Inqilab Logo

শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

বাংলা গানে রজনী কান্ত সেন

জোবায়ের আলী জুয়েল | প্রকাশের সময় : ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই/ দীন-দুঃখিনী মা যে তোদের, তার বেশি আর সাধ্য নাই।
অথবা
ভিক্ষার চালে কাজ নাই, সে বড় অপমান/ মোটা হোক সে সোনা মোদের মায়ের ক্ষেতের ধান।
স্বদেশ প্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত এই বিখ্যাত গানের রচয়িতা ছিলেন কবি রজনী কান্ত সেন। সেকালে “কান্ত কবি” নামে তিনি সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন। বাঙালীর কণ্ঠে ঘরে ঘরে গীত হতো সেকালের এই বিখ্যাত গানগুলো। রজনী কান্ত সেনের গান বলতে আমরা বুঝি বিশ শতকের ত্রিশ, চল্লিশ দশকের কথা। এখন যাকে বলা হয় পুরোনো দিনের গান।
রজনীকান্ত সেনের জন্ম ১৮৬৫ সালের ২৬ জুলাই তৎকালীন পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার ভাঙ্গাবাড়ী গ্রামে। পিতা গুরু প্রসাদ সেন ছিলেন সেকালের সঙ্গীতঙ্গ গুণী ব্যক্তিত্ব ও বরিশালের নাম করা সাবজজ এবং ব্যক্তিত্বময়ী নারী মনো মোহিনী দেবীর তৃতীয় সন্তান ছিলেন রজনীকান্ত সেন। মানিকগঞ্জের তারক নাথ সেনের কন্যা হিরন্ময়ী দেবীর সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
রজনীকান্ত সেন কুচবিহার জেনকিন্স স্কুল থেকে ১৮৮৩ সালে এন্ট্রান্স, ১৮৮৫ সালে রাজশাহী কালেজ থেকে এফ, এ ১৮৮৯ সালে কোলকাতার সিটি কলেজ থেকে বি, এ ও ১৮৯৭ সালে বি, এল পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হন। পরবর্তী কালে তিনি রাজশাহী কোর্টে ওকালতি শুরু করেন। কিছুদিন তিনি নাটোর ও নওগাঁয় অস্থায়ী মুন্সেফ ও ছিলেন। বি, এল পরীক্ষা দেবার আগে থেকেই তার কবিতা ও গান রাজশাহী পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে।
রজনীকান্ত সেন শৈশব থেকেই পিতার নিকট সঙ্গীত শিক্ষা গ্রহন করেন এবং মাত্র ১৫ বছর বয়সে “কালী সঙ্গীত” রচনা করে কবিত্ব শক্তির পরিচয় দেন।
ওকালতি পেশায় প্রবেশ করলেও গানের নেশা, কবিতা ও রসব্যঙ্গ কাব্য লেখা তার পরবর্তীতে নেশা হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর কবিতা ও গানের বিষয়বস্তু প্রধানত ভক্তি ও দেশ প্রেমে উজ্জীবিত। রজনী কান্ত সেনের ভক্তি সঙ্গীত গুলি “কান্ত পদাবলী” নামে পরিচিত। তাঁর প্রথম কাব্য “গীতি বাণী” ১৯০২ সালে প্রকাশিত হয়। এছাড়া কল্যাণী (১৯০৫ খ্রি:) অভয়া (১৯১০ খ্রি:); “অমৃত” নীতি কবিতা (১৯১০ খ্রি:); আনন্দময়ী (১৯১০ খ্রি:), বিশ্রাম (১৯১০ খ্রি:), সদ্ভাব কুসুম (১৯১৩ খ্রি:), শেষ দান (১৯১৬ খ্রি:) প্রকাশিত হয়। পেশায় ওকালতি অথচ নেশায় সাহিত্যিক অক্ষয় কুমার মৈত্রের সঙ্গে রাজশাহীতে রজনীকান্ত সেনের সৌহার্দ্য ছিল। এই রাজশাহীতেই গানের রাজা দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও “ভারত বর্ষ” পত্রিকায় সম্পাদক জলধর সেনের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্টতা হয়।
রজনী কান্তের গান কান্ত গীতি নামে সমাধিক পরিচিত। আধুনিক বাংলা গানের ইতিহাসে পঞ্চগীতি কবিদের (রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, দ্বীজেন্দ্রলাল, অতুল প্রসাদ, রজনী কান্ত) অন্যতম ছিলেন রজনীকান্ত সেন। রবীন্দ্র প্রভাবে প্রভাবিত হয়েও তিনি যে গান গুলি রচনা করেছেন তা স্বতন্দ্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জল। রজনীকান্ত স্বদেশী গান, ভক্তিমূলক গান ও হাসির গান লিখেছেন অসংখ্য। তাঁর গানের মূখ্য বিষয় হচ্ছে ঈশ্বর ভক্তি। সরল সৌকর্য পূর্ণ শব্দের বুননে ঈশ্বর স্তুতি মূলক এই গান গুলি হৃদয় মোহিত করা উপাদানে সমৃদ্ধ। ঈশ্বরের উদ্দেশ্য তাঁর প্রার্থনা মূলক একটি বিখ্যাত গান: “তুমি নির্মল করো মঙ্গল করে, মলিনমম-মুছয়ে/তব, পূর্ণ কিরণ দিয়ে যাক, মোর/ মোহ কালিমা ঘুচায়ে।” এতে ঈশ্বরের প্রতি মানুষের প্রত্যাহিক জীবনের ভূল-ভ্রান্তি, শোক-তাপ এবং পাপ মোচনের আকুতি প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গান হলে-
১)আমিতো তোমারে চাহিনী জীবনে ২) আমায় সকল রকমে কাঙ্গাল করেছে, ৩) কবে তৃষিত এ মরু ছাড়িয়া যাইব।
৪) আমি অকৃতী অধম বলেও তো/ কিছু কম করে মোরে দাও নি/ যা দিয়েছ তার অযোগ্য ভাবিয়া/ কেড়েও তো কিছু নাও নি। ৫) তোমারি দেওয়া প্রাণে তোমারি দেওয়া দু:খ ৬) কেন বঞ্চিত হব চরনে?/ আমি কত আশা করে বসে আছি/পাব জীবনে না হয় মরণে। ৭) সে যে পরম প্রেম সুন্দর/ জ্ঞান-নয়ন-নন্দন/ পূণ্য মধুর নিরমল/ জ্যোতি জগৎ বন্দন
তাঁর এই ভক্তি মূলক গান গুলি মানবের প্রাণে সঞ্চার করে প্রার্থনার আকুতি।
রজনীকান্তের হাসির গান গুলি চমৎকার ও অসাধারণ যেমন-
১। আমরা ভূমধ্যকারী বঙ্গে/ সদাএয়ার বন্ধু-সঙ্গে/ কত ফুর্তিতে করি- সময় হত্যা/ তাশ, পাশা, চতুরঙ্গে।
২। বাজার হুদ্দা কিন্যা আইন্যা চাইলা দিচি পায়/ তোমার লগে কেমতে পারুম, হৈয়া উঠছে দায়/ আরসি দিচি, কাহই দিচি, গাওমাজনের ছাপান দিচি, আর কি দ্যাওন যায়?
রজনীকান্ত সেনের নীতি কবিতা গুলো আমরা প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক স্তরের বাংলা পাঠ্য পুস্তকে সবাই পড়েছি। যেমন তাঁর বিখ্যাত কবিতা- “সাধীনতার সুখ”
“বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই,
কুড়ে ঘরে থেকে করো শিল্পের বড়াই।”
অথবা- “পরো পকার”
“নদী কভূ পান নাহি করে নিজ জল।”
ইত্যাদি কবিতা গুলো এখন ও পাঠ্য পুস্তকে অর্ন্তভূক্ত রয়েছে। রজনী কান্তের স্বদেশী গান প্রেম ভক্তির রসা মৃতে নন্দিত। যেমন “বঙ্গ মাতা” শীর্ষক কাব্য গীতিতে তিনি লিখেছেন-
নমো নমো জননী বঙ্গ।/ উত্তর ঐ অভ্রভেদী/ অতুল বিপুল গিরি, অরণ্য/ দক্ষিণে সুবিশাল জলধি/ চুম্বে চরণতল নিরবধি/ মধ্যেপূত-জাহ্নবী-জল/ ধৌত শ্যাম- ক্ষেত্র সঙ্ঘ।
ভক্তি রস ছাড়াও রজনী কান্তের তাঁর অনেক গানে দেশ্বাত্ববোধ ও হাস্য রসের উপস্থিতি ও লক্ষণীয়। ১৯০৫ সালের বঙ্গ-ভঙ্গ আন্দোলন রজনী কান্তকে যে দেশাত্ববোধে উদ্দীপিত করেছিল তার প্রকাশ দেখা যায়- “মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলো নেরে ভাই” গানটিতে। বিশেষ করে সেকালে শিক্ষার্থী যুবকদের কন্ঠে গীত হতো। স্বদেশী গান সেই ব্রিটিশ যুগে দেশপ্রেমিক কবি রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনী কান্ত সেন, অতুল প্রসাদ সেনও লিখেছেন।
রজনীকান্ত হাস্য রসান্তক গান রচনায় উদ্বুদ্ধ হন দিজেন্দ্রলাল রায়ের প্রভাবে। তাঁর রচিত প্রেম ও প্রকৃতি বিষয়ক গানের সংখ্যাও কম নয়।
তাঁর গান বাংলা মৌলিক সাঙ্গীতিক উপাদানে সমৃদ্ধ। কীর্তণ, বাউল, রাম প্রসাদী, পাঁচালি ইত্যাদি গানের সুর ও ভাবের প্রভাব তাঁর গানে লক্ষণীয়।
রবীন্দনাথ, দ্বিজেন্দলাল প্রমুখ গীতিকারের মতো বিলেত যাওয়ার বা বড় কোন ওস্তাদের নিকট গান শেখার সুযোগ তার হয়নি। তাই কান্ত গীতির সুরে কিছুটা বৈচিত্রের অভাব পরিলক্ষিত হলেও ভক্তি ভাবের সহজ অভিব্যক্তিতে তা হৃদয় গ্রাহী। সঙ্গীতের বিবিধ কার”কাজ তার গানে না থাকলেও গানের সহজ সরল ভাবপূর্ণ কথার সঙ্গে মিড়ের টান যুক্ত সুরের আবেদন শ্রোতাকে সহজেই আকর্ষণ করে মোহিত করে।
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের প্রচার মাধ্যমগুলিতে তাঁর গান নিয়মিত গীত হচ্ছে। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের পাঠ্য সুচীতে ও কান্তগীতি অন্তভূক্ত হয়েছে।
আমাদের বাংলা দেশেও রজনী কান্তের গান বিশেষ ভাবে পরিচিত এবং জনপ্রিয়।
সঙ্গীত প্রাণ রজনী কান্ত সেন যখন গৌরবের শিখরে আসীন তখনই এলো তাঁর দেহে কাল ব্যাধি ক্যান্সার। সূদীর্ঘ কাল রোগ শয্যায় মেডিক্যাল কলেজে থেকেও তিনি বহু গীতি কবিতা লিখেছিলেন। প্রায় দুই বছর কঠিন রোগ ভোগের পর ১৯১০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর গানের রাজা রজনীকান্ত সেন পরম প্রভূর কাছে শাপ্তি ধামে প্রস্থান করেন।
১৩ সেপ্টেম্বর আমাদের প্রিয় কবি, গীতিকার রজনীকান্ত সেনের ১০৯ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি জানাই হৃদয়ের গভীর শ্রদ্ধা।
তথ্যসুত্র: ১. কর”ণা ময় গোস্বামী: সঙ্গীত কোষ বাংলা একাডেমী, ঢাকা ১৯৮৫ খ্রি:
২. সূধীর চক্রর্বতী : বাংলাগানের সন্ধানে অরুণা প্রকাশনী, কোলকাতা ১৩৯৭ বঙ্গাব্দ (১৯৯০ খ্রি:)
৩. রজনীকান্ত সেন: ড: মঞ্জুশ্রী চৌধুরি দৈনিক জনকন্ঠ, ঢাকা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাংলা


আরও
আরও পড়ুন