Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে উদ্বেগ

| প্রকাশের সময় : ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

গত সোমবার ভারতের লোকসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (সিএবি) পাশ করা হয়েছে। বুধবার রাজ্যসভাতেও তা পাস করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে দেশটির প্রেসিডেন্ট রামনাথ কোবিন্দ তাদে সই করেছেন। এই বিল পাশ করা নিয়ে ভারতজুড়ে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তীব্র প্রতিবাদ ও আন্দোলন শুরু করেছে। এর প্রতিবাদ প্রথমে শুরু হয় আসামে। সেখানে বিলটির প্রতিবাদে ব্যাপক বিক্ষোভ ও আন্দোলন দেখা দেয়। এর প্রতিক্রিয়া পড়েছে দিল্লী, কর্নাটক, কেরালা, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিবঙ্গসহ অন্যান্য রাজ্যে। আসামে কারফিউ জারি কারা হয়েছে। কারফিউ উপেক্ষা করেই মানুষ প্রতিবাদ করছে। সেখানে ২৬ প্লাটুন কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশের গুলিতে এ পর্যন্ত ৫ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছে। বলা যায়, ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের প্রতিবাদে দেশটির মানুষ উত্তাল হয়ে উঠেছে। তাদের প্রতিবাদের সাথে যুক্ত হয়েছে বিরোধী দল কংগ্রেসও। এদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী গত শুক্রবার স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে এই বিল কার্যকর হবে না। এখানে সব নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করবে। ভারত সরকার কর্তৃক এই বিল পাস করা নিয়ে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘ এক বিবৃতিতে বলেছে, এই আইন মুসলমানদের প্রতি বৈষম্যমূলক। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত দফতরের মুখপাত্র জেরেমি লরেন্স বলেছেন, ভারতের নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন চরিত্রগতভাবে বৈষম্যমূলক। এই আইন নিয়ে আমরা চিন্তিত। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র সংখ্যালঘু মুসলমানদের অধিকার রক্ষা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারতকে পরামর্শ দিয়েছেন, সংবিধান ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ মেনে মুসলমানদের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট হতে। অন্যদিকে ভারতের চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় জাপানের প্রধানমন্ত্রী আবে শিনজো তার ভারত সফর বাতিল করেছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ভারতের প্রতিবেশী পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আসা অমুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের নাগরিকত্ব দিতে লোকসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল দেশটির সরকার পাস করে।

যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো মনে করে ভারতে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) মাধ্যমে সংখ্যালঘু বিশেষ করে বাংলাভাষী মুসলমানদের দেশটি থেকে বের করে দিতে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস করা হয়েছে। এসব মুসলমানের যে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিতেই এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা আগেই টের পাওয়া গেছে। ভারত মুখে মুখে এনআরসি নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয় নেই এবং এটা তার আভ্যন্তরীণ বিষয় বলে আশ্বস্ত করলেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সেখানের বাংলাভাষীরা বাংলাদেশের দিকে ছুটে আসছে। ইতোমধ্যে অসংখ্য ভারতীয় বাংলাদেশ সীমান্তে এসে জড়ো হয়েছে। বিএসএফ-ও তাদের এনে জড়ো করছে। অনেককে বিজিবি গ্রেফতার করলেও অনেকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। গত মাসে ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর সীমান্ত থেকে তিন শতাধিক মানুষকে আটক করে বিজিবি। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে সংখ্যায় মানুষ আটক হচ্ছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মানুষ প্রতিদিন বাংলাদেশে ঢুকছে। ভারতের নাগরিকপঞ্জি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস করার উদ্দেশ্য যে ভারতের বাংলাভাষী মুসলমান নাগরিকদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া, তা এখন স্পষ্ট। কারণ এসব মুসলমানদের পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা ভারতের অন্য কোনো প্রতিবেশী দেশে যাওয়ার সুযোগ নেই। সেসব দেশে এসব মানুষকে পাঠানোর মতো সাহসও ভারতের নেই। ফলে বাংলাদেশই যে তার মূল টার্গেট তাতে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের দিকে এসব ভারতীয়দের ঢল দেখেই তা বোঝা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি যে রোহিঙ্গাদের মতোই বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি করবে, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। দুঃখের বিষয়, এ নিয়ে আমাদের সরকারের মধ্যে তেমন কোনো বিচলন বা উদ্বেগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সে নির্লিপ্ত হয়ে বসে আছে। টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করছে না। কয়েক দিন আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শুধু বলেছেন, আমাদের জন্য সমস্যা হয়, ভারত এমন কিছু করবে না। সরকারের অন্যরাও এমন আশাবাদ ব্যক্ত করছেন। তারা ভারতের ওপর আস্থা রেখে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে আছেন। অথচ ভারত সরকার ঠিকই বাঙালি মুসলমানদের বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়ার পরিস্থিতি ও পরিবেশ সৃষ্টি করে চলেছে। বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য সীমান্তে জড়ো হওয়া ভারতীয়দের চিত্রের দিকে তাকালেই তা বোঝা যাচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের বৃহত্তম বিরোধী দলও এ নিয়ে কোনো কথাবর্তা বলছে না। ভারত যে বাংলাদেশের দিকে ভয়াবহ ঝড়ের মতো বিপদ ঠেলে দিচ্ছে, তার কোনো প্রতিবাদ করছে না। প্রতিবেশী কর্তৃক এই বিরূপ আচরণে যে দেশর সাধারণ মানুষ ক্ষুদ্ধ, এ বিষয়টি তারা বুঝেও না বোঝার ভান করে বসে আছে। তারাও সরকারের মতো চুপ হয়ে বসে আছে। কেন ও কিসের আশায় তারা এর প্রতিবাদ করছে না? পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, দলটি দেশের মানুষের এই পালস্ বুঝতে পারছে না বলেই তারা দিন দিন জনগণের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অথচ এ সময় দেশের স্বার্থে তাদের সরব হওয়া উচিত।

ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের প্রতিক্রিয়া যে ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠবে, তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। আর এর শিকার যেমন দেশটির সংখ্যালঘু মুসলমানরা হবে, তেমনি এর প্রতিক্রিয়া থেকে বাংলাদেশও রেহাই পাবে না। এই বিলের অন্যতম লক্ষ্যের মধ্যে ভারত যে বাংলাভাষী মুসলমানদের বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিতে চাচ্ছে, তা আর বুঝতে বাকি থাকে না। সরকারসহ দলমত নির্বিশেষে এখনই যদি এর প্রতিবাদ করা না হয়, তবে বাংলাদেশকে এক কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। আমরা মনে করি, পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আগেই সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষতি হয়, ভারত এমন কিছু করবে না বলে সান্ত¦না নিয়ে বসে থাকলে হবে না। বিষয়টিকে ভারত তার আভ্যন্তরীণ বললেও এবং এ নিয়ে বাংলাদেশের চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই বললেও বাস্তব পরিস্থিতি তার সাক্ষ্য দিচ্ছে না। কৌশলে সে ভারতীয় মুসলমানদের বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তার স্বার্থে সে যে বাংলাদেশের প্রতি সহমর্মী হবে না, তা ইতোমধ্যে পরিস্কার হয়ে গেছে। আমরা মনে করি, সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সরকারের উচিত হবে এ ব্যাপারে দৃঢ় কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেয়া। প্রধান বিরোধী দলসহ অন্যান্য দলগুলোরও এ ব্যাপারে সোচ্চার হওয়া উচিত।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন