পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি, বহুভাষা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক রাষ্ট্র ভারত এখন হিন্দু রাষ্ট্রে পরিনত হয়েছে। মহাত্মা গান্ধী, জওহেরলাল নেহেরু, মাওলানা আজাদের মত ভারতীয় নেতারা বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক চেতনাকে ধারণ ক’রে যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা আজ চরম সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিনত করার সব আয়োজন শেষ করেছে বিজেপি সরকার। আর সেই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প প্রথমেই ভারতের অভ্যন্তরে এবং বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের মুসলমানদের আক্রান্ত করছে। আসামের এনআরসি বা নাগরিকপুঞ্জিতে মূসলমানদের টার্গেট করা হলেও বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক নীতি থেকে সেখানকার বাংলাভাষী হিন্দুরাও রেহাই পায়নি। সে অভিজ্ঞতার আলোকে এবার ভারতের লোকসভায় পাস হওয়া নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনী(সিএবি) আইনের টার্গেট মূলত ভারতের মুসলমানরা। গত সোমবার মুসলমান প্রতিনিধিসহ ভারতীয় নি¤œকক্ষ লোকসভায় ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারনৈতিক সদস্যদের প্রবল আপত্তি ও বিরোধিতা উপেক্ষা করেই বিজেপি নেতা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের আনীত নাগরিকত্ব বিলটি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কণ্ঠভোটে পাস করিয়ে নেয় বিজেপি সরকার। রাজ্যসভায় অনুমোদনের মধ্য দিয়ে বিলটি আইনে পরিনত হলে তা হবে ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার উপর সবচেয়ে বড় আঘাত। ভারতীয় সংবিধানের ১৪ ও ১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়, লিঙ্গ ও জন্মস্থানের ভিত্তিতে রাষ্ট্র কোনো ধরণের বৈষম্য করতে পারবে না। ৯ ডিসেম্বর সোমবার লোকসভায় পাস হওয়া নতুন নাগরিকত্ব আইনে ভারতে অবস্থানরত হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের শর্তসাপেক্ষে নাগরিকত্ব প্রদানের ঘোষণা দেয়া হলেও সে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী মুসলমানদের বঞ্চিত করা হয়েছে। এটি ভারতীয় সংবিধানের মূল স্পিরিট এবং উপমহাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এই বিলের মধ্য দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ ভারত হিন্দু রাষ্ট্রে পরিনত হল।
বিজেপি’র সাম্প্রতিক রাজনৈতিক তৎপরতা থেকে তার মুসলিমবিদ্বেষী চেহারা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। চিরবৈরী পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধংদেহি অবস্থান কোনো নতুন বিষয় নয়। ভারতীয় সংবিধান থেকে ৩৭০ ও ৩৫/এ ধারা বিলোপের মধ্য দিয়ে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু ও কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয়ার মধ্য দিয়ে বিজেপির মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাব নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়। অযোধ্যায় ৫০০ বছরের পুরনো বাবরি মসজিদের স্থানে রামমন্দির নির্মানের পরিকল্পনা সামনে রেখে তিন দশক আগে বিজেপি যে উচ্চাভিলাসী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ক্যাম্পেইন শুরু করেছিল বর্তমান বিজেপি সরকার ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে কাটাছেড়া করে সেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ষোলকলা পূর্ণ করতে চলেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ভারতের ক্ষমতাসীনরা নিজেদের সংবিধান পরিবর্তনসহ যে কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেই পারে। তবে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি একদিকে ভারতের আভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে, অন্যদিকে প্রতিবেশী মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং আন্ত:সীমান্ত নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার উপর বড় ধরণের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সবচেয়ে বিষ্ময়কর ও দু:খজনক ব্যাপার হচ্ছে, লোকসভায় নাগরিকত্ব বিল উত্থাপন করতে গিয়ে বিজেপি নেতা অমিত শাহ বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের কল্পিত ও ডাহা মিথ্যা অভিযোগ তুলেছেন। যেখানে অন্য ভারতীয় রাজনৈতিক নেতারাও বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও হিন্দুদের নিশ্চিত নিরাপত্তার বিষয়টি স্বীকার করছেন। আন্তর্জাতিকভাবেও বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মডেল। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নজির বিরল। অপরদিকে ভারতে আরএসএস-বিজেপি’র রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলের জন্য বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা ও রামমন্দির নির্মান থেকে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অন্তত ২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের বেশিরভাগই মুসলমান। গোরক্ষার নামে ধর্মীয় শ্লোগান দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে মুসলমান হত্যার সাম্প্রদায়িক বর্বরতা এখন প্রকারান্তরে ভারতের রাষ্ট্রীয় নীতির দ্বারা সমর্থিত হচ্ছে।
ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা খর্ব ও কাশ্মীরিদের গণতান্ত্রিক –নাগরিক অধিকার হরণের সিদ্ধান্ত যেমন আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থন পায়নি একইভাবে মুসলিমবিদ্বেষী নাগরিকত্ব আইনও ভারতের প্রতিবেশি ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন পাচ্ছে না। সোমবার বিল পাস হওয়ার পর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক কমিশন(ইউএসসিআইআরএফ) বিলটিকে মুসলিম বিদ্বেষী, ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিপন্থী এবং অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে আখ্যায়িত করেছে। এ ধরনের সাম্প্রদায়িক নিবর্তনমূলক বিল উত্থাপনের জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি অমিত শাহ সহ ঊর্ধ্বতন বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুপারিশ করেছে ইউএসসিআইআরএফ। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের তীব্র বিরোধিতা করে লোকসভায় অল ইন্ডিয়া-মজলিশ-এ-ইত্তেহাদুল-মুসলিমিন(এমআইএম) নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি বিলের কাগজ ছিড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বিজেপি নেতা অমিত শাহকে জার্মানীর হিটলার এবং ইসরাইলের বেন গুরিয়নের সাথে তুলনা করে নতুন আইনকে মুসলমানদের রাষ্ট্রহীন করার ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন। এই আইনের ফলে ভারত ভাগ হতে চলেছে বলেও ওয়াইসি দাবী করেন। ভারতীয় মুসলমানদের জন্য বৈষম্যমূলক এই বিল পাশ করতে গিয়ে অমিত শাহ বাংলাদেশে কথিত হিন্দু নির্যাতনের যে অভিযোগ তুলেছেন তা মিথ্যা ও দূরভিসন্ধিমূলক। অমিত শাহর বক্তব্যের আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছে বিএনপি। সরকারের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে অমিত শাহের কথিত হিন্দু নির্যাতনের অভিযোগ সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন। আসামের এনআরসি, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে ভারতের বিএসএফ সীমান্তে বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের পুশইন করার চেষ্টা করছে। এহেন বাস্তবতায় বাংলাদেশের নিরবতার কোনো সুৃযোগ নেই। বিজেপি নেতাদের বাংলাদেশবিদ্বেষী ভূমিকা দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। শতকোটি মানুষের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভারতের এত বছরের ঐতিহ্যের পরিবর্তন ও প্রতিবেশীদের সাথে বিদ্বেষমূলক আচরণ ভারতের নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উপেক্ষা করতে পারে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।