শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
প্রাচীনকাল হতেই মানুষ তথ্য,জ্ঞান ও ভাবের আদান প্রদানের জন্য চিঠি বা পত্র লিখত।প্রেরক ও প্রাপকের মধ্যে যোগাযোগের সেতু বন্ধন রুপে কাজ করে পত্র।আধুনিক ডাক ব্যবস্থা শুরুর আগেই মানুষ কবুতরের মাধ্যমে পত্র পাঠাত।ভারত উপমহাদেশে সম্রাট শের শাহ ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করেন তা আজ সর্বজনবিদিত। আবার এই পত্রই যখন ব্যক্তিক আবেদনকে অতিক্রম করে শিল্প সৌকর্যের মাধ্যমে সার্বজনীন রুপ নেয়,তখন তা পত্র সাহিত্যে পরিনত হয়।পত্র সাহিত্যের জন্ম আধুনিক কালে।বাংলা গদ্যের সাথে পত্র সাহিত্যের রয়েছে জন্মলগ্ন সম্পর্ক। তৎকালীন রাজা কিংবা ভূ-স্বামীগন যে সব পত্র লিখেছেন,তাই বর্তমান গদ্যের আদি উৎস।১৫৫৫ খ্রি. অহোমরাজ স্বর্গনারায়নকে লেখা কোচবিহারের মহারাজা নরনারায়ণ লিখিত পত্রই আমাদের বাংলা গদ্যের প্রথম নমুনা হিসেবে স্বীকৃত।মিথ বা পুরাণেও পত্র সাহিত্যের উল্লেখ পাওয়া যায়।গ্রীক পুরাণের পাশাপাশি ভারতীয় পুরাণ অর্থাৎ মহাভারত ও রামায়ণে পত্র রচনার উল্লেখ আছে।বাইবেলের বেশ কয়েকটি পরিচ্ছেদ চিঠিতে লেখা।লিখন এর শুরু থেকেই অন্য কোন ব্যক্তির মাধ্যমে দুই ব্যক্তির মধ্যে লেখা বা ভাব আদান প্রদান হতো।অবশ্য দাপ্তরিক ডাক ব্যবস্থা আরো অনেক পরে ঘটে।লিখিত নথির বিস্তারের জন্য মিশরে একটি ডাক ব্যবস্থা ছিল,যেখানে ফেরাউন(২৪০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে) রাষ্ট্রীয় অঞ্চলে তাদের আইন শুরুর জন্য ব্যবহার করেন।পুরাতন পারস্য,চীন,ভারত,রোমে ও চিঠির চলাচলের সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে।রোল্যান্ড হিল ১৮৩৭ খ্রি.ডাক টিকিট মুদ্রা আবিষ্কারের পর চিঠি সার্বজনীন ভাষা পায়।
শুধু বাংলা সাহিত্যেই নয়,ইংরেজী সাহিত্যে ও পত্রকে আঙ্গিক হিসেবে ব্যবহার করে সাহিত্য রচনা করা হয়েছে।স্যামুয়েল রিচার্ডসনের ‹পামেলা› ইংরেজী সাহিত্যের একটি বিখ্যাত এবং বহুল পঠিত পত্রোপন্যাস।বিখ্যাত ব্যক্তি বা সাহিত্যিকের লেখা পত্র ও অমূল্য সম্পদে পরিনত হয়।এইসব পত্রের ভেতর লুকায়িত থাকতে পারে তার ভাবনা,সমাজচিন্তা, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি।সূক্ষ্ম অনুভূতি,মনন কিংবা বোধের সমন্বয় ঘটে এসব পত্রে।পাশ্চাত্য সাহিত্যিকদের মধ্যে কীটস,জর্জ বার্নার্ড শ,ওয়ালপোল,লর্ড টেনিসন,কুপার,লুকাস প্রভৃতির রচিত পত্রগুলো আমাদের কাছে ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ।
বাংলা সাহিত্যে পত্রের আঙ্গিককে শুধু উপন্যাস রচনাতেই ব্যবহারর করা হয়নি,কাব্য রচনার ক্ষেত্রে ও পত্রের ব্যবহার জনপ্রিয় শিল্প মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।বাংলা সাহিত্যের প্রথম পত্র-কাব্য মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‹বীরাঙ্গনা›।›বীরাঙ্গনা› পত্র-কাব্যটি পত্র-কাব্য হিসেবে আজ ক্লাসিক সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করেছে।›বীরাঙ্গনা ‹ পত্র-কাব্যেই নারীবাদী কণ্ঠের বলিষ্ঠ উচ্চারণ প্রথম শুনতে পাওয়া যায়।
বাংলা ভাষার কিছু বিখ্যাত কবি লেখক তাদের পত্র সংকলন প্রকাশের পর তা সাহিত্য মর্যাদাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।তাদের মধ্যে নবীন চন্দ্র সেনের ‹প্রবাসের পত্র›, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‹বিলাতের পত্র›, স্বামী বিবেকানন্দের ‹পত্রাবলী› অন্যতম।বাংলা পত্র সাহিত্য মূলত সুপ্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে।রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর সমস্ত জীবনভর অসংখ্য বিষয় ও ঘটনার প্রেক্ষিতে বহু পত্র রচনা করেছেন,যার সাহিত্যমূল্য আজ প্রশ্নাতীত।তার উল্লেখযোগ্য পত্র সাহিত্যের গ্রন্থগুলো হলো- ‹য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র›, ‹জাপান যাত্রী›, ‹রাশিয়ার চিঠি›, ‹পথে› ও ‹ পথের প্রান্তে› ইত্যাদি।কবি এসব পত্রে বাংলার চিরায়ত রুপ যেমন তুলে ধরেছেন,ঠিক তেমনি সমসাময়িক ঘটনার দারুন বিশ্লেষণী দিক ও উন্মোচন করেছেন।আবার কিছু পত্র জীবনবোধ এবং দার্শনিকতার উচ্চ আসীনে আসীন।কবির অন্যতম জনপ্রিয় ও বিখ্যাত পত্র সাহিত্য হল ‹ছিন্নপত্র›। ‹ছিন্নপত্র› মূলত শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লেখা আটখানি পত্রসহ,১৮৮৭-১৮৯৫ খ্রি. শ্রীমতি ইন্দিরা দেবীকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে সমস্ত পত্র লিখেছেন তার ১৫৩ টি পত্র সংকলিত একটি সংকলন।পত্র সাহিত্যের একটি সুন্দর ব্যাখ্যা কবি ১৪১ সংখ্যক পত্রে উল্লেখ করেছেন: ্রপৃথিবীতে অনেক মহামূল্য উপহার আছে,তার মধ্যে সামান্য চিঠিখানি কম জিনিস নয়।চিঠির দ্বারা পৃথিবীতে একটা নূতন আনন্দের সৃষ্টি হয়েছে।আমরা মানুষকে দেখে যতটা লাভ করি,চিঠি পত্র দ্বারা তার চেয়ে আরো একটা বেশি কিছু পেয়ে থাকি।চিঠিপত্রে যে আমরা কেবল প্রত্যক্ষ আনন্দের অভাব দূর করি তা নয়,ওর মধ্যে আরো একটু রস আছে যা প্রত্যক্ষ দেখা-শোনায় নেই।মানুষ মুখের কথায় আপনাকে যতখানি ও যে রকম করে প্রকাশ করে লেখার কথায় ঠিক ততখানি করে না।এই কারনে,চিঠিতে মানুষকে দেখবার এবং পাবার জন্য আরো একটা যেন নতুন ইন্দ্রিয়ের সৃষ্টি হয়েছে। আমার মনে হয়, যারা চিরকাল অবিচ্ছেদে চব্বিশ ঘন্টা কাছাকাছি আছে,যাদের মধ্যে চিঠি লেখালেখির অবসর ঘটেনি,তারা পরস্পর কে অসম্প্র্ণূ করেই জানে।যেমন বাছুর কাছে গেলে গরুর বাঁটে আপনি দুধ জুগিয়ে আসে,তেমনি মনের বিশেষ বিশেষ রস কেবল বিশেষ বিশেষ উত্তেজনায় আপনি সঞ্চারিত হয়,অন্য উপায়ে হবার জো নেই।এই চার পৃষ্ঠা চিঠি মনের যে রস দোহন করতে পারে,কতা কিংবা প্রবন্ধ কখনোই তা পারে না।গ্ধ
বাংলা উপন্যাসে ও পত্রের আঙ্গিককে শৈল্পিকরুপে উপস্থাপন করা হয়েছে।যে উপন্যাসের চরিত্ররা নিজ নিজ পত্রের মধ্য দিয়ে তাদের আবেগ,অনুভূতি,অভিজ্ঞতা,বোধ কিংবা পারিপ্বার্শিক নানান ঘটনার বর্ননা করে চরিত্রের যাবতীয় চিন্তা অনুভবের সঙ্গে পাঠকের সরাসরি সংযোগ স্থাপন করে,সেই উপন্যাসকেই পত্রোপন্যাস বলে।ইংরেজীতে বলে ঊঢ়রংঃড়ষধৎু হড়াবষং.যারা সচেতনভাবে পত্রকে উপন্যাসের আঙ্গিকে ব্যবহার করেন তাদের মধ্যে নটেন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যতম।তার রচিত ‹বসন্ত কুমারের পত্র ‹ বাংলা ভাষার প্রথম পত্রোপন্যাস। কাজী নজরুল ইসলাম ও পত্রোপন্যাস রচনা করেন। ‹বাঁধন হারা› নজরুলের একটি জনপ্রিয় পত্রোপন্যাস। করাচিতে থাকাকালীন নজরুল ‹বাঁধন হারা› পত্রোপন্যাস লেখা শুরু করেন।১৯২১ সালে মোসলেম ভারত পত্রিকায় এটা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়।১৯২৭ সালে ‹ বাঁধন হারা› গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পত্রোপন্যাস হল শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‹ক্রোঞ্চমিথুন›, বনফুলের ‘ কষ্টিপাথর’,বুদ্ধদেব গুহর ‹মহুয়ার চিঠি›, ‹চান ঘরে গান›, ‹সবিনয় নিবেদন›, নিমাই ভট্টচার্যের ‘মেম সাহেব›, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‹ প্রিয়তমাষু› অন্যতম।পত্রোপন্যাসে নৈর্ব্যক্তিক কোন বক্তব্য,বর্ণনা থাকেনা।উপন্যাসের চরিত্র নিজ নিজ কথা বলে চিঠির বা পত্রের মাধ্যমে।পুরো উপন্যাসের কাহিনী, চরিত্র,ঘটনা উপস্থাপিত হয় পত্রের মাধ্যমে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।