Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাংলাদেশের কবিতায় সুরিয়ালিজম

ড. মুসাফির নজরুল | প্রকাশের সময় : ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০৩ এএম

পূর্ব প্রকাশের পর : শামসুর রাহমানের কবিতায় পরাবাস্তবতার প্রয়োগ লক্ষণীয়। তাঁর কবিতায় এক হিংস্র সময়ের গহ্বরে পরিব্যাপ্ত নৈঃসঙ্গ্য ও শূন্যতাবোধ প্রতিফলিত হয়েছে : “জানতাম তোমার চোখে একদা জারুলের বন/ফেলেছে সম্পন্ন ছায়া, রাত্রির নদীর মতো শাড়ি/শরীরের চরে অন্ধকারে জাগিয়েছে অপরূপ/রোদ্রের জেঅয়অর কতো। সবুজ পাতায় মেশা টিয়ে/তোমার ইচ্ছার ফল লাল ঠোঁটে বিঁধে নিয়ে দূরে/চরাচরে আত্মলোপী অলীক নির্দেশ।”(কোন পরিচিতাকে, প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যূর আগে, শামসুর রাহমান) বা, “গুচ্ছ গুচ্ছ রক্ত করবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের/জলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট /উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।”(আসাদের শার্ট, নিজ বাসভূমে, শামসুর রাহমান)
আল মাহমুদের কবিতায় পরাবাস্তবতার চিত্র ফুটে উঠেছে। তাঁর অনেক কবিতায় ব্যক্তিমনের অর্ন্তলোক উদ্ঘাটনের চেষ্টা লক্ষণীয়। জীবনের নির্লিপ্ত বাস্তবতার চেয়ে আলো আঁধারীর কুহুক যেন মূর্ত হয়েছে তার কবিতায় : “নদীর ভিতরে যেন উষ্ণ এক নদী স্নান করে/তিতাসের স্বচ্ছ জলে প্রক্ষালণে নেমেছে তিতাসই/নিজের শাপলা লয়ে খেলে নদী নদীর ভিতরে/ঠাট্টা বা বিদ্রুপ নেই, নেই শ্যেনচক্ষু, নেই চারণের বাঁশি। (নদীর ভিতরে নদী, নদীর ভিতরে নদী, আল মাহমুদ) বা, “অস্তমিত শতাব্দীর শেষ রশ্মি তোমার চিবুকে/ছায়া ও কায়ার মতো স্পর্শ দিয়ে নামে অন্ধকার/লাফায় নুনের ঢেউ। রক্তাম্বর জলধির বুকে/আবার নামের ধ্বনি, কার নাম ? সেও কি তোমার।” (শতাব্দীর শেষ রশ্মি, দ্বিতীয় ভাঙন, আল মাহমুদ)
শহীদ কাদরীর কবিতায় সমকালীন সমাজসত্যের অন্বেষণ থাকলেও কোন কোন কবিতায় তিনি বিচরণ করেছেন পরাবাস্তবতার জগতে। অবলীলায় মন্থন করেছেন অধরা বস্তুতে : “শুনেছি জ্যোৎস্না শুধু ধ্যান মৌন পাহাড়ের চূড়ায় কোনো/ত্রিশুলদেহ একাকী দরবেশ কিম্বা হিমালয়ের পাদদেশে,/তরাই জঙ্গলের অন্ধকারে, ডোরাকাটা বাঘের হলুদ শরীর নয়,/বরং ঘরের ছাদ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পোষমানা পায়রা তখন ওড়ে,তখনও জন্মায় জ্যোৎস্না ; ঝ’রে পড়ে গৃহস্থের সরল উদ্যানে।”(একবার দূর বাল্যকালে, শহীদ কাদরী) বা, “জ্যোৎস্নায় বিব্রত বাগানের ফুলগুলো অফুরন্ত/ হাওয়ার আশ্চর্য আবিষ্কার করে নিয়ে/চোখের বিষাদ আমি বদ্লেনি আর হতাশারে/নিঃশব্দে বিছিয়ে রাখি বকুল তলায়।” (নশ্বর জ্যোৎস্নায়, শহীদ কাদরী)
বাংলাদেশের কবিতায় আবদুল মান্নান সৈয়দের হাতে পরাবাস্তববাদ নবরূপ লাভ করেছে। তাঁর বিভিন্ন কবিতায় কালোত্তীর্ণ চিন্তার যুক্তিতে বিভাসিত। “পরাবাস্তববাদ রোমান্টিকতার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে এমন দাবী ভিত্তিহীন মনে হয় এজন্য যে এ ধরনের কাব্যতত্ত্ব কমবেশী রোমান্টিকতারই অপরপিঠ-কবিতার বিশদ বিশ্লেষণে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আসলে এদর অভিনবত্বটুকু খাঁটি, খাঁটি প্রচলিত কাব্যরীতি অস্বীকার করে অর্ন্তজগত এবং বর্হিজগকে একাকার করে কবিকে স্বপ্নের মায়াবী ভূবনে পৌঁছাতে চেয়েছে। পরাবাস্তবতায় তাই আপাত-বাস্তবতাই প্রতিফলিত হয়েছে, জীবন বিচ্ছিন্নতা নিয়ে বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে সে আবছা রোমান্টিকতার আলো-আাঁধারে পৌঁছেছে। ক্রিস্টোফার কডওয়েলের বিচারে ‘বুর্জোয়াতন্ত্রের অবশেষ সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি পরাবাস্তবতা।” (আহমদ রফিক, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-৭৫)। মান্নান সৈয়দের ‘জীবনানন্দ’ নামক কবিতায় তিনি জীবনানন্দকে বিভিন্ন প্রেক্ষণ বিন্দুতে দাঁড়িয়ে অনুধাবন করেছেন। এ অনুধাবনের প্রক্ষেপ আর বর্ণনাভঙ্গি পরাবাস্তব চেতনা সমৃদ্ধ : “দেখি তাঁর চুলে রাত্রি থেমে আছে/ চোখের সবুজ প্রিজমের ভিতর থেকে লাফিয়ে পড়েছে ফড়িং/হেমন্তের শিশিরের শুই ঘিরে ধরেছে তাঁর পদযুগল/কোন আদিম দেবতার কাছে নতজানু ধূসর মানুষের মতো/দেখি তাঁর বিড়বিড় স্বাগত উচ্চারণ থেকে বেরিয়ে আসছে সান্ধ্যাবেলার সবগুলো তারা/দেখি তার পাঞ্জবীর ঢোল পকেটে উঁকি দিচ্ছে চাঁদ।”(জীবনানন্দ, আবদুল মান্নান সৈয়দ)
আবদুল মান্নান সৈয়দ পরাবাস্তববাদী চাতুর্যকে সবিশেষ দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন তার বিভিন্ন কবিতায়। তাঁর ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ (১৯৬৭), ‘জ্যোৎস্না রৌদ্রের চিকিৎসার’ (১৯৬৯), পরাবাস্তববাদী কবিতা’ (১৯৮২) প্রভৃতি গ্রন্থের অসংখ্য কবিতায় পরাবাস্তববাদের জগতে নিবিড়ভাবে পদচারণা করেছেন। বিংশ শতব্দীর প্রথম দশকে গিওম আপলিনেয়ার বা আন্দ্রে বে্রঁতো ফরাসী সাহিত্যে পরাবাস্তববাদের সুর তুলেছিলেন; বাংলা সাহিত্যে ঠিক পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এসে আবদুল মান্নান সৈয়দের হাতে সে ধারার পূর্ণ যৌবন লাভ করে। ইতিপূর্র্বে জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, অমীয় চক্রবর্তীও পরাবাস্তববাদ সাহিত্য ধারায় বিচরণ করেছেন চরম সার্থকতায়। মূলত ত্রিশোত্তরকালে বাংলা সাহিত্যে ইউরোপীয় ভাবধারার যে জোয়ার বয়ে গিয়েছিল; সে জোয়ারে তরণীর সফল মাঝি ছিলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ। মান্নান সৈয়দ প্রসঙ্গে খোন্দকার আশরাফ হোসেন তাঁর ‘বাংলাদেশের কবিতা অন্তরঙ্গ অবলোকন’ গ্রন্থে বলেছেন “আবদুল মান্নান সৈয়দ পুনর্বার কুয়াশার মধ্যে প্রবৃষ্ট হন ‘পরাবাস্তব কবিতা’ পর্ব থেকে। কুয়াশা রূপ পরিগ্রহ করে নারীর, আর লিবিডোলিপ্ততার মধ্যে চংক্রমিত হতে থাকে তার কাব্যশব্দাবলী, এবং তার মনে হয় : “এক অবিরল নদী/বইছে বইছে নীলিমা থেকে নিখিলের হৃদয় অবধি/নারী তুমি তার সারাৎসার .../তোমার হৃদয় আনে পৃথিবীর সমস্ত সুস্বাদ”(নারী, আবদুল মান্নান সৈয়দ)
আবদুল মান্নান সৈয়দ বাংলাদেশের কবিতায় পরাবাস্তবতা বিনির্মাণে একটি বিশেষ স্থান আয়ত্ত্ব করতে সক্ষম হয়েছেন। এতদ্ প্রসঙ্গে খন্দকার আশরাফ হোসেনের উক্তি স্মরণীয় : “আবদুল মান্নান সৈয়দই সম্ভবত একমাত্র কবি যিনি একটি নির্মোহকে, একটি স্বয়ংসৃষ্ট গম্বুজের নিরালোক নিভৃতিকে, নিজেকে রক্ষা করেছেন বর্হিজগতের রোদ্র থেকে। তাঁর পরাবাস্তব কবিতাসমূহ নিজেরাই নিজেদেরকে চংক্রমণ করেছে বহুকাল এবং ঐ কবি বাংলাদেশের কবিদের মধ্যে সবচেয়ে কম সমকালস্পৃষ্ট। আবদুল মান্নান সৈয়দের নিভৃত শিশিরচারিতা তাকে আলাদা করেছে অন্য কবিদের থেকে।......তাই মান্নানের সমকালীনরা যখন জনরুচির বিবিধ উপাচারে কবিতাকে সাজাচ্ছিলেন তখনও ঐ সৈয়দ থেকেছেন তাঁর নীলিমার চাষাবাদে ব্যাপৃত, নগ্নপায়ে শিশিরসিঞ্চিত চেতনাভূমিতে একাকী পরিব্রাজনরত।”(খন্দকার আশরাফ হোসেন, বাংলাদেশের কবিতা অন্তরঙ্গ অবলোকন, ভূমিকা, পৃষ্ঠা-১১ )
আবিদ আজাদের কবিতায় পরাবাস্তবতার চিত্র বিচিত্র আঙ্গিকে প্রতিফলিত হয়েছে। গ্রীবর বিনম্র নীরবভঙ্গিমা তিনি দেখার অবকাশ পাননি তিনিদেখেছেন সচল উষ্ণ গ্রীবার তৃষ্ণার্ত চঞ্চলতা। এ এক আশ্চর্য আবেগ, ভালোবাসার মধ্যেও রক্তের চঞ্চল গতি। তার কবিতায় তীব্র আবেগ ও গভীর বিশ্বাসের অন্তরাবেগ জীবন্ত হয়ে উঠেছে। “পাড়াগার জ্যোৎস্না নদীর মতো বয়ে যাওয়া, পূর্ণিমা রাত্রির/নিঃসঙ্গ কালভার্টের ওপর রাম দা নিয়ে বসে থাকা ডাকাত দলের ছায়া/শাহাজাদীর সাদা পরিধেও বস্ত্রাদির মতো সাপের ছলম,/গঞ্জের সণ্ধ্যায় বাজারের মুখে শুয়ে থাকা/অর্ধ পঙ্গু দু’টি ভিখারির ভাগাভাগি করা সান্ধ্য জ্যোৎস্না..। (আমাদের কবিতা, আবিদ আজাদ) বা, ‘ঘাষের ঘটনা’ কাব্যের ‘জন্মস্বর’ কবিতায় : “পথের পাশের জিগা-গাছের ডালে তখন চড়চড়ে করে রোদ উঠছিল/কচুর পাতার কোষের মধ্যে খণ্ড খণ্ড রূপালী আগুন/ঘাসে ঘাসে নিঃশব্দ চাতচিক্য ঝরানো গুচ্ছ গুচ্ছ আলজিভ/ এইভাবে আমার রক্ত প্রহর শুরু হয়েছিল। (জন্মস্বর, ঘাসের ঘটনা, আবিদ আজাদ)
সাহিত্যে পরাবাস্তব বিক্ষা বাস্তবের চেয়ে এক সভ্যতর জগৎ নির্মাণের চেষ্টা, মনোরোকের প্রভাবে বাস্তবতার পুনঃনির্মাণে ’সুররিয়ালিজমে‘র বিশ্বজনীনতা নাস্তিতে নয়; অস্তিবাচকতায়। অবচেতন মনের মধ্য দিয়ে এ অনুভব আবিস্কার করে নেয় আমাদের প্রতিদিনের পৃথিবীর অন্তবালবর্তী এক সত্যতার বাস্তবতা। ‘ব্যক্তিক ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের মত প্রচলিত চিন্তা ও ফর্মের মুক্তিই ছিলো পরাবাস্তবতার মূল কথা। ‘তবে এ ক্ষেত্রে মুক্তির চেয়ে পরিবর্তন কথাটি অধিকতর প্রযোজ্য’।
পরিশেষে একথা নিসন্দেহে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশের কবিতায় পরাবাস্তববাদের ধারায় জীবনানন্দ দাশ যেভাবে এক স্বতন্ত্র ধারা প্রবর্তন করে একটি নতুন ধারার সৃষ্টি করেছিলেন তা আজও বহমান রয়েছে। বর্তমান দশকেও অনেকেই কাজ করছেন পরাবাস্তবতার জগতে। ফলে, এ ধারার পরিধির বিস্তৃতি বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাংলাদেশের কবিতায় সুরিয়ালিজম
আরও পড়ুন