শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
সত্তর দশকের অন্যতম কবি আবিদ আজাদের জন্ম ১৯৫২ সালের ১৬ নভেম্বর কিশোরগঞ্জের চিকনিরচরে। ১৯৭৬ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঘাসের ঘটনা’ প্রকাশিত হয়। ঘটনা যে একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে এটা তিনি জানতেন। বিনয়ের সঙ্গে ঘটনাটিকে তিনি ‘ঘাসের ঘটনা’ বলেই জানালেন পৃথিবীকে। সেই ঘাসই যে একদিন মহীরুহ হয়ে উঠবে তা টের পেয়েছিলো বাংলা সাহিত্য। আবিদ আজাদের কবিতার শরীর যেনো এক পাহাড়ি নদী, খলবল করে ছুটে চলে সমতলের বুক চিরে; ক্রমশ তা প্লাবিত করেছে, উর্বর করে তুলেছে আমাদের কাব্যাঙ্গন।
খুব কম কবিই তার প্রথম কাব্যগ্রন্থে নিজস্ব একটি কাব্যভাষা তৈরি করতে পারেন। নিজস্ব কাব্যভাষা কেবল বই পড়ে তৈরি হয় না, এজন্য দরকার অভিজ্ঞতা এবং পৃথিবী, পরিবেশ ও প্রতিবেশকে দেখার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। কবি আবিদ আজাদের সেই অভিজ্ঞতা এবং চোখ ছিলো বলেই তিনি ‘ঘাসের ঘটনা’ দিয়েই কাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি ঘটিয়ে ফেলেছেন। এই দক্ষতাই তাকে বাংলা ভাষার একজন অনন্যসাধারণ কবি করে তোলে।
কবিতায় নতুন নতুন চমক তৈরিতে আবিদ আজাদ ছিলেন তার সামসময়িক কবিদের মধ্যে সবচেয়ে সিদ্ধহস্ত। অপ্রচলিত বিষয়, শব্দ, পঙক্তিবিন্যাস সবই পাওয়া যায় আবিদ আজাদের কবিতায়। এমন কি তিনি মৃদু গালাগালিও কবিতায় ব্যবহার করেছেন খুব দক্ষতার সাথে।
তার কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্য ‘আমার মন কেমন করে’, ‘বনতরুদের মর্ম’, ‘শীতের রচনাবলী’, ‘আবিদ আজাদের প্রেমের কবিতা’, ‘তোমাদের উঠোনে কি বৃষ্টি নামে’, ‘রেলগাড়ি থামে’, ‘আরো বেশি কুয়াশার দিকে’, ‘হাসপাতালে লেখা’ উল্লেখযোগ্য।
একটি ভাষার কাব্যসাহিত্যে নতুন কিছু যোগ করতে না পারলে কেউ শক্তিমান কবি হয়ে উঠতে পারেন না। আবিদ আজাদের বলার ভঙ্গিটি সত্তরের দশককে পূর্ববর্তী কবিতার ধারা থেকে ভিন্ন। দক্ষ নাবিকের মতোই তিনি নিষ্ঠার সাথে কবিতায় নতুন ছন্দতরঙ্গ তৈরি করেছেন।
‘এইবেলা’, ‘রূপকথা’ আবিদ আজাদের লেখা অন্যতম উপন্যাস। এছাড়া তিনি সাহিত্যের কাগজ ‘শিল্পতরু’র সম্পাদক ছিলেন।
আধানাগরিক জীবনকে উপজীব্য করে তার বিষয়বস্তুর ঘূর্ণাবর্ত কিন্তু সত্তরের যে নিজস্বতা, যে উচ্চকণ্ঠ, যে দামামা, যে দ্রোহ তা থেকে মোটেও বিচ্ছিন্ন থাকেননি কবি আবিদ আজাদ। আমরা অনেক ছন্দ সচেতন কবির কবিতায় শুদ্ধ ছন্দ ঠিকই পাই কিন্তু কবিতা পাই না, পাই কিছু আরোপিত শব্দরাজি। কিন্তু আবিদ আজাদ যেনো এক জাদুকর, তার হাতে স্বতঃস্ফূর্ত ভাষাটি বাঙময় হয়ে ওঠে সঠিক ছন্দে।
সত্তর দশকের যে কয়জন কবি আছেন তার মধ্যে আবিদ আজাদ অন্যতম। কেননা আবিদ আজাদের কবিতায় এক ধরনের ভিন্ন স্বাদ রয়েছে। তার কবিতা বোঝে না এমন পাঠক খুব কমই আছেন। যে কবি সমাজের জন্য কবিতা লেখে না, যে কবি মানুষের জন্য কবিতা লেখে না, যে কবি দেশের জন্য কবিতা লেখে না- সে প্রকৃত কবি নয়। আবিদ আজাদ ছিলেন মানুষের কবি, তিনি মানুষের জন্যই লিখেছেন অসংখ্য কবিতাÑ
‘ও ভাবিজান সত্যি তাকে বুঝতে পেরেছিলে?
কি বার ছিল সেদিন বলো আছে তোমার মনে?
নিরুদ্দেশের থেকে হঠাৎ যে বার ফিরে এসে
দিঘির ঘাটে অজু করে ঘাট পাড়ে সে নামাজ পড়েছিল?’
(ও ভাবিজান সত্যি তুমি চিনতে পেরেছিলে?- আবিদ আজাদ)
যে কবিতার কোন অর্থ নেই, যে কবিতা পাঠক বুঝে না- তাকে কবিতা বলে না। কবিতা হলো মনের তৃপ্তি। আর মনের তৃপ্তি মেটানোর মতো কবিদের মধ্যে আবিদ আজাদ একজন।
কবিতার জন্য আবিদ আজাদ বঙ্গবন্ধু সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৬), শহীদ জিয়া স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৩), আমি তুমি ও সে পুরস্কার (১৯৮৪), চারণ সাহিত্য পুরস্কার(১৯৮৬), আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার(১৯৮৯), মাইকেল মধুসূদন একাডেমি পুরস্কার (১৯৯৪, পশ্চিমবঙ্গ), ও মরণোত্তর সা’দত আলি আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার (২০১৮) লাভ করেন।
২০০৫ সালের ২২ মার্চ মাত্র ৫২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন এই শক্তিমান কবি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।