পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ইদানীং একের পর এক এমন সব কর্মকা- ঘটতে দেখা যাচ্ছে, তাতে বিস্মিত হচ্ছে সমগ্র বাংলাদেশের জনগণ। গত সোমবার দৈনিক ইনকিলাব-এর প্রথম পৃষ্ঠার প্রধান খবরের শিরোনাম ছিল: ‘সম্রাটের পতন’। কে এই সম্রাট? ঐ দিনের দৈনিক ইত্তেফাক এর প্রথম পৃষ্ঠার প্রধান খবরে মিলবে এই প্রশ্নের জবাব? দৈনিক ইত্তেফাক-এর প্রথম পৃষ্ঠার প্রধান খবরের শিরোনাম ছিল: ‘কারাগারে যুব লীগ নেতা সম্রাট’। ঐদিনই দৈনিক ইত্তেফাকের এর আরেকটি ছোট খবরের শিরোনাম ছিল: ‘যুবলীগ থেকে সম্রাট ও আরমান বহিষ্কার’।
এসব খবরে বুঝা যায়, শাসক দল আওয়ামী লীগের শাসনের সুযোগে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ফ্রন্টের নেতাদের বাড়াবাড়ি এতটা চরমে পৌঁছেছে যে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে আওয়ামী লীগের মুখরক্ষা আর সম্ভবপর হচ্ছিল না। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ফ্রন্টের নেতাদের এসব অকল্পনীয় বাড়াবাড়ির অন্তত একটি প্রমাণ মিলবে গত মঙ্গলবারের ইনকিলাব এর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি সংবাদের প্রধান শিরোনামে: ‘বুয়েট ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা’। এই সংবাদের উপ-শিরোনাম ছিল: ‘বাংলাদেশ-ভারত চুক্তি নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট : ছাত্র লীগের নৃশংসতা’।
এদিকে আওয়ামী লীগের দু’নম্বর নেতা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একদিকে বাংলাদেশ ভারত চুক্তির প্রতি সমর্থন দান এবং ভিন্নমতের অধিকারীকে পিটিয়ে হত্যার মৃদু নিন্দা জ্ঞাপনের লক্ষ্যে যা বলেছেন, তাও প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক ইনকিলাব এর মঙ্গলবার সংখ্যায়। সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ দুরূহ কাজটি করেছেন তিনি, যা প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক ইনকিলাবের গত মঙ্গলবারের প্রথম পৃষ্ঠায়, তবে ছোট সংবাদ হিসাবে। এ সংবাদের প্রধান শিরোনাম ছিল: ‘ভিন্নমতের কাউকে মেরে ফেলার অধিকার কারো নেই’। আর উপ-শিরোনাম ছিল: ‘প্রধানমন্ত্রীর সফরে অর্জনই বেশি’।
শাসক দল আওয়ামী লীগের এই দুই নম্বর নেতা ওবায়দুল কাদের কেন এটা জোর গলায় বলতে পারলেন না যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক দিল্লী সফরের পুরোটাই সফল? কারণ বাংলাদেশের জনগণ তাহলে তাঁকে মিথ্যা কথনের জন্য দায়ী করতো। জনগণের দৃষ্টিতে ফারাক্কার পর বাংলাদেশের প্রধান আশা ছিল দু’ দেশের অন্যতম অভিন্ন নদী তিস্তার পানি নিয়ে একটা চুক্তি স্বাক্ষরে সক্ষম হবেন শেখ হাসিনা তার সাম্প্রতিক দিল্লী সফরে। দেশবাসী জানেন, বাংলাদেশের জনগণের সে আশাবাদ বাস্তবে সফল হয়নি। শুধু সফল হয়নি বললেই সবটা বলা হবে না। উল্টা ফেনী নদীর পানি উত্তোলন করতে পারবে ভারত, এ আশ্বাসও তিনি দিয়ে এসেছেন তাঁর সাম্প্রতিক ভারত সফরে।
এসবের অর্থ শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ায়? দাঁড়ায় এই যে, ভারত তার স্বার্থ পুরোটাই আদায় করে নেয়ার নিশ্চয়তা পাবে। আর বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বার্থ তো আদায় করতে পারবেই না, তার জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ভারতের ফাঁকা আশ্বাস নিয়েই ভারতের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা স্থাপন করেই খুশি থাকতে হবে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যতদিন থাকে, ততদিন বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটাই আমরা দেখে আসছি সব সময়। এভাবেই বাংলাদেশে যতদিন আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে থাকে ততদিন বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক থাকে ভারতমুখী। ফলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দাবি করতে সক্ষম হন যে, বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক নতুন ‘উচ্চতায়’ পৌঁছেছে।
এই নতুন উচ্চতায় পৌঁছার নমুনা এবারও আমরা দেখতে পেলাম। যখন বাংলাদেশের জনগণ আশা করছিল, বহু প্রতীক্ষিত তিস্তার পানি নিয়ে একটা চুক্তি স্বাক্ষরে সক্ষম হবে, তখন তিস্তার পানির প্রশ্নে চুক্তি স্বাক্ষর না করেই বাংলাদেশকে খুশি থাকতে হবে। উল্টা ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহার করতে পারবে ভারত, এ আশ্বাসও ভারতকে দেয়া হয়েছে। এর পরও বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে আমরা একাধিকবার অতীতে লিখেছি।
ভারতের জাতীয় স্বার্থ পুরোটাই তাকে দিতে হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ভারতের মৌখিক আশ্বাসের উপরই বাংলাদেশকে খুশি থাকতে হবে। এটাই যদি হয় বাংলাদেশ-ভারতের সুসম্পর্কের নমুনা, তাহলে যতদিন আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে থাকে ততদিনই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নতুন ‘উচ্চতায়’ থাকে। যদিও দেশের জনগণ এটাকে সামান্যতম সমর্থন করে না।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে ভারত এসব লুকোচুরি লেখা শুরু করেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের প্রথম দিন থেকেই। আসলে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে শক্তিশালী হোক তা ভারত কোনো দিনই চায়নি। ভারত আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সৈন্য পাঠিয়ে সাহায্য দিয়েছিল, তার আসল উদ্দেশ্য ছিল একটি শক্তিশালী স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তানকে ভেঙ্গে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এ উভয় রাষ্ট্রকেই দুর্বল করে দেয়া।
ভারতের এই লক্ষ্যের প্রমাণ পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য দেয়ার নামে ভারত একাত্তরে যেসব ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে পাঠায়, তার একাংশকে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পরও বাংলাদেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলাদেশে রেখে দেয়।
একাত্তরের ইতিহাস সম্পর্কে যারা খবর রাখেন, তারা সাক্ষ্য দেবেন, একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে যারাই বাংলাদেশের অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাসায় গেছেন তাদের সকলকেই তিনি যত দ্রুত সম্ভব প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে যেতে পরামর্শ দিলেও তিনি নিজে কোথাও না গিয়ে বাসায় থেকে যান। ফলে তিনি পাকিস্তান বাহিনীর হাতে স্বেচ্ছায় ধরা দেন।
এর ফলে সমগ্র মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে কারাগারে আটক থাকেন।
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম লন্ডন যান। লন্ডন গিয়ে তিনি প্রথম জানতে পারেন, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পরও ভারতীয় বাহিনীর একাংশ অনির্দিষ্টকালে জন্য বাংলাদেশে রেখে দেয়া হয়েছে। এ খবর জানার পরই তিনি এ বিষয়ে তাঁর ইতিকর্তব্য ঠিক করে ফেলেন।
লন্ডন থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পথে নয়া দিল্লীতে স্বল্প বিরতিকালে প্রথম সুযোগেই তিনি তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সরাসরি প্রশ্ন করে বসেন, ম্যাডাম, আপনার বাহিনীকে আপনি বাংলাদেশ থেকে কখন ফিরিয়ে আনবেন? প্রত্যুত্তরে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, আপনি যখন বলবেন, তখনই। বলা বাহুল্য, বঙ্গবন্ধুর তখন বিশ্বব্যাপী যে বিপুল জনপ্রিয়তা, তাতে ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে অন্য কোনো জবাব দেয়াই সম্ভব ছিল না। এর ফলে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনী অপসারণ সহজ হয়ে পড়ে।
যদিও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশে সৈন্য পাঠিয়ে সাহায্য দেয়ার কারণে ভারত দাবি করতে শুরু করে যে, তারা বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র, কিন্তু এ দাবির পেছনে যে কোনো সত্যতা নেই, তার অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। এসব প্রমাণের অন্যতম অভিন্ন নদী গঙ্গা (পদ্মা) নদীর বাংলাদেশের সীমানার সামান্য উজানে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশকে মরুভূমিতে পরিণত করার পাশাপাশি বর্ষা মৌসুমে ফারাক্কা বাঁধের সবকটি গেট খুলে দিয়ে বাংলাদেশকে ডুবিয়ে মারার চক্রান্ত। তাছাড়া দুই দেশের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত অন্যতম তিস্তা নদীর উজানে গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তার প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করে আসছে ভারত। অথচ একাধিক দেশের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত কোনো নদীর পানির উপর উজান ও ভাটির উভয় দেশেরই অধিকার আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত।
এবারও ভারত বাংলাদেশের জনগণকে ডুবিয়ে মারার লক্ষ্যে বর্ষাকালে ফারাক্কা বাঁধের সবকটি গেট খুলে দিয়ে বাংলাদেশের এক বিরাট অংশকে ডুবিয়ে মারার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব ঘটনা প্রমাণ করে, ভারত যে দাবি করে, তারা বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র এ দাবির মূলে কোনো সত্যতা নেই। বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে উঠুক, ভারত যে তা চায় না তার প্রমাণ শুধু এখনই নয়, অতীতের বহু ঘটনায়ও তার প্রমাণ রয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকতেও এর প্রমাণ পেয়ে গেছেন। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার অত্যল্পকাল পর ১৯৭২ সালে লাহোরে একটি বিশ্বমুসলিম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সে সম্মেলনে বাংলাদেশকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু তথাকথিত বন্ধুরাষ্ট্র ভারত তার প্রবল বিরোধিতা করে। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু এ বিষয়ে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর পরামর্শ কামনা করেন। মওলানা ভাসানী সোজাসুজি উত্তর না দিয়ে বলেন, তুমি যদি স্বাধীন দেশের নেতা হয়ে থাক, তাহলে তোমার মনে যা চায় তাই করো। আর তুমি যদি ভারতের আশ্রিত রাষ্ট্রের নেতা হয়ে থাকো, তাহলে ভারত যা বলে তাই করো।
গঙ্গা নদী এবং তিস্তা নদীর বাইরে এবার ফেনী নদী থেকে অন্যায়ভাবে পানি প্রত্যাহার করে ভারত প্রমাণ করেছে, ভারতের নেতৃবৃন্দ কোনদিনই বাংলাদেশকে অন্তর থেকে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করেন না। ভারতের নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশকে কখনও যে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করেন না তার সর্বশেষ প্রমাণ পাওয়া গেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বশেষ দিল্লী সফরেও। সেখানে তিস্তা নদীর পানির মৌখিক আশ্বাস নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। বিপরীতে ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহারে ভারতকে সম্মতি দান করতে বাধ্য হয়েছেন। এসবই প্রমাণ করে, ভারতীয় নেতৃবৃন্দ কোনো দিনই বাংলাদেশকে অন্তর থেকে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করেন না।
এসবের পরও আমরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশে সৈন্য পাঠিয়ে সাহায্য দানের জন্য আমরা ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ। তবে আমাদের ভারতের প্রতি দুর্বল নেতৃবৃন্দকে সব সময়ই মনে রাখতে বলি, বন্ধুত্ব কখনও একতরফা হতে পারে না। সংশ্লিষ্ট দুই পক্ষকেই এ বিষয়ে আন্তরিক হতে হবে। শুধু মুখে নয়, বাস্তবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।