শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
শিল্প মাধ্যমগুলির ভেতর চিত্র শিল্প একটি অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম। চিত্রের ভাষা চিরন্তন। দেশ-কাল-পাত্রের সীমানা ছড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। একটি চিত্র শিল্প যেকোন দেশেই অবলীলায় প্রদর্শিত হতে পারে; এবং সেখানকার মানুষের ভাষা বা আচার-আচরণ, কৃষ্টি-কালচার যেমনই হোক না কেন চিত্রের ভাষা বুঝতে পারে। এজন্যই হয়ত বলা হয়, ‘একটি চিত্র হাজার শব্দের চেয়েও শক্তিশালী’। চিত্র কলা তাই মানুষের অন্তরের অন্তনির্হীত ভাষা ও বোধ। কিন্তু যু উৎকৃষ্ট গদ্য বা কবিতা হোক না কেন তা এক স্থানের অধিবাসীরা বুঝতে পারে, অন্য স্থানের অধিবাসীরা তার কিছুই বুঝতে পারে না। ভাষা আলাদা হবার জন্য এ রকম হয়ে থাকে। পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে তিন হাজারের মতো ভাষা রয়েছে। এক্ষেত্রে অনুবাদ করে অন্যস্থানে পাঠালেও হুবহু মূলটির মতো হওয়া সম্ভব নয়। একজন বিজ্ঞ সমালোচক বলেছিলেন, ‘অনুবাদ করবার পর যা বাকী থাকে, তাই মূল লেখার ভাববস্তু’। সেক্ষেত্রে অনুবাদ আলাদা শিল্প হতে পারে, ছায়া অবলম্বনে লেখার মু হতে পারে; কিন্তু প্রকৃত লেখা হয় না। সেক্ষেত্রে চিত্র নিজেই একটি অনবদ্য একক। এর কোন অনুবাদের প্রয়োজন হয় না। যে কোন চিত্র পৃথিবীর যে প্রান্তেই প্রদর্শিত হোক না কেন, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই এর অর্থ বুঝতে পারে। এখানেই চিত্র শিল্পের প্রাথমিক সার্থকতা।
স্বাধীনতার পর থেকে এদেশে চিত্র শিল্প বহুদূর এগিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিকতা, স্বদেশিকতায় সুমহান উজ্জ্বল এই সব চিত্র শিল্প। এস এম সুলতান ও জয়নুল আবেদীনের নাম এই শিল্পের সাথে সরাসরি জড়িত এবং তারাই এদেশের চিত্র শিল্পকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উত্তীর্ণ করেছেন। বর্তমানে বহু আন্তর্জাতিক মানের চিত্র শিল্পী আমাদের দেশে রয়েছে। এদেশে চিত্রকলাকে আন্তর্জাতিক অর্থেই ‘আধুনিক’ বলা যেতে পারে। এদেশের চিত্র কলার ইতিহাস খুব পুরানো না হলেও ১৯৪৭ সালের দেশ ভাঙন, ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গন অভ্যুত্থান, ১৯৭১ এর স্বাধীনতা ইত্যাদি জড়িত। পর্যায়ক্রমে এই সব বৎসরগুলি চিত্রকলার ওপরও নানা প্রকার প্রভাব এনেছিল। চিত্র শিল্পের শুরুর দিকে অবনীন্দ্রনাথ, যামিনী রায়, রবি বর্মা, রবীন্দ্রনাথ এবং পরবর্তী পর্যায়ে শফিউদ্দিন আহমদ, কামরুল হাসান, আনোয়ারুল হক এরাই এদেশের চিত্র শিল্পীদের শিক্ষাগুরু বলা যেতে পারে। তারা প্রত্যেকেই তাদের মতো করে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে মানুষ ও প্রকৃতিকে এঁেকছন। কিন্তু যে আঙ্গিকেই আঁকা হোক না কেন, ‘বিশ্বের সর্বত্র মানুষের প্রয়োজন এক, ধ্যান ধারণা এক, অনুভূতি এক’। সেজন্য তাদের চিত্র শিল্পে মানুষ ও প্রকৃতির সুখ-দুঃখ-হাসি-কান্না-হতাশা-উচ্ছ্বলতা-উষ্ণতা এসবই ঘুরে-ফিরে এসেছে। একটি সময় মনে করা হতো; যেহেতু চিত্র কলা দৃশ্যমান মাধ্যম এবং অনেকটাই ব্যক্তি নির্ভর; সেজন্য হয়ত এখানে বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাব দ্রুত পড়ে। অনগ্রসর সমাজ একে ভাল ভাবে মেনে নিতে পারে না এবং তারা বেশ খানিকটা লজ্জিত, ভীত বা মারাত্মক সংশয়ের ভেতরে থাকে। তবে আমাদের অনেক শিল্পীরাই মাতিস, পিকাসো, ডুফি, পল গঁগ্যাঁ, ফ্র্যাঞ্জ ক্লাইন দ্বারা বেশ খানিকটা প্রভাবিতও হয়েছেন। তবে প্রত্যেকেরই নিজস্বতা রয়েছে। এটি আশাবাদের ব্যাপার। ’ প্রত্যেক সংস্কৃতিই যেমন তার নিজস্ব ভাষা তৈরী করে নেয়, তেমনি তার শিল্পকলাও তৈরী করে নেয়’। একটি দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় পরিবেশ সব কিছুরই প্রভাব শিল্পকলায় পড়ে। এদেশের শিল্প কলাও তার ব্যতিক্রম নয়। চিত্রকলা তৈরীর ক্ষেত্রে বিভিন্ন ইজম বিভিন্ন সময় এসেছে। তার ভেতর রয়েছে; রিয়েলিজম, ফবিজম, কিউবিজম, আইডিয়ালিজম, মিষ্টিসিজম, ইম্প্রেশনিজম, দাদাইজম, ফিউচারিজম, সিনথিসিজম, এক্সপ্রেশনিজম, পিউরিজম, সুরিয়ালিজম, এ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজম, সোস্যালিস্ট রিয়ালিজম প্রভৃতি। অনেক শিল্পীই ‘অৎঃং ভড়ৎ ধৎঃং ংযধশব’, একথা মনে রেখেই ছবি এঁকেছেন; কিন্তু তা কতোটা গ্রহণ যোগ্য হয়েছে, তা সময়ই বলবে। যদিও শিল্পীরা বিমূর্ত রূপের ভেতর থেকেই মূর্ত রূপকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পীদের ব্যক্তিগু সমস্যা অন্য যেকোন দেশের শিল্পীদের সমগোত্রীয়। জীবনের নানা প্রকার জটিলতা তারা এ্যাবস্ট্রাক্ট ভঙ্গিতেই প্রকাশ করতে বেশি আগ্রহী। যদিও এদেশের প্রধান চিত্র শিল্পীদের অনেকেই বাস্তবের ওপরই অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন, এস এম সুলতান, জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান, মোহাম্মদ কিবরিয়া, আমিনুল ইসলাম প্রমুখ। এদের অনেকেই রিয়েলিজম ধারায় ছবি এঁকেছেন। আবার অনেকেই নির্বস্তুকভাবে এগিয়েছেন।
কোন মৌলিক বিষয়েরই সম্ভবত কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা হয় না। শিল্পেরও কোন ধরা বাঁধা সংজ্ঞা নেই। টলস্টয় মনে করতেন, ‘শিল্প কলা হবে মানুষের জন্য প্রয়োজনীয়, হবে নতুন সৃষ্টি, হবে সুখবোধ্য’। আলফ্রেড বার মনে করেছেন, ‘শিল্পকলার সংজ্ঞা দেওয়া বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়’। স্যার জন রথেনস্টাইনের মতে, ‘শিল্পীর ইচ্ছার উপর নির্ভর করে শিল্প’। জর্জ সান্টায়ানা বিশ্বাস করতেন যে, ‘শিল্পকলার কাজ হলো মানুষকে আনন্দ দেয়া’। বার্নাড বেরেন্সন শিল্পকলাকে ‘জীবন উন্নয়নকারী কর্ম’ বলে অভিহিত করেছেন। সুজান লেঙ্গার শিল্পকলাকে একটি ‘অনুভূতি বা ফিলিং’ এর ব্যাপার বলে মনে করতেন। তবে শিল্পকলা সম্পর্কে সার্বিক ভাবে বলা যায় যে, ‘শিল্পকলা মূলত একটি অভিব্যক্তি, শিল্পী ও দর্শকের মধ্যে একটি আত্মিক যোগাযোগের সেুু এবং সর্বোপরি একটি নতুন কিছুর নির্মাণ’। স্যার কেনেথ ক্লার্ক আধুনিক চিত্র কলার তিনটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন, ক) শুদ্ধতম বিমূর্তরূপ খ) কম্যূনিকেশন গুণ গ) চিত্রে বিজ্ঞানের বর্ধিত ব্যবহার।
পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের চিত্র কলাই কম বেশি উপরোক্ত গুণ সমূহে সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের চিত্র শিল্পীরাও এর ব্যতিক্রম নন। আন্তর্জাতিক পরিম-লেও এদেশের শিল্পীদের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। এদেশের শিল্পীদের ভেতর যারা বেশ ভাল করেছেন এবং বর্তমানেও করছেন, তাদের ভেতরে রয়েছেন, শিল্পী এস, এম, সুলতান, জয়নুল আবেদীন, শফিউদ্দিন আহমদ, কামরুল হাসান, আনোয়ারুল হক, সৈয়দ শফিকুল হোসেন, মোহাম্মদ কিবরিয়া, হামিদুর রহমান, আমিনুল ইসলাম, আবদুর রাজ্জাক, রশিদ চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, কাইয়ুম চৌধুরী, আবদুল বাসেু, দেবদাস চক্রবর্তী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, আবু তাহের, রফিকুন্নবী, হাশেম খান, দেলোয়ার হোসেন, আমিরুল ইসলাম, মোহাম্মদ মহসীন, আবুল বারক আলভী, শহীদ কবীর, স্বপন চৌধুরী, চন্দ্র শেখর দে, মাহমুদুল হক, মাহবুবুল আমীন, কাজী আবদুর রউফ, আব্দুল মতিন, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, নিতুনকিন্ডু, মোস্তফা মনোয়ার প্রমুখ। এছাড়াও অগণিত চমৎকার শিল্পী রয়েছে আমাদের দেশে। যাদের সৃজনশীল কর্ম ইতোমধ্যে সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বাংলাদেশের চিত্র কলা মূলত আধুনিক। তবে তা কোন বিশেষ ধারায় প্রবাহিত নয়। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।