রাহকদের টাকার মান কমে যাবে। এতে ব্যাংকের আমানত কমে যাবে। তখন ঋণ দেয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাতে পুরো খাতে হযবরল পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। এক শ্রেণির ব্যাংকার অবশ্য মনে করেন, ৬ শতাংশ সুদের কারণে আমানতে খুব একটা প্রভাব পড়বে না। তাদের কেউ কেউ বিদেশের নজির টেনে বলতে চান, বিদেশে সুদহার অনেক কম। কথাটা হয়তো ঠিক; তবে সেখানকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা এক বরাবর নয়। বিদেশে ছোটবড় বিনিয়োগের নানা সুযোগ-সুবিধা আছে এবং সেসব বিনিয়োগে মুনাফার বিষয়টিও নিশ্চিত। তাছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রীয় পোষকতা সেখানে পর্যাপ্ত। আমাদের দেশে নিরাপদ বিনিয়োগের সুযোগ যথেষ্ট নয়। একারণেই অনেকে ব্যাংকে বিভিন্ন মেয়াদী আমানত রাখে এবং সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে। আগে শেয়ারবাজারেও বিনিয়োগের একটা সুযোগ ছিল। বারবার শেয়ারবাজার লুট হওয়ায় সে সুযোগ আর নেই। আমানতে ৬ শতাংশ মুনাফা নির্দিষ্ট হওয়ায় কার্যত আমানতকারীদের কিছুই থাকবে না। ব্যাংকঋণের সুদহার ৯ শতাংশ হওয়ায় এবং আমানতে টান পড়ায় ব্যাংকগুলো বিনিয়োগযোগ্য অর্থের সংকটে পড়বে। সে ক্ষেত্রে আমানতকারীদের মুনাফায় ব্যাংকগুলো হাত দিতে পারে লাভের ধারা ঠিক রাখার জন্য। দেখা যাবে, শেষ পর্যন্ত হয়তো আমানতকারীদের আর তেমন কিছুই থাকবে না।

শিল্প-বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যাংকের অনিবার্য ও অপরিহার্য ভূমিকার কথা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু আমাদের ব্যাংকিং খাত অনিয়ম-দুর্নীতি, অর্থলোপাট, অর্থ পাচার ইত্যাদি কারণে রীতিমত ডুবতে বসেছে। ব্যাংক সেবামূলক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হলেও এখন সেবা প্রায় বিদায় নিয়েছে, অবশিষ্ট রয়েছে কেবল বাণিজ্যিক বৈশিষ্ট্য। ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা খুব লাভজনক বলে সাব্যস্থ হয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে বহু ব্যাংক গড়ে উঠেছে যাদের মূল লক্ষ্য ‘ব্যাংক-ব্যবসা’ করে বিস্তর মুনাফা অর্জন করা। জনগণের আমানতের অর্থ মালিকদের নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধিতে একচেটিয়ানভাবে ব্যবহার করাও এসব ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অন্যতম লক্ষ্য। অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংক আমানতকারীদের মুনাফা দেয় নামকাওয়াস্তে। নজির হিসাবে ইস্টার্ন ব্যাংক ও ব্যাংক এশিয়ার কথা উল্লেখ করা যায়। প্রথমোক্ত ব্যাংক সঞ্চয়ের ওপর গ্রাহককে মুনাফা দেয় ২ থেকে ৩ শতাংশ এবং ৩ ও ৬ মাস মেয়াদী এফডিআর’র ক্ষেত্রে দেয় ৩ শতাংশ। দ্বিতীয়োক্ত ব্যাংক সঞ্চয়ের ওপর মুনাফা দেয় ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশ এবং ৩ ও ৬ মাস মেয়াদী এফডিআর’র ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলো আমানতের ক্ষেত্রে মুনাফা কম দিলেও ঋণ দিয়ে ইচ্ছামত সুদ আদায় করে নিচ্ছে। এই একদেশদর্শী নীতি ও শোষণমূলক ব্যবস্থা চলতে পারে না। গোটা ব্যাংকিং খাতকে সুনিয়ন্ত্রিত নিয়ম-শৃংখলার মধ্যে আনতে হবে, কল্যাণমূলক ও হিতৈষী ভূমিকায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সরকারকে এই অজনপ্রিয় উদ্যোগটি থেকে সরে আসতে হবে এবং সঠিক ও গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নিতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ব্যাংক

৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন