পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ভারতের সাথে বাংলাদেশের কি কোনো অমিমাংসিত বিষয় আছে? কিংবা কোনো কিছু পাওয়ার আছে? এমন প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, নেই। পাঠকদের অনেকে মনে করতে পারেন, নেই মানে কি! কত কিছুই তো পাওয়ার আছে। নদ-নদীর পানির হিস্যা, সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা, বাণিজ্যিক সমতা, বন্ধুত্বের সমআচরণ আরও কত কি! এসবই ঠিক আছে। তবে এ বিষয়টি বুঝতে হবে, বাংলাদেশের সাথে ভারতের যে আচরণ তাতে এ বিষয়গুলো কখনোই ফুটে ওঠে না। তার আচরণে এটাই পরিদৃষ্ট হয়, আমাদের কাছ থেকে বাংলাদেশের কি পাওয়ার থাকতে পারে! বরং আমরাই বাংলাদেশের কাছ থেকে অনেক কিছু পাই, তা আমাদের নিতে হবে এবং আমরা তা নিচ্ছি। বাংলাদেশ আমাদেরকে দিতে বাধ্য। আমাদের সরকারও তা মেনে নিচ্ছে। সে-ও মনে করছে, ভারত যা চাইবে তাই দিতে হবে এবং আমরা তা দিচ্ছি। এক্ষেত্রে সরকারের সান্ত¦না হচ্ছে, ভারত আমাদের খুব ভাল বন্ধু। এমন বন্ধুত্ব পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। আর কেউ এমন বন্ধুত্বের নজির সৃষ্টিও করতে পারবে না। বন্ধুর জন্য আমরা জীবনও দিতে পারব। আর বন্ধুর চাওয়া-পাওয়া তো কিছুই না। সরকারের এমন আচরণে দেশের মানুষ দুঃখিত, ব্যথিত হলেও কিছু করার নেই। সে জানে কিছুদিন একটু হইচই করবে, তারপর থেমে যাবে। বিগত বছরগুলোতে তাই হয়েছে। এটা নতুন কিছু নয়। তার মনোভাব এমন, আমরা যা করছি বুঝে শুনেই করছি। দেশের মানুষ অবুঝ বলেই মনে করছে, আমরা ভারতকে সব দিয়ে দিচ্ছি। এসব মানুষ বুঝতে চায় না, ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক এখন কত মধুর! এমন সম্পর্ক বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কেউ গড়ে তুলতে পারেনি। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে দিয়েই যেতে হবে। দেশের সব শ্রেণীর মানুষকে এ সম্পর্কের মমার্থ বুঝতে হবে। তবে দেশের অবুঝ মানুষরা মাঝে মাঝেই ভারতের সাথে সরকারের এমন মধুর আচরণ যেন সহ্য করতে পারে না। তারা সরকারের সামালোচনা করে অসহনীয় নানা কথা বলে। আর বললেই সরকার পাল্টা সমালোচনা করে ধুয়ে দেয়। এই যে বুয়েটের মেধাবী ছেলেটি ভারতকে আমাদের বন্দর ব্যবহারের সুবিধা দেয়া নিয়ে যুক্তিটুক্তি তুলে ধরে তার ফেসবুকে পোস্ট দিল, তাতে কি হলো? তার জীবনটাই চলে গেল।
দুই.
সম্প্রতি ভারতের সাথে চারটি চুক্তি হওয়া নিয়ে বিরোধী দল ও ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বাধীন জোটের নেতারা অসন্তোষ ও সমালোচনা করছেন। বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপি বহুদিন পর ঝেরে কেঁশে ভারতের সাথে চুক্তির বিরোধিতা করা শুরু করেছে। তাদের বহু পুরনো ভারতবিরোধী শ্লোগান নতুন করে দেয়া শুরু করেছে। দলটির নেতারা ভারতের সাথে বিভিন্ন চুক্তিকে দেশের ‘অস্তিত্ব’ বিলিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন। তারা বলেছেন, ক্ষমতায় টিকে থাকতে সরকার ভারতের সঙ্গে জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি করেছে। সরকারের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ভারতকে বুঝতে হবে, কিছু পেতে গেলে অবশ্যই তাদের কিছু দিতে হয়। এটা যদি ভারত না বুঝে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের সাথে তার সম্পর্ক যে উচ্চতায় পৌঁছেছে স্বাভাবিকভাবে তা বাধাগ্রস্ত হবে। ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেছেন, ভারতের সঙ্গে সম্প্রতি সম্পাদিত সমঝোতা স্মারক ও ফেনী নদীর পানি চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে মতদ্বৈততা ও ভিন্নতা সংগত ও স্বাভাবিক। অন্যদিকে সরকার স্বাভাবিকভাবেই এসব চুক্তির পক্ষে কথা বলবে। তবে সরকারের নীতিনির্ধারকদের কারো কারো বক্তব্য এমন, যে বক্তব্য ভারতের পক্ষ থেকে দেয়ার কথা, তা তারাই দিয়ে দিচ্ছেন। তাদের বক্তব্যে মনে হওয়া স্বাভাবিক, ভারতকে দিতে পেরে সরকার খুবই খুশি। যেমন সীমান্তে ভারতের বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশি হত্যা নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন, সীমান্ত হত্যা বন্ধে ঢালাওভাবে ভারতকে দোষারোপ না করে নিজেদের দায়িত্বশীল হতে হবে। তার এ কথার মমার্থ হচ্ছে, সীমান্তে বিএসএফ বাংলাদেশিদের গুলি করে হত্যা করলে তাতে তাদের কোনো দোষ নেই। সব দোষ বাংলাদেশীদের। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্বের যে কয়টি বিপজ্জনক ও রক্তক্ষয়ী সীমান্ত রয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত অন্যতম। এ সীমান্তে গুলি করে যত মানুষ মারা হয়, বিশ্বের আর কোনো দেশের সীমান্তে তা হয় না। প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে সরকার যে গর্ব করে এবং ভারতকে সবচেয়ে ভাল বন্ধু হিসেবে মানে, তাহলে ভারত কেন সীমান্তে বাংলাদেশের মানুষকে হত্যা করে? বন্ধু দেশের মানুষ হত্যা করা কি বন্ধুর কাজ? বন্ধুত্বের নিদর্শন কি হত্যা করা? সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশি হত্যা বিষয় নিয়ে এতদিন সরকারের দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে তেমন কোনো বক্তব্য দিতে দেখা যায়নি। সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রী বক্তব্য দিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সীমান্ত হত্যা বন্ধে ঢালাওভাবে ভারতকে দোষারোপ করা যাবে না। নিজেদেরও দায়িত্বশীল হতে হবে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রী যখন এ কথা বলেন, তখন আর কি বলার থাকতে পারে! অর্থাৎ ভারত গুলি করবেই, আর আমাদের সেই গুলি এড়িয়ে চলতে হবে, না হয় মরতে হবে। ভারতের প্রতি সরকারের এমন নমনীয় থাকার কারণ কি? এ প্রশ্নের উত্তর সম্প্রতি বিবিসি’র প্রকাশিত দুইটি রিপোর্টের একটিতে পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনের এক জায়গায় উল্লেখ করা হয়, ‘অনেকের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের পরপর দুটি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনে জেতার পর ভারত আওয়ামী লীগ সরকারকে তুলনাবিহীন কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে গেছে। অনেকেই বলছেন, দুটি নির্বাচনের পর আন্তর্জাতিক যে কোনো চাপ সৃষ্টির বিপরীতে ভারতের অবস্থান ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে। এর ফলে আওয়ামী লীগ দল হিসেবে উপকৃত হয়েছে, টানা ক্ষমতায় টিকে আছে কিন্তু দেশের স্বার্থে দর কষাকষিতে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ।’ অর্থাৎ সরকার ভারতের কাছ থেকে ক্ষমতায় টিকে থাকার সহায়তা পাওয়ায় তার লাভ হলেও দেশের কোনো উপকার হয়নি। অন্যদিকে ভারত সরকার এই সাপোর্টের বিনিময়ে তার দেশের সব স্বার্থ হাসিল করে নিয়েছে এবং নিচ্ছে। সরকারের নৈতিক শক্তি কম থাকায় ভারত যা চাচ্ছে তা বিরোধিতা করার শক্তি হারিয়েছে এবং তা দিয়ে দিচ্ছে। সরকারের কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা টেনে এনে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত আমাদের সহায়তা করেছে, অসংখ্য মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে। সেই উপকারের কথা ভুলি কি করে! হ্যাঁ, উপকারীর উপকারের কথা অবশ্যই স্বীকার করা উচিত। তবে এর অর্থ কি এই, উপকারকারীর খবরদারি মেনে নিতে হবে এবং যা চাইবে তা দিয়ে দিতে হবে বা তার কথামতো চলতে হবে? উপকারের অর্থ কি কারো মাথা কিনে নেয়া? এ ধরনের স্বার্থবাদী উপকারকারী কি ভালো বন্ধু হতে পারে? যারা বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য জীবনবাজি রেখে রনাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তাদের অনেকের মুখে প্রায়ই একটা কথা শোনা যায়, পিন্ডি থেকে মুক্ত হয়ে দিল্লীর গোলামী করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি। দুঃখের বিষয়, মুক্তিযোদ্ধাদের এমন আক্ষেপ বাংলাদেশের কোনো শাসক গোষ্ঠীই হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেনি। তাদের কথাবর্তায় এমন ভাব পরিলক্ষিত হয়, দিল্লীর সুনজর না থাকলে কস্মিনকালেও ক্ষমতায় থাকা বা যাওয়া যাবে না। কী অসম্মানজনক ও আত্মমর্যাদাহীন মনোভাব! অথচ আমরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি শুধু জাতি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম হিসেবে মাথা উঁচু করে বিশ্বের বুকে বসবাস করার জন্য, অন্য কারো আধিপত্যবাদের কবলে পড়ার জন্য নয়। ভারত আমাদের সাথে যে আচরণ করছে তাতে যে কারো মনে হতে পারে, আমরা যেন পিন্ডির জ্বলন্ত উনুন থেকে দিল্লীর তপ্ত কড়াইয়ে পড়ে ভাজা ভাজা হচ্ছি।
তিন.
আমরা যদি বিগত এক দশকের মধ্যে ভারতের সাথে বাংলাদেশের যেসব চুক্তি ও এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেগুলোর দিকে দৃষ্টি দেই তাহলে দেখব তাতে বাংলাদেশের স্বার্থে কোনো কিছুই নেই। সবই ভারতের আগ্রহ ও স্বার্থে হয়েছে। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন তখন ৭টি চুক্তি এবং ১০টি এমওইউ ও দলিল স্বাক্ষরিত হয়ছিল। চুক্তি ৭টি হচ্ছে, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য (নবায়ন), উপকূলীয় জাহাজ চলাচল, আভ্যন্তরীণ নৌ ট্রানজিট ও বাণিজ্য প্রোটোকল (নবায়ন), বিএসটিআই ও ব্যুরো অব ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডসের মধ্যে মানবিষয়ক সহযোগিতা, ঢাকা-শিলং-গৌহাটি ও কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস সেবা এবং আখাউড়ায় ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ ইজারা। ১০টি এমওইউ-এর মধ্যে রয়েছে, উপকূলরক্ষী বাহিনী বিষয়ক, মানবপাচার, চোরাচালানা ও জাল নোট প্রতিরোধ, বাংলাদেশকে ২০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ, ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে সাগর অর্থনীতি ও সমুদ্রবিষয়ক সহযোগিতা, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার, সার্কের ইন্ডিয়া এন্ডোমেন্ট ফর ক্লাইমেট চেঞ্জের আওতায় একটি প্রকল্প, ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ভারতের কাউন্সিল অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রবিজ্ঞানবিষয়ক যৌথ গবেষণা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েরর সঙ্গে ভারতের জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতা সংক্রান্ত। দলিল বিনিময়ের মধ্যে রয়েছে, ১৯৭৪ সালের স্থল সীমান্ত চুক্তি ও এর ২০১১ সালের প্রোটোকল অনুসমর্থনে ইনস্ট্রুমেন্ট বিনিময়, ১৯৭৪ সালের স্থল সীমান্ত চুক্তি ও এর ২০১১ সালের প্রোটোকল বাস্তবায়নের উপায় বিষয়ে চিঠি বিনিময়, সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচি, শিক্ষা খাতে বাংলাদেশ-ভারত সহযোগিতায় আগ্রহবিষয়ক বিবৃতি স্বাক্ষর এবং বাংলাদেশে ভারতের লাইফ ইনস্যুরেন্স করপোরেশনকে কার্যক্রম চালাতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের সম্মতিপত্র হস্তান্তর। তার আগে ২০১১ সালে বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার বেশ চড়া সুদ ও শর্তে ঋণ দিয়েছিল। সর্বশেষ এ মাসের শুরুতে সম্পাদিত চারটি চুক্তির মধ্যে রয়েছে সমুদ্র বন্দর ব্যবহার, ফেনী নদী থেকে ১.৮২ কিউসেক পানি ভারতকে প্রদান, এলপিজি গ্যাস রপ্তানি, সমুদ্র উপকূলে রাডার স্থাপন। বিগত এক দশকে উল্লেখযোগ্য এসব চুক্তি ও এমওইউ’তে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটা রয়েছে তা পর্যবেক্ষণ করলে তেমন কিছুই পাওয়া যায় না। একটি উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তির মধ্যে রয়েছে ৪১ বছর পর স্থল সীমান্ত চুক্তির বাস্তাবায়ন। তবে এ নিয়ে বিশ্লেষকদের যুক্তিও রয়েছে। তারা বলছেন, এ চুক্তি বাস্তবায়ন কোনো নতুন পাওয়া ছিল না। শুধু পুরনো চুক্তির বাস্তবায়ন ছিল। যে চুক্তির বাস্তবায়ণ হওয়ার কথা ছিল ৪২ বছর আগে। বাংলাদেশের জীবনমরণ সমস্যা হয়ে থাকা যে তিস্তা চুক্তিÑএটাই ছিল ভারতের কাছ থেকে অন্যতম প্রধান পাওয়া। এই চুক্তিটি ভারত কোনোভাবেই করছে না। কবে হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। স্থল সীমান্ত চুক্তির মতো যদি ৪২ বছর লেগে যায় তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। অন্যদিকে বাংলাদেশ যে গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের মাধ্যমে পানি ধরে রেখে নিজেদের ব্যবস্থা নিজে করবে, এ ব্যাপারেও ভারতের আপত্তির কারণে ব্যারেজটি নির্মাণ বন্ধ হয়ে রয়েছে। এখন দেখা যাক, বাংলাদেশ বিভিন্ন চুক্তি করায় ভারত কিভাবে লাভবান হচ্ছে তার কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। মোদির সফরের সময় বাংলাদেশকে যে ২০০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার চুক্তি হয়েছে তার শর্তানুযায়ী, ঋণের অর্থে নেয়া প্রকল্পগুলোর অন্তত ৭৫ শতাংশ যন্ত্রপাতি ও সেবা ভারত থেকে নিতে হবে। এসব সেবা ও পণ্যর উৎপাদন প্রক্রিয়া ভারত থেকে নেয়া হবে। ঋণের টাকায় নেয়া প্রকল্পগুলোকে কেন্দ্র করে ৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বন্দর ব্যবহারের সুবিধা কাজে লাগিয়ে ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে ব্যাপক উন্নয়ন কাজ চালাতে পারবে। সমুদ্র উপকূলে রাডার স্থাপনের মাধ্যমে সে তার নিরাপত্তা ও তার প্রতিপক্ষের গতিবিধি নজরদারি করতে পারবে। এতে বাংলাদেশ তার অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর বিরাগভাজন হতে পারে। কয়েক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভারতের পূর্বাঞ্চলে খাদ্য সরবরাহের জন্য ভারতকে বন্দর ব্যবহারের সুবিধা দেয়া হয়েছে। ত্রিপুরার পালাটানায় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য আশুগঞ্জ বন্দর দিয়ে ভারি যন্ত্রপাতি নিতে বাংলাদেশের সড়কের ক্ষতিসাধন করেও অনুমতি দেয়া হয়েছে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারতের সুবিধা অনুযায়ী সবই দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে এবং তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে তার বাণিজ্যিক কার্যক্রম সম্প্রসারিত হবে। এমন আরও অনেক চুক্তি ও এমওইউ রয়েছে যেগুলো কেবল ভারতের স্বার্থই রক্ষা করবে। বাংলাশের তেমন কোনো উপকারই হবে না। অর্থাৎ ভারতের স্বার্থে তার যা যা প্রয়োজন সে তার সবই আদায় করে নিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও তার যা প্রয়োজন হবে তা আদায় করে নেবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের একমাত্র চাওয়া তিস্তা চুক্তিটি ভারত আটকে রেখেছে। এই হচ্ছে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সর্বোচ্চ সুসম্পর্কের নমুনা। বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারতের এ ধরনের আচরণের মধ্যে এমন একটা প্রবণতা রয়েছে যে, বাংলাদেশ যেন ভারত নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এতে সে যেভাবে বলবে বাংলাদেশকেও সেভাবেই করতে হবে। শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার কারণে বাংলাদেশকে ভয়াবহ খেসারত দিতে হচ্ছে। এটা দেশের মানুষের দুর্ভাগ্য ও নিয়তি ছাড়া আর কি হতে পারে!
চার.
বাংলাদেশ সরকারের সাথে ভারত সরকারের অত্যন্ত মধুর সম্পর্কের কথা অস্বীকারের উপায় নেই। তবে বাংলাদেশের মানুষের সাথে ভারতের সেরা সম্পর্ক কিনা, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ, সরকার জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে ভারতের সমর্থনকেই যে বেশি গুরুত্ব দেয়, তা বরাবরই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ নিয়ে জবাবদিহির জয়াগা জাতীয় সংসদেও কোনো আলাপ-আলোচনা হয় না। তার অর্থ হচ্ছে, সরকার জনগণের মতামতের কোনো গুরুত্ব দেয় না। জনগণ কী মনে করলো না করলো, তাতে সরকারের কিছু যায় আসে না। তার মূল স্পিরিট হচ্ছে, যে কোনো কিছুর বিনিময়ে ক্ষমতায় থাকা। আর এই স্পিরিট হচ্ছে ভারত। স্বাভাবিকভাবেই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ দেশের ন্যায্য দাবী-দাওয়া নিয়ে ভারতের সাথে দর কষাকষি না করে তার দাবী মোতাবেক সবকিছু দিয়ে দেবে। শুধু মাত্র ক্ষমতায় থাকার সমর্থন দেয়া নিয়ে দেশের অনেক ন্যায্য স্বার্থ বিসর্জন দেয়ার এমন নজির বিশ্বে আর কোথাও আছে কিনা আমাদের জানা নেই। যে কোনো সরকারের এ ধরনের আচরণ জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, প্রতিবেশী দেশের সাথে আমাদের জনগণ কখনোই মন্দ সম্পর্ক চায় না। তারা মনেপ্রাণে সুসম্পর্কই চায়। তবে এ সুসম্পর্কের ভিত্তি অবশ্যই সমমযার্দাপূর্ণ হওয়া বাঞ্চনীয়। এক বন্ধু খাবে, আরেক বন্ধু অভুক্ত থেকে যাবে-এটা কোনো বন্ধুত্বের নিদর্শন হতে পারে না। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক যেন অনেকটা এরকম হয়ে পড়েছে। ভারত বন্ধুত্বের কথা বলে তার ষোলকলা পূর্ণ করে চলেছে, আর আমরা না পাওয়ার বেদনায় হাহাকার করছি। তবে এক্ষেত্রে ভারতকে কৃতিত্ব দিতে হবে যে, সে তার দেশের জন্য যা দরকার সবই আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের ব্যর্থতা হচ্ছে, আমরা ন্যায্য কোনো কিছুই আদায় করতে পারিনি। শুধু মুখে মুখে বন্ধুত্বের সুউচ্চ সম্পর্ক নিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করছি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।