পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ঢাকায় শুভেচ্ছা সফরে এসে বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান বলে জানিয়েছেন। মুখে প্রকাশ্যে বন্ধুত্বের কথা বললেও ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের মাথাব্যথা কোনো নতুন বিষয় নয়। তারা যখন ভারতীয় ইউনিয়নভুক্ত কাশ্মিরের জনগণকে ৭০ বছরেও বশ করতে পারেনি, তখন ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশকে গ্রাস বা বশ করার অভিসন্ধির মধ্যে বড় রকমের ঝুঁকির বিষয়টিও তাদের অজানা নয়। বিশাল আমেরিকার পাশে মেক্সিকো বা কিউবা স্বাধীনতা ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে টিকে থাকতে পারলেও ভারতের ক্ষুদ্র প্রতিবেশীরা কখনো আশ্বস্থ হতে পারছে না। ছলে বলে কৌশলে কাশ্মির, হায়দরাবাদ, সিকিমকে গ্রাস করার পর স্বাধীন রাষ্ট্র ভূটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ ভারতের দিক থেকে নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছে। প্রতিবেশীদের প্রতি ভারতের কর্তৃত্ববাদী আচরণ এসব দেশের মানুষকে ক্রমেই ভারত বিরোধি করে তুলেছে। একবিংশ শতকে এসে জাতিতে জাতিতে কূটনৈতিক সম্পর্ক রাজনীতির গন্ডি থেকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক আদান প্রদানের উপর বেশি জোর দিতে বাধ্য হচ্ছে। সেখানে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মাপকাঠি একদিকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক লেনদেন ও দরকষাকষিতে সমঝোতার পাশাপাশি দুই দেশের জনগণের মধ্যে পারস্পরিক নিঃশঙ্ক যোগাযোগের বিষয়টি গুরুত্বপুর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে বৃটেন ও ফ্রান্স পারমাণবিক পরাশক্তি হলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে তাদের দ্বারা নিরাপত্তাহীনতা বা আগ্রাসি ভূমিকার কোনো অভিযোগ উঠে না। মধ্যপ্রাচ্যে জায়নবাদ ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা সৃষ্ট কৃত্রিম সংকটের কথা বাদ দিলে আরবলীগ বা আফ্রিকান ইউনিয়নেও তেমন কোনো নিরাপত্তা সংকট নেই। পূর্ব এশিয়ায় আশিয়ানভুক্ত দেশগুলো পারস্পরিক বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের মধ্য দিয়ে নিজেদের সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তাকে সুসংহত করতে সক্ষম হলেও ব্যতিক্রম শুধু দক্ষিণ এশিয়ার ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলো। প্রায় চার দশক আগে সার্ক গঠনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্লাটফর্ম হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তা কখনো কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনের পথে এগুতে পারেনি। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার প্রস্তাবক বা প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্র বাংলাদেশ। আর এই সংস্থাটি তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থতার দায় বেশিরভাগই ভারতের। কিছুটা পাকিস্তানের। মূলত: দুই অসম ও বৈরী প্রতিবেশীকে এক টেবিলে বসিয়ে দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে সমঝোতার পথ তৈরি করাই সার্কের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকরা সব প্রতিবেশীকে নিয়ে সমমর্যাদার ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানের পথ খোলা রাখার চেয়ে সমস্যা জিইয়ে রেখে তাদের দূরবর্তী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উচ্চাভিলাস পুরণ করার গোপন এজেন্ডা পুষে রাখছে বলেই প্রতীয়মান হয়। গত ৭০ বছরে বিশ্বের বহু অমীমাংসিত ভূ-রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়েছে। আন্দোলন, যুদ্ধ বা রক্তপাত ছাড়াই বিশ্বের অন্যতম পারমাণবিক শক্তিধর পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেছে। বৃটিশদের ভারত ছেড়ে যাওয়াও একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও সমঝোতার মাধ্যমেই ঘটেছিল। বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রক্তক্ষয়ী বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দ্ব্খিন্ডিত জার্মানী আবার একীভূত হয়েছে। মার্শাল টিটোর যুগোশ্লাভিয়া ভেঙ্গে বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সুদান ভেঙ্গে দ্বি-খন্ডিত হয়েছে। খৃষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠতার জেরে ক্ষুদ্র দ্বীপ পূর্ব তিমুর ইন্দোনেশিয়া থেকে আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ফিলিস্তিন এবং কাশ্মির। জায়নবাদী ও হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডার কবলে পড়ে বিশ্বশান্তির জন্য প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে এশিয়ার এ দুই অঞ্চল। গত ৭০ বছরে কাশ্মির ইস্যুতে ভারত-পাকিস্তান অন্তত ৩ বার যুদ্ধ করেছে। এবারের পরিস্থিতি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে নাজুক এবং ঝুঁকিপূর্ণ।
জাতিসত্তার উপর রাষ্ট্রশক্তির আধিপত্য কায়েম ও নিপীড়নের রাজনৈতিক এজেন্ডা থেকেই দেশে দেশে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠির জন্ম হতে দেখা যায়। জায়নবাদী নিয়ন্ত্রণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি ও আরবরা পিএলও, হামাস, হেজবুল্লাহর মত সশস্ত্র গ্রুপের সৃষ্টি করেছে। একইভাবে কাশ্মিরে হিন্দুস্তানের আধিপত্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জইশ-ই মোহাম্মদ, লস্কর-ই তৈয়বাসহ বেশ কয়েকটি সশস্ত্র গ্রুপের জন্ম হয়েছে। একইভাবে কাউন্টার টেররিজমের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রীয় ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের মদপুষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠিও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সক্রিয় রয়েছে। এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠির তৎপরতার কারণে আঞ্চলিক শান্তি ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা চরমভাবে ব্যহত হচ্ছে। আর এসব জুজু সামনে রেখে পরাশক্তিগুলো আঞ্চলিক শক্তির উপর একদিকে দাদাগিরি করার সুযোগ পাচ্ছে, অন্যদিকে পারস্পরিক বৈরিতা ও প্রতিদ্ব›িদ্বতার উপর ভর করে তাদের উস্কানিকে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় পরিণত করে হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র ব্যবসার সুযোগকে তারা কাজে লাগাচ্ছে। যেখানে ক্রমাগত লোকসান এবং ক্ষুদ্র ঋণের বোঝা সইতে না পেরে ভারতে প্রতি মাসে হাজার হাজার কৃষক আত্মহত্যা করছে, সেখানে কৃষকদের নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু বাজারব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার চাইতে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি ডলার খরচ করে অস্ত্র ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতেই বেশি মনোযোগ ক্ষমতাদর্পি শাসকদের। পশ্চিমা সাম্রজ্যবাদী পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো দুইটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পঞ্চাশের দশকে শুরু হওয়া স্নায়ুযুদ্ধের সময় অস্ত্র প্রতিযোগিতা স্নায়যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেমে যাওয়ার বদলে তা আরো বহুগুণে বেড়ে যাওয়ার পেছনে পশ্চিমা মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের স্বার্থ এবং ফটকাবাজারের ডুবন্ত অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে এই অস্ত্র প্রতিযোগিতা টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন। এ কারণেই বিশ্বের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ও জনবহুল অঞ্চলে চীন, ভারত, পাকিস্তানের মধ্যকার উত্তেজনাপূর্ণ বিষয়গুলোতে জাতিসংঘকে পাশ কাটিয়ে রাশিয়া, আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলোকে বিভাজিত ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। আঞ্চলিক সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে বিশ্ব মোড়লদের মোড়লি এবং অস্ত্র বাণিজ্য দুইই হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তাদের এই ভূমিকা। ভারত বা চীনের মত আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলোর মধ্যকার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উচ্চাভিলাস ও ভূ-রাজনৈতিক এজেন্ডার কারণে কাশ্মির ও রোহিঙ্গা সংকটের জন্ম হয়। বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও পাকিস্তানের মত দেশগুলোই শুধু এখানে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক এজেন্ডায় বলির পাঠায় পরিণত হয় না, চীন বা ভারতও এর কোল্যাটারাল ড্যামেজের ঝুঁকি থেকে মুক্ত নয়। চীনের একচ্ছত্র প্রভাবক হয়ে উঠার প্রবণতা না থাকলে দারিদ্র্য বিমোচন ও প্রান্তিক জনগণের নিরাপত্তা ও জীবনমান উন্নয়নের মত বিষয়গুলো অগ্রাহ্য করে ভারতও হয়তো এমন পারমাণবিক শক্তি বা সামরিক পরাশক্তি হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হত না। আর ভারত আধিপত্যবাদী ভূমিকায় না থাকলে পাকিস্তানও হয়তো তাদের নাজুক অর্থনৈতিক বাস্তবতার মধ্যেও ভারতের সাথে অস্ত্রপ্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতো না। আরেকটু পিছিয়ে দেখলে চীনের পারমাণবিক শক্তি ও সামরিক পরাশক্তি হয়ে ওঠার পেছনে বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা এবং পশ্চিমাদের কমিউনিস্ট বিরোধী ফোবিয়াসহ নানামুখী তৎপরতার পুরনো ইতিহাসের নেপথ্য ভূমিকা রয়েছে। পশ্চিমা জনগণের সামনে একেক সময় একেক জুজু দেখিয়ে একটি ধারাবাহিক ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। প্রথম মহাযুদ্ধ পরবর্তি কমিউনিজমের জুজু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্ম দেয়। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন রিপাবলিকান সিনেটর জোসেফ ম্যাকার্থার মার্কিন প্রশাসনে এবং সমাজে কমিউনিস্টদের ঢুকে পড়ার তত্ত¡ হাজির করে কোনো প্রমাণ ছাড়াই সন্দেহভাজন বিদেশিদের বিশেষত: চাইনিজদের ডিপোর্ট করে নতুন চীনের উত্থানকে অবশ্যম্ভাবি করে তুলেছিলেন। বলা হয়ে থাকে, ম্যাকার্থিজমের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত বিজ্ঞানী ও অ্যাকাডেমিসিয়ানরাই চীনের সামরিক ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রকল্প বাস্তবায়নে মূল ভূমিকা রেখেছিল। এখন পশ্চিমাদের ইসলামোফোবিয়া পশ্চিমা সমাজে মুসলমানদের অগ্রযাত্রা থামাতে পারছে না। পশ্চিমা ইসলামোফোবিয়ার প্রভাব পড়েছে ভারতেও। শত শত বছর ধরে মুসলমানদের দ্বারা শাসিত হয়ে, হাজার বছর ধরে মসলমানদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পর আজ ভারতীয় শাসকশ্রেণীর মুসলিমবিদ্বেষি ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপটে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য নব জাগরণের সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
গত এক দশক ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের নেতারা দুই দেশের বন্ধুত্ব অনন্য উচ্চতায় সমাসীন হওয়ার বুলি আওড়াচ্ছেন। এই এক দশকে বাংলাদেশ থেকে ভারত যা কিছু পেয়েছে, তা বিগত ৭০ বছরের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। বিশেষত: উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭ রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা দমন এবং উলফা নেতাদের ধরে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার অভাবনীয় তৎপরতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এসব রাজ্যের সাথে অতি সহজে স্থলযোগাযোগ ও পণ্য বিনিময় নিশ্চিত করতে ভারতকে প্রায় বিনাশুল্কে ট্রানজিট-করিডোর দিয়েছে বাংলাদেশ। বিনিময়ে বাংলাদেশ কিছুই পায়নি। উপরন্তু অনন্য উচ্চতার বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ, বিএসএফ জোয়ানদের শুট টু কিল অবস্থানে ঠেলে দেয়া এবং কিশোরি ফেলানির গুলিবিদ্ধ লাশ কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখার অনন্য চিত্র উপহার দিয়েছে। প্রতিবার ভারতীয় নেতারা বাংলাদেশ সফরে আসেন আর অসম বন্ধুত্বের কথা বলে অন্যায্য অনেক কিছুই আদায় করে নেয়ার ধান্দায় থাকেন। যদিও যৌথ নদীর পানি বণ্টন কোনো বিনিময়যোগ্য বিষয় নয়, তথাপি বাংলাদেশের মানুষ তিস্তা ও গঙ্গার পানির ন্যয্য হিস্যার দাবিকে সামনে নিয়ে আসলেও ভারতীয়রা মূলা ঝুলিয়ে দশকের পর দশক পার করে দিচ্ছে। তিস্তার পানি না দিলেও, সীমান্তে বিএসএফ’র হাতে বাংলাদেশি হত্যা অব্যাহত থাকলেও, ভারতীয় নেতারা বাংলাদেশ বিরোধী বক্তব্য অব্যাহত রাখলেও বন্ধুত্বের উচ্চতা কিন্তু মোটেও কমে না! উপরন্তু তাদের আবদারের বহর যেন বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ত্রিপুরার আগরতলা বিমানবন্দর সম্প্রসারণে বাংলাদেশের ভূমি দাবি করছে ভারত। ত্রিপুরার চা বাগান থেকে বাংলাদেশে চা রফতানিতে শুল্কমুক্তি চায় ভারত। ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্কর তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় এসেছেন। বিদেশমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর জয়শঙ্করের এই প্রথম ঢাকা সফরকে শুভেচ্ছা সফর বলা হলেও এই সফরের প্রকাশ্য তেমন কোনো এজেন্ডা নেই। তথাপি কাশ্মির ইস্যুতে উত্তপ্ত এই সময়ে জয়শঙ্করের এই সফরকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে অভিহিত করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জয়শঙ্করের ঢাকা সফরের উদ্দেশ্য ‘রাজনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ়করণ’ বলা হয়েছে। গত ১২ বছরে ভারতের সাথে বাংলাদেশের দৃঢ় রাজনৈতিক সম্পর্কের মানে দাঁড়িয়েছে, দৃশ্যত কোনো বিনিময় ছাড়াই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে একপাক্ষিক ছাড় দেয়া। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে অনেক কথাই বলছেন। সে সব কথায় কান না দিলেও বিজেপির কাশ্মির কান্ডের পর আঞ্চলিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় যে পরিবর্তন ও সম্ভাব্য ঝুঁকি দেখা যাচ্ছে তাতে বাংলাদেশের নির্লিপ্ত থাকা বা ভারতকে শর্তহীন সমর্থনের কোনো সুযোগ নেই। বৈধ-অবৈধ ভারতীয়রা বাংলাদেশ থেকে বছরে ৮ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স নিয়ে যাচ্ছে। চোরাচালানের বিশাল অঙ্ক না ধরলেও ভারতের সাথে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ অন্তত ৭ বিলিয়ন ডলার। এগুলো ভারতের সাথে আমাদের অর্থনৈতিক-বানিজ্যিক বৈষম্যের বিষয়। সেই সাথে আছে তিস্তা ও গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যার মত অতি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। আছে রোহিঙ্গা সংকটের মত আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ইস্যু। এসব বিষয় এড়িয়ে জয়শঙ্কর কোন রাজনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে বাংলাদেশে ছুটে এলেন এবং আগামী অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের মূল এজেন্ডায় কী থাকছে তা দেখার অপেক্ষায় দেশের মানুষ।
গত ফেব্রুয়ারিতে কাশ্মিরের পুলওয়ামায় জইশ-ই মুহম্মদের জঙ্গি হামলায় ভারতীয় রিজার্ভ ফোর্সের অর্ধশতাধিক সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। সে থেকেই পাকিস্তানের সাথে উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। ফুঁসে ওঠা বিজেপি নেতারা পাকিস্তানকে শায়েস্তা করতে তাৎক্ষণিক স্ট্রাইকের সিদ্ধান্ত নিয়ে আজাদ কাশ্মিরে বিমান হামলা চালাতে গিয়ে বিমান ও বায়ু সেনা হারায়। অভিনন্দন বর্তমান নামের একজন ভারতীয় বায়ু সেনা পাকিস্তানীদের হাতে ধরা পড়ার পর আলোচনার সদিচ্ছার নিদর্শন হিসেবে অভিনন্দন বর্তমানকে নিঃশর্তভাবে সসম্মানে সীমান্তপথে ভারতের কাছে হস্তান্তর করে। কিন্তু উত্তেজনা প্রশমনে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের আলোচনার প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি ভারত। এর আগেই রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতাবলে কাশ্মিরের পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিয়ে সেখানে কেন্দ্রীয় শাসন জারি করা হয়। মূলত সে সময় থেকেই কাশ্মিরিরা অবরুদ্ধ এবং বিক্ষুব্ধ। আগস্টের ৫ তারিখে ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা এবং স্বায়ত্বশাসিত রাজ্যের মর্যাদা বাতিল করে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পরিণত করার বিল পাস করার আগে থেকেই সেখানকার প্রায় সব রাজনৈতিক নেতাকে কারারুদ্ধ করা হয় এবং লাখ লাখ সেনা সমাবেশ ঘটিয়ে কার্ফিউ জারি করে প্রকারান্তরে জম্মু ও কাশ্মিরের সব মানুষকেই গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। শুধু কার্ফিউ জারি করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা টেলিফোন, মোবাইল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেটসহ যোগাযোগের সব মাধ্যম বন্ধ করে কাশ্মিরকে ভারত ও বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। ভারত সরকার কাশ্মিরের জনগণকে চায় না, তারা কাশ্মিরের মাটি চায়, এমন অভিযোগ জম্মু ও কাশ্মিরের মুসলমানদের। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার হয়ে আমরা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম। স্ট্রাটেজিক কারণেই স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত ছিল আমাদের প্রধান অংশীদার। আজ কাশ্মিরের মুসলমানরা ভারতীয় আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদী নৃশংসতার শিকার। বিশ্বের নিপীড়িত স্বাধীনতাকামী মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মুল দাবি। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্য অক্ষুন্ন রাখতে আমাদের সরকার কাশ্মীর ইস্যুতে বিজেপির সরকারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করলেও দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষের সমর্থন স্বাধীনকামী কাশ্মীরিদের প্রতি। এটা তারা ভাল করেই জানে। এ কারণেই কাশ্মিরে বর্বর শাসন চাপিয়ে দেয়ার আগে থেকেই তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। নতুন নাগরিকপঞ্জির ছদ্মাবরণে আসামে ৪০ লাখ বাংলা ভাষাভাষি মানুষকে নাগরিকত্বহীন করে দিয়ে তাদেরকে অবৈধ বাংলাদেশি হিসেবে আখ্যায়িত করার চেষ্টা চলছে। গত ১৭ জুলাই ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্টে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু প্রতিনিধিদের সাক্ষাতের সময় বাংলাদেশ থেকে রহস্যজনকভাবে যুক্ত হওয়া প্রতিনিধি প্রিয়া সাহা হিন্দু সম্প্রদায়ের ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ বাংলাদেশ থেকে গুম হয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেছিলেন। এই ডাহা মিথ্যা অভিযোগে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ঐক্য পরিষদসহ সারাদেশ প্রতিবাদে ফেটে পড়লেও ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি ও সংঘ পরিবারের সদস্যরা তার প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। সম্প্রতি আসামের এক নির্বাচনী জনসভায় বিজেপি নেতা সুব্রামনিয়াম বলেছেন, আসামে অবৈধ বাংলাদেশিদের ফেরত নিতে হবে অথবা খুলনা থেকে সিলেট পর্যন্ত বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ ছেড়ে দিতে হবে। গত শনিবার ত্রিপুরায় চাকমা ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া এবং চাকমা স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন এক সমাবেশ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে এক গাঁজাখুরি দাবি করেছে। ১৯৪৭ সালের পর আর কখনো কেউ এমন দাবি তোলেনি। আসামের মুসলমান ও বাংলা ভাষাভাষিদের নাগরিকত্বের প্রশ্নে অহেতুক জটিলতা সৃষ্টি, বাংলাদেশ থেকে ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দুর গুম বা নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার অভিযোগ, অবৈধ বাংলাদেশিদের ফেরত অথবা এক-তৃতীয়াংশ ভূমির দাবি, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর ভারতীয় চাকমাদের অলীক দাবির মধ্যে এক ধরনের ধারাবাহিকতা বা সামঞ্জস্য রয়েছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের উপর চাপ সৃষ্টির কৌশল গ্রহণ করেছে। এখন তারা ত্রিপুরা বিমান বন্দর সম্প্রসারণে বাংলাদেশের জমি দাবি করছে। কাশ্মির ইস্যুতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে কোণঠাসা মোদি সরকার বাংলাদেশকে ট্রামকার্ড হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে। লাখো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ দিল্লির হিন্দুত্ববাদীদের দাসত্ব বরণের জন্য স্বাধীন হয়নি। এই চেতনা এ দেশের ৯০ ভাগ মানুষের মধ্যে সদা জাগরুক রয়েছে। বাংলাদেশের বন্ধুত্ব চাইলে উস্কানিমূলক বার্তা পরিহার করে এ দেশের সার্বভৌমত্ব ও মানুষের প্রত্যাশার প্রতি সম্মানজনক আচরণ করতে হবে এবং দ্বিপাক্ষিক অমীমাংসিত ইস্যুতে ভারতকে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।