Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মুসলমানরা গরু খাওয়া শিখল কিভাবে?

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

ভারতে গোমাংস বিতর্ক নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করে বই প্রকাশ করতে গিয়ে ভয়ানক বিপদে পড়েছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা। অসহিষ্ণু ধর্মান্ধ রক্ষণশীল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সমর্থকরা অধ্যাপক নারায়ণ ঝাকে বার বার মৃত্যুর হুমকি দিয়েছেন, ঈশ্বর-নিন্দার কারণ দর্শিয়ে তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে কোর্টের মাধ্যমে তার গবেষণার প্রকাশ বন্ধ করিয়েছেন। পরে অধ্যাপক দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা ‘দ্য মিথ অফ দ্য হলি কাউ’ নামে তার গবেষণার সারবস্তু লন্ডন থেকে প্রকাশ করেন। সম্প্রতি ভারতে গোরক্ষার নামে যেভাবে মুসলমান হত্যা চলছে তা আধুনিক জগতে চরম নিন্দনীয় ও অকল্পনীয়। গোধূলিলগ্নে চারণভূমি থেকে গরু নিয়ে ফেরার সময় গোহত্যার অভিপ্রায়ের অজুহাতে মুসলিম রাখাল বালক হত্যা, বাড়িতে গোমাংস রাখার অভিযোগে পুরো মুসলমান পরিবারকে পুড়িয়ে মারার কর্মকা-ে সারাপৃথিবী বিস্মিত, স্তম্ভিত ও চিন্তিত।

প্রাচীন ভারতে গোহত্যা ছিল ব্রাহ্মণ-সেবার অবিচ্ছেদ্য অংশ : প্রাচীনকাল থেকে ভারতে গোহত্যা ও গোমাংস আহারের ব্যাপক প্রচলন ছিল উচ্চ ও নিম্নবর্ণের হিন্দুর বাড়িতে, সব ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, ব্রাহ্মণ-তুষ্টিতে এবং বিভিন্ন রাজকীয় ও ধর্মীয় গোমেধে। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দের সব ভারতীয় ধর্মীয় গ্রন্থ ও লোকসাহিত্যে উৎসব করে ভারতে গোমাংস আহারের প্রমাণ পাওয়া যায় জন্মানুষ্ঠান, মহাব্রত, শ্রাদ্ধ ও ব্রাহ্মণ-সেবায়। কামসংহিতায় উল্লেখ আছে, তান্ত্রিক ব্রাহ্মণদের শারদীয় সেবা করতে হতো ১৭টি অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সী খর্বকায় ষাঁড় এবং তিন বছরের কম বয়সী গোশাবক হত্যা করে। অবশ্য নিম্নবর্ণের দরিদ্র হিন্দুদের কালেভদ্রে গোমাংস আহারের সৌভাগ্য হতো। চন্ডাল ও অচ্ছুৎদের গোহত্যা করে গোমাংস আহারের অধিকার ছিল না। তারা মৃত গরুর মাংস খেত এবং গরুর চামড়া দিয়ে জুতা ও অন্যান্য দ্রব্য তৈরি করত, তারা গরুর হাড়ের ব্যবহারও করত। এ প্রথা ভারতের নিম্নবর্ণের অচ্ছুৎ হিন্দুদের মধ্যে আজও বহাল আছে। পুষান দেবতার পছন্দ কালো গাই, রুদ্রের প্রিয় লাল গরুতে। বৈদিক দেবদেবীরা বিভিন্ন গৃহপালিত প্রাণীতে অনুরক্ত ছিলেন কেউ বা মহিষ, কেউ বা ছাগল, কেউ ভেড়ায়। ইন্দ্রের পছন্দ গোলাকার শিংযুক্ত ষাঁড় ও সাদা হাতিতে, অগ্নিদেবতার আকর্ষণ ছিল অশ্ব ও গোমাংসে। ঋগে¦দে কী করে তলোয়ার বা কুড়াল দিয়ে গরু হত্যা করতে হবে এবং পরে রান্না করে খেতে হবে তার বর্ণনা আছে। বৈদিক ও বৈদিক-পরবর্তী যুগে ভারতীয়রা গোমাংস কেবল আহার করত তাই নয়, তাদের বিশ্বাস ছিল পিতা-মাতার শবদেহ দাহনের সময় একই সঙ্গে হৃষ্টপুষ্ট ষাঁড় পোড়ালে মৃত ব্যক্তি ষাঁড়ে আরোহণ করে স্বর্গে প্রবেশ করতে পারবেন। এরূপ ঘটনার উল্লেখ আছে অথর্বেদের বর্ণনায়। ভারতে আগত আর্যরা ছিল যাযাবর ও কৃষিতে অনভ্যস্ত। খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ সাল থেকে কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তুরস্ক ও পূর্ব ইউরোপের পোল্যান্ড, রুমানিয়া, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, নরওয়ে প্রভৃতি দেশ থেকে আর্যরা ভাগ্যের অন্বেষণে স্থলপথে কয়েক হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ভারতে পৌঁছে। অবশ্য দ্রাবিড়রা ভারতে বসতি গড়েছিল আর্যদের আগমনের কয়েক হাজার বছর আগে ৮০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। যাযাবর জীবনের পরিসমাপ্তিতে আর্যরা পরিচিত হয় সহজলভ্য খাদ্য হিসেবে গোমাংসের সঙ্গে। বৃহৎ জনবসতির কারণে ভারতে বনজপ্রাণীর সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পেয়েছিল, তবে গৃহপালিত ষাঁড়, মহিষ, গরু ও ছাগলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল দ্রুতগতিতে। বৃটিশ প্রশাসক উইলিয়াম ক্রুক ১৮৯৪ সালে প্রকাশিত তার ব্যাপক গবেষণাগ্রন্থ ‘দ্য ভেনেরেশন অফ দ্য কাউ ইন ইন্ডিয়া’তে দেখিয়েছেন যে, আর্যরা কেবল গোমাংসভোগী ছিলেন তাই নয়, তাদের গোমাংসে বিশেষ আকর্ষণ ছিল।

মহাভারত ও রামায়ণ-চরিত্রদের গোমাংসপ্রীতি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। দ্রৌপদী দেবতাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, পঞ্চপাত্তব বনবাসের অবসান হলে যুধিষ্ঠির সহ¯্র ষাঁড় ও গরু বলিদান করে দেবতাদের তুষ্ট করবেন। পঞ্চপাত্তব তাদের বনবাসকালে সহজলভ্য গৃহপালিত গরুর মাংস সংগ্রহ করতেন এবং গোমাংস আহারে তাদের শক্তি সঞ্চিত হতো। গোবর ও গোমূত্রের ব্যবহারও ছিল তাদের জীবনযাত্রায়। মহাভারতে আরও উল্লেখ আছে, রাজা রতিরতœদেব প্রতিদিন সহ¯্র গরু জবাই করে ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিলি করে পুণ্য অর্জন করতেন।

বাল্মীকির রামায়ণে এ-জাতীয় আরও ঘটনার বিবরণ আছে। জনশ্রুতি যে, ব্যাপকসংখ্যক গরু বলিদানের ফলে রাজা দশরথের সন্তান রামের জন্ম হয়। রামপতœী সীতা যমুনা নদী অতিক্রমকালে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, রাম তার পিতৃ আদেশ সফলভাবে পালন করতে পারলে তারা যমুনা নদীতে দেবীকে সহ¯্র গাই-গরু ও সহ¯্র ভাঁড় মদ উৎসর্গ করবেন। অবশ্য সীতা নিজে গোমাংসের চেয়ে হরিণের মাংস বেশি পছন্দ করতেন।

চরক-সংহিতা ও সুশ্রুত-সংহিতায় ওষুধ হিসেবে গোমাংস আহার এবং গোমূত্র সেবনের উপকারিতার বিবরণ আছে। গরুর লেজ ও হাড়ের ঝোলের বিধান আছে বিভিন্ন প্রদাহের চিকিৎসা হিসেবে। চরক সর্দি, সাধারণ জ্বর, পেটের গন্ডগোল নিরাময়ে গোমাংস পথ্য হিসেবে বিধান দিয়েছেন। সুশ্রুতের মতে, শ্বাসকষ্ট, শ্লেষ্মাজনিত সমস্যা ও দীর্ঘস্থায়ী জ্বরে গোমাংস ওষুধের কাজ করে। সুশ্রুত গরুর মাংসকে ভগবানের পবিত্র দানরূপে চিহ্নিত করেছেন। গর্ভবতীকে গোমাংস খাওয়ালে গর্ভস্থ শিশু বলবান হয়।

সপ্তম শতাব্দীতে চিকিৎসক ভগবত গোমূত্র ও গোকণা বিবিধ রোগ নিরাময়ের জন্য বিধিপত্র (প্রেসক্রিপশন) দিতেন। গরুর পঞ্চ উপাদানে প্রস্তুত পঞ্চগর্ভের আধুনিক সংস্করণ পঞ্চমর্ত্য যা পূজা-পার্বণে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। পাসর, বৈষ্য ও শংকরের মতে, গরুর মুখ ছাড়া সব অংশ আহারযোগ্য ও পাপমোচনে ব্যবহারযোগ্য। শল্যবিদ সুশ্রুত ১ হাজার ২০টি রোগের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন সুশ্রুত-সংহিতায়। সুশ্রুতকে প্লাস্টিক সার্জারির জনক বলা হয়। তিনি শতাধিক মেডিকেল যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করেছিলেন। প্রাচীন ভারতে গোমাংস ভক্ষণের বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে পি ভি কেইন সম্পাদিত বৈদিক যুগের পাঁচ খ- ধর্মশাস্ত্রের ইতিহাসে। ভারতের জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাও গোমাংসে তৃপ্তি পেতেন, গৌতম বুদ্ধও একসময় গোমাংস আহার করতেন। জৈনধর্মের প্রবর্তক মহাবীরও গোমাংস ভক্ষণ করতেন। পরে তারা উভয়ে গোহত্যা নিষিদ্ধ করেছেন ধর্মীয় কারণের জন্য নয়, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে ব্রাহ্মণদের পার্থক্য সৃষ্টি ও রাষ্ট্রীয় শাসন সুবিধার জন্য।

গোহত্যা প্রাচীন যুগে মহাপাপ বলে স্বীকৃত হয়নি। বৈদিক যুগে মনুসংহিতায় গোহত্যা সাধারণ পাপ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তবে ব্রাহ্মণের গরু অব্রাহ্মণ বধ করলে কঠিন শাস্তির বিধান হয়- গোশালায় রাতযাপন করে কেবল গরুর পাঁচ উপাদান (পঞ্চগর্ভ) ভক্ষণ করে। গোহত্যাকারীকে ২৫ দিবারাত্রি অনাহারে থাকতে হতো। ঋগে¦দ ও উপনিষদের সাতটি মহাপাপ হলো- ১. ব্রাহ্মণকে অপমান ২. ব্রাহ্মণ হত্যা ৩. চৌর্যবৃত্তি ৪. প্রতারণা ৫. মদ্যপান (সুরাপান) ৬. গুরুস্ত্রীর সঙ্গে যৌনাচার ও ৭. ব্যভিচার। আরবরা ভারতে পৌঁছে গোমাংস আহারে পরিচিত হয়। ভাগ্যের অন্বেষণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ইসলাম ধর্মাবলম্বী রাজা ও দলপতিরা ভারত বিজয় করেছেন বিভিন্ন শতাব্দীতে। এদের কেউ এসেছেন ইরান থেকে, কেউ আফগানিস্তান থেকে, কেউ তুরস্ক থেকে, কেউ মধ্যপ্রাচ্য, কেউ বা রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। তাদের দীর্ঘ পথযাত্রায় খাদ্যের জোগান এসেছে বনজপ্রাণী, হরিণ, ঘোড়া, উট, দুম্বা, গন্ডার ও মহিষ থেকে। রোদে শুকিয়ে এসব প্রাণীর মাংস দীর্ঘদিন রেখে খাওয়া যায়। গোমাংস কখনো এদের যাত্রাপথের সামগ্রী হিসেবে বিবেচিত হতো না। ধাই মাতার সঙ্গে আরবদের দীর্ঘ বন্ধন ছিল। তাই দুধদানকারী প্রাণী হত্যায় তাদের মানসিক অস্বস্তিবোধ ছিল। চারণভূমির স্বল্পতার কারণে গৃহপালিত গরুর সঙ্গে তাদের পরিচয় ছিল সীমিত। মরুভূমির দেশ আরবে চারণভূমির অভাব সর্বজনজ্ঞাত।

আরবরা ভারতে প্রথম পর্দাপণ করে ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে, স্থলপথে নয়, সমুদ্রপথে। আরব সেনাপতি সোহেল বিন আবদি ও হাকাম আল তাকবি ভারত সমুদ্রে রাজিলের যুদ্ধে ভারতীয়দের পর্যুদস্ত করে সিন্ধুতে পৌঁছেন। পূর্বানুমতি না নেওয়ায় ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ না করে তাদের আরবে ফিরে যেতে হয় খলিফা ওমরের নির্দেশে। সমুদ্রাভিযানে আরব সেনানীদের খাদ্য ছিল খেজুর এবং ঘোড়া, উট ও দুম্বার শুকানো মাংস। আরবরা দুগ্ধবতী প্রাণী মাংস ভক্ষণে কখনো উৎসাহবোধ করেনি। খলিফা ওসমানের আমলে ৬৫২ খ্রিস্টাব্দে আরবরা মাকরান ও উমাইয়া খলিফা মোয়াবিয়ার আমলে ৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাব জয় করেন। মুহাম্মদ বিন কাশিম সিন্ধুতে আরবদের বসতি স্থাপন করেন ৭১০ খ্রিস্টাব্দে। ইতিহাসবিদ আলবেরুনি ভারত সফর করেছিলেন ১০৩০ খ্রিস্টাব্দে। পরবর্তীকালে উজবেকিস্তান থেকে আগত তৈমুর লং, গজনির সুলতান মাহমুদ, শাহাবুদ্দিন মুহাম্মদ ঘোরি, বখতিয়ার খিলজি প্রমুখ ভারত বিজয় করে শাসন করেছেন প্রায় ৪০০ বছর। ১৫২৬ সালে জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবর ভারত বিজয় করে মোগল সা¤্রাজ্যের পত্তন ঘটান।

ভারতে পৌঁছে ভাগ্যান্বেষণকারী বিজয়ী মুসলমানরা কৃষিকাজে ব্যাপকসংখ্যক গরুর ব্যবহার এবং একই সঙ্গে ভারতীয়দের গরু বধ করে গোমাংস আহার ও ধর্মীয় কাজে ব্যাপক গোমাংস বিতরণ দেখে বিস্মিত হন। তারা লক্ষ্য করেন, গরুর দুধের বিবিধ ব্যবহার- সরাসরি দুগ্ধপান, দই, মাখন, ছানা ও ঘি উৎপাদনে। ভারতীয়দের গোবরভক্তিতে মুসলমানরা আশ্চর্যান্বিত হয়েছেন। গোবর ব্যবহৃত হতো মন্দিরের বেদি পরিষ্কার করার কাজে এবং গোবর খাইয়ে ভক্তের পাপমোচনে। নিম্নবর্ণের হিন্দুরা গোবর শুকিয়ে ব্যবহার করত জ্বালানি হিসেবে। গরুর লেজের ঝোল ও গোমূত্রের ওষুধ হিসেবে ব্যবহারে মুসলমানরা হতবাক হয়ে পড়ে। ভারতে বনজপ্রাণীর স্বল্পতার কারণে অন্য দেশ থেকে আগত মুসলমানরা ক্রমে গোমাংস আহারে অনুরক্ত হয়ে পড়েন এবং একেক দেশের মুসলমানরা একেক রকমের মসলা, চর্বি ও তেলসংযোগে গোমাংস রান্নায় বৈচিত্র আনেন। তুর্কি, মোগল, পারসিদের গোমাংস রান্নার প্রক্রিয়ায় ভিন্ন ভিন্ন ধরনের রসনা তৃপ্তির স্বাদ বিস্তার লাভ করেছে ভারতের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। অল্পবয়সী গোশাবক মাংসে ব্রাহ্মণদের আসক্তির কারণে গাই-গরুর সংখ্যা কমতে থাকলে কৃষিতে সমস্যা দেখা দেয় এবং দুধেরও অভাব সৃষ্টি হয়। গরুর দুধের স্বল্পতায় শিশু ও বয়োবৃদ্ধরা স্বাস্থ্য সংকটে পড়ে। চাষাবাদের ক্ষতি রোধ করার লক্ষ্যে মোগল স¤্রাট জাহাঙ্গীর ও আওরঙ্গজেব গোহত্যা সীমিত করেন, গোবধের আগে কাজীর অনুমতি নেওয়ার বিধানও চালু করেন। এতে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীরা খুশি হলেও ব্রাহ্মণরা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন। তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনে বিঘœসৃষ্টি ও হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে বলে প্রচারণা চালিয়ে ব্রাহ্মণরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। স্মরণযোগ্য যে, স¤্রাট আকবরই প্রথম সতীদাহ প্রথা বন্ধের চেষ্টা করেছিলেন।

মুসলমানরা ভারতে গোহত্যা আরম্ভ করেনি, গোমাংস আহারের প্রচলনও করেনি। বরং মুসলমান শাসকরা গোহত্যা সীমিত করার উদ্যোগ নিয়েছে কৃষিকাজের উন্নয়ন ও শিশুস্বাস্থ্য রক্ষার নিমিত্তে। ভারতে গোবধের সামাজিক আচার থেকে গোরক্ষার রাজনীতি প্রাচীন ভারতে গোহত্যা মহাপাপ দূরে থাকুক সাধারণ পাপ হিসেবে বিবেচনা হতো না। তবে ব্রাহ্মণের গরু চুরি অপরাধ হিসেবে গণ্য হতো, সামান্য শাস্তির বিধান ছিল। স¤্রাট অশোকের আমলে (খ্রিস্টপূর্ব ২৬৮ থেকে ২৩২) মূলত বৌদ্ধধর্মের সুবিধার্থে ও হিন্দুধর্মের সঙ্গে দৃশ্যমান পার্থক্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে স¤্রাট অশোকসৃষ্ট ৮৪ হাজার স্তুপের মধ্যে মুষ্টিমেয় কয়েকটি স্তুপে গোবধ রোধের প্রস্তাব লিপিবদ্ধ রয়েছে।

মাগল স¤্রাট আওরঙ্গজেবের কাছে একাধিকবার পরাজিত মহারাষ্ট্রের ছত্রপতি শিবাজী ভোঁসলে (১৬৩০-১৬৮০) বিজয়পুর গুহায় আত্মগোপন করেন। পরাজয়ের গ্লানিতে তার সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে তিনি শঠতা ও ছলনার আশ্রয় নিয়ে নিজেকে ভগবানের পুনর্জীবনপ্রাপ্ত অবতার ঘোষণা দিয়ে হিন্দুদের উজ্জীবিত করেন এবং গোহত্যা নিষিদ্ধ করেন। এতে হিন্দুদের পাশাপাশি বৌদ্ধ ও জৈনরা খুশি হয় এবং তারা ভারত রক্ষার সংগ্রামে যুক্ত হয় অবতার ভগবান শিবাজীর নেতৃত্বে। রায়ঘর দুর্গে অবস্থানরত ছত্রপতি শিবাজী ভোঁসলের মৃত্যু হয় ৩ এপ্রিল, ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে রক্ত আমাশয়ে এবং পতন হয় মারাঠা রাজ্যের। তবে গোরক্ষা আন্দোলন নিঃশেষ হয় না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিবাজি উৎসবে লিখলেন-
‘ধ্বজা করি উড়াইব বৈরাগীর উত্তরী বসন-দরিদ্রের বল,
এক ধর্মরাজ্য হবে এ ভারতে এ মহাবচন করিব সম্বল।
মারাঠির সঙ্গে আজি হে বাঙ্গালি, এক কণ্ঠে বলো জয়তু শিবাজি।’

১৮৭০ সাল থেকে পাঞ্জাবে গোরক্ষা রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়, দয়ানন্দ সারাভাস্তি ১৮৮২ সালে প্রথম গোরক্ষা সভা অনুষ্ঠান করেন যা ক্রমে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় পরিণত হয়। উত্তর-পশ্চিম ভারতের হাই কোর্ট ১৮৮৮ সালে গরু পবিত্র প্রাণী নয় বলে রায় দেওয়ার পরও আজমগড়ে ব্যাপক দাঙ্গা হয় ১৮৯৩ সালে এবং শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। অযোধ্যায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার পুনরাবৃত্তি ঘটে ১৯১২-১৩, ১৯১৭ সালে এবং সাম্প্রতিকালেও একাধিকবার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে গোমাংস ভক্ষণ করলেও স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬০-১৯০২) পরবর্তীতে ভারতে ফিরে গোরক্ষার প্রবক্তা হন।

গোরক্ষার ¯্রােতের বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে একমাত্র রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) গোমাংস ভক্ষণের অধিকার নিশ্চিতকরণের জন্য ক্রমাগত ব্যাপক প্রচার চালিয়েছেন। আধুনিক যুগে রক্ষণশীলতা পরিহার করে নির্বিবাদে গোবরের জ্বালানি ও ঔষধি হিসেবে ব্যবহার এবং গোমাংস ভক্ষণের অধিকার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ হচ্ছে- হিন্দু অথরিটিস ইন ফেভার অফ স্লেয়িং দ্য কাউস অ্যান্ড ইটিং ইটস ফ্লেশ। রাজা রামমোহন রায় হিন্দুধর্মের বিভাজনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ১৯১৫ সালে মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফিরে ভারতীয় রাজনীতিতে তার প্রবেশ সহজ করার লক্ষ্যে বেছে নেন গোরক্ষা আন্দোলন এবং প্রকাশ করলেন পবিত্র গাভীতথ্য। মহাত্মা গান্ধীর পবিত্র গাভীতথ্য রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার খোরাক সৃষ্টি করে এবং গোরক্ষা আন্দোলন জোরদার হয়। গান্ধী লিখলেন, ‘মা এবং দুগ্ধদানকারী গাভী উভয় অতীব প্রয়োজনীয়। তবে গাভীর অবদান বেশি। সন্তান জন্মের প্রথম কয়েক বছর স্তন্যদান করেন এবং প্রত্যাশা করেন যে পরবর্তীতে সন্তানরা মাকে দেখাশোনা করবে, অসুস্থ হলে তার সেবাযতœ করবে। গাভী কস্মিনকালে রোগাক্রান্ত হয়। মা মারা গেলে ব্যাপক অর্থব্যয় করে কবরস্থ বা শবদাহ করতে হয়। অপর পক্ষে মৃত গাভীর চামড়া থেকে শুরু করে প্রতিটি অঙ্গ আমাদের অর্থের জোগান দেয়।’ গান্ধীর বক্তব্যে ভর করে রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ (আরএসএস), বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দল গোরক্ষা আবেদন তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করে। এ-জাতীয় প্রচারণার কারণে সংশ্লিষ্ট ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলো গোহত্যা নিষিদ্ধ করে গোরক্ষার ধারা ভারতীয় সংবিধানে যুক্ত করার দাবিতে ১৯৬৬ সালে ভারতীয় পার্লামেন্টের সামনে ব্যাপক বিক্ষোভ করে। বজরং দল গোহত্যা নিষিদ্ধ করার জন্য ৩০ লাখ কর্মী সমাবেশ করে ২০০২ সালে। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী কেশুভাই প্যাটেল গোরক্ষার জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেন। গান্ধীবাদী আচার্য বিনোবা ভাবে ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে দীর্ঘমেয়াদি অনশন পালন করে প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইকে বাধ্য করেন গোহত্যা নিষিদ্ধ করে গোরক্ষা আইন প্রণয়নে।

নৃতত্ত্ববিদ অধ্যাপক মারবিন হ্যারিসের মতে, গান্ধীর গাভীতথ্য ছিল ব্রিটিশ ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামের বড় অস্ত্র। ‘গরু ঘিরে’ (র‌্যালিং রাউন্ড দা কাউ) রাজনীতির বিশদ বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা ভারতীয় ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ। ড. বাবাসাহেব আম্বেদকর হিন্দুদের গোমাংস আহারের রাজনীতির বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছেন ‘দ্য আনটাচঅ্যাবল: হু ওয়্যার দে অ্যান্ড হোয়াই বিকাম আনটাচঅ্যাবল’ বইতে ১৯৪৮ সালে।
লেখক : গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা।

 

 



 

Show all comments
  • Somir Sinha ১ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:৫৯ এএম says : 1
    শিরোনাম টা দেখে যদিও ইচ্ছে হচ্ছিল না পড়ার।সম্পাদক এমন শিরোনাম কেন দিলেন বুঝে আসেনা।গোমাংস খেতেন প্রাচীণ হিন্দুরা কিন্তু তিনি শিরোনাম টা এমন করে দিলেন যে মুসলিমরা যেন হিন্দুদের থেকে মাত্রই গোমাংস খাওয়া শিখেছে।
    Total Reply(0) Reply
  • মোহাম্মদ কাজী নুর আলম ১ নভেম্বর, ২০১৯, ১:০৩ এএম says : 0
    তার মানে যারা গোহত্যার প্রচলন করেছিল তারাই আজ গোরক্ষার নামে মুসলিম পিটিয়ে হত্যা করছে!!!
    Total Reply(0) Reply
  • সাইফুল ইসলাম চঞ্চল ১ নভেম্বর, ২০১৯, ১:০৪ এএম says : 0
    আগে কখনও বিষয়টি এভাবে শুনিনি। তবে ভারতে হিন্দুদের থেকেই মুসলিম গরুর গোশত খাওয়া শিখেছে এটা বিশ্বাসযোগ্য।
    Total Reply(0) Reply
  • সত্য বলবো ১ নভেম্বর, ২০১৯, ১:০৫ এএম says : 0
    কি আজব! একসময় ধর্মীয় পবিত্র কাজ সম্পাদনে গোহত্যা করা হতো আর এখন গোহত্যা বন্ধ করে পবিত্রতা রক্ষা করা হয়???
    Total Reply(0) Reply
  • মেহেদী ১ নভেম্বর, ২০১৯, ১:০৬ এএম says : 0
    লেখাটি পড়ে অনেক কিছু জানলাম। ধন্যবাদ ইনকিলাবকে।
    Total Reply(0) Reply
  • Dr.Harun Ur Rashid ১ নভেম্বর, ২০১৯, ১০:১৫ এএম says : 0
    Amar ek hindu bandhu garur gushta khan ar bolen uchu hindhura nichu hinduder ke khaoa nished kore karon ashol sad jenu sudhu tarai pai garu khaiya.
    Total Reply(0) Reply
  • jack ali ১ নভেম্বর, ২০১৯, ৬:০৯ পিএম says : 0
    Carabeef constitutes the greatest portion of the beef trade in India, enabling India to become the world's second largest exporter, accounting for nearly 20% of world beef exports.Dec 10, 2018
    Total Reply(0) Reply
  • খুব ভাল লেগেছে ৮ নভেম্বর, ২০১৯, ৬:২২ পিএম says : 0
    খুব ভাল লেগেছে
    Total Reply(0) Reply
  • খুব ভাল লেগেছে ৮ নভেম্বর, ২০১৯, ৬:২২ পিএম says : 0
    খুব ভাল লেগেছে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গরু

২৪ জুন, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন