পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
খুন, গুম, রাহজানি, ক্রস ফায়ার, নারী নির্যাতন, ধর্ষন, শিশু ধর্ষন, গণপিটুনীতে হত্যা, গুজব, শিশু হত্যা, বিচারকের উপস্থিতিতে বিচার চলার সময় এজলাসে খুন, প্রভৃতি অপরাধ যখন পাল্লা দিয়ে দেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে তার চেয়ে অধিক মাত্রায় চক্রবৃদ্ধি সুদের মত দেশে মাদক বিস্তার লাভ করেছে। বস্তি বাসিন্দা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের পরিবারেও মাদক প্রবেশ করেছে। অতিমাত্রায় লাভজনক বিধায় বিত্তশালীরা বা তাদের পরিবারের সন্তানেরাও মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা দিয়েছেন। র্যাব, পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিনিয়তই মাদক ব্যবসায়ীদের ফায়ার করছে যদিও প্রচার করা হয় যে, ক্রস ফায়ারে মারা গিয়াছে। তবু দেশবাসী মাদকমুক্ত একটি সমাজ দেখতে চায়। সরকার জোর গলায়ই সুশাসনের কথা বলছে। মিডিয়ার ভাষ্যমতে মাদকের অভিযোগেই সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য বদিকে (কক্সবাজার) বাদ দিয়ে মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিলেও একই আসনে বদির স্ত্রীকে নমিনেশন দিয়ে সরকার প্রধান সুশাসনকে নগ্নভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। পূর্ব থেকেই মাদক ব্যবসা বিস্তার লাভের পিছনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতা আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অনেক স্থানে মাদক ব্যবসায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হাতে নাতে ধরা পড়ে জেল হাজতে রয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ ফৌজধারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও দিয়েছে। পুলিশ তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাদক ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে মাসোহারা পায় বলেই মাদক ব্যবসা কমছেনা বরং জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে। প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স তখনই জিরো হয়ে যায় যখন সরিষার মধ্যে ভ‚ত কার্যকর থাকে।
সম্প্রতি পত্রিকান্তরে প্রকাশ,নারায়নগঞ্জ শহরের চাঁদমারী এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী মো: বিপ্লব (৩১) ডিবির সঙ্গে গোলাগুলিতে ক্রসফায়ারে পড়ে নিহত হয়েছে। সে জেলা পুলিশের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী। তাকে ধরিয়ে দিতে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। গত ১৬ জুলাই মঙ্গলবার ভোর ৩টায় ঢাকা-নারায়নগঞ্জ লিংক রোডের পাশে চাঁদমারী এলাকায় ওই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার পর সেখান থেকে বিপ্লবের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই সময় আটক নারী মাদক স¤্রাজ্ঞী ময়না খাতুনের কাছ থেকে একটি নোটবুক উদ্ধার করা হয় যাতে একাধিক স্থানে বিপ্লবের নাম উল্লেখ ছিল। একটি ছেড়া নোটবুকের কয়েকটি পাতায় লেখা বাংলা নামের বানানে ভুল ছিল। তবে টাকার অংকে কোন ভুল ছিল না। ওই নোটবুকে লেখা ছিল আফগারী পুলিশ ৬০০০ টাকা, টিপু ৫০০০ টাকা, ফাড়ি পুলিশ ৩ হাজার ৩০০ টাকা, ফাড়ি কালাম ২০০০ টাকা, টহলের দারোগা ১০০০ টাকা, কামরুলের ফরমা (অর্থাৎ সোর্স) ৫০০ টাকা, বিপ্লব ৫০০০ টাকা, টহল পুলিশ ৫০০, করিম পুলিশ ২০০, সাইফুল পুলিশ ১০০, সাংবাদিক ২০০ টাকা, বিপ্লব ১০০০ টাকা, আক্তার ২০০০ টাকা সহ বেশ কয়েকজনের নাম। একই নামের তালিকার পাশে বসানো টাকার সংখ্যা ঠিক থাকলেও ঠিক ছিল না দিন তারিখ। তবে একই নামের তালিকা ছিল বিভিন্ন মাসের হিসেবে। যাদের প্রতি মাসেই মাদক বিক্রি বাবদ কমিশন বা বখরা দেয়া হতো।”
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে প্রায়ই বলা হয়ে আসছিল যে, আদালত জামিন দেয় বলেই দেশ মাদক মুক্ত করা যাচ্ছে না। দৃশ্যত আদালত মাদক মামলায় কঠিন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছে। তবে ২ (দুই) বৎসরে যদি মামলায় বিচার শুরু না হয় তবে কোন আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কারাগারে রাখা যাবে?
সম্প্রতি ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াতে একটি সংবাদ প্রর্দশিত হয়েছে যে, ময়মনসিংহ এলাকায় মাদক দিয়ে ফাসানোর সময় হাতে নাতে এক ষড়যন্ত্রকারী ধরা পড়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাদক দিয়ে অনেক জায়গায় নিরীহ মানুষকে ফাসিয়ে টাকা আদায়ের অনেক ঘটনাও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন ঘটনার প্রকাশ পেয়েছে যে, যারা পুলিশের সোর্স তারাই পুলিশ প্রটেকশনে মাদক ব্যবসা করে, যার একটি ব্যাপক অংশ পুলিশ কর্মকর্তাদের পকেটে যায়। মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে একই মামলায় নারায়নগঞ্জ জেলা কারাগারে ১০ জন, পুলিশ আটক রয়েছে যে মামলা থেকে ওসি কামরুলকে বাদ দেয়ায় হাই কোর্ট অসন্তোষ্ট প্রকাশ করেছেন।
সরকার প্রধান মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষনা করেছেন বটে, কিন্তু যাদের দিয়ে ভূত তাড়াবেন সেখানেই যদি ভূত থাকে তবে জিরো টলারেন্স সফল হবে কেন? একজন মাদক স¤্রাগীর ডাইরীর পাতা থেকে যে তথ্য প্রকাশ পেয়েছে তার সূত্র ধরেই যদি এগোনো যায় তবে দেখা যাবে যে, মাদকের চালান ছাড়াও রুট লেভেল ব্যবসা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একটি মাসোহারা পেয়ে থাকে। ডাইরীর পাতায় যেখানে মাসোহারা প্রদানের তালিকা মাসে মাসে লিখা হয়েছে তারই একটি ছবি পত্রিকাতে ছাপা হয়েছে। ফলে ডাইরীর পাতার সূত্র ধরে অগ্রসর হলে মাদক নেট ওয়ার্কের অনেক তথ্য সরকারের ভান্ডারে জমা হতে পারে। ডাইরীর পাতার ছবি পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর তদন্তকারী কর্মকর্তা উহা জব্দ করেছেন কিনা, তা জানা যায়নি। তবে ক্রস ফায়ারে নিহত মাদক ব্যবসায়ী হত্যা বা মরে নিয়ে বেচে গেছে, কিন্তু ডাইরীর পাতায় যে স্বাক্ষর রয়ে গেছে, মাদক ব্যবসা রোধে তা সহায়ক হতে পারে, যদি সরকারের সংশ্লিষ্ট এজেন্সী আন্তরিক হয়।
ডাইরীর মাসোহারার যে তালিকা সে অনুযায়ী মাসোহারা গ্রহিতাদের বিষয়টি যাচাই হওয়া আবশ্যক। ডাইরীর ভাষ্য অনুযায়ী আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন শাখায় নিয়োজিত দায়িত্ব প্রাপ্তদের মাসিক মাসোয়ারা দিয়েই মাদক ব্যবসা পরিচালিত হতো। মাদক ব্যবসায়ী নিহত বিপ্লবকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য যে পুলিশ ১০ হাজার টাকা পুরুষ্কার ঘোষনা করেছিল সে পুলিশকে মাসিক ভাতা দিয়েই (তার ডাইরীর ভাষ্য মতে) মাদক ব্যবসা নির্বিগ্নে পরিচালিত হতো এবং গ্রাম্য ভাষায় একেই বলে বেড়ায় ক্ষেত খায়।
ভুল বানান সম্বলিত ডাইরীর ভাষ্য একটি টোকাই মাদক ব্যবসায়ীর। তবে সত্যই যদি জিরো টলারেন্সের সদইচ্ছা সরকারের থাকে তবে ডাইরীর হিসাবটি মাদক নেট ওয়ার্কের চিত্র পরিষ্কার হওয়ার জন্য এটা একটা মাইল ফলক হতে পারে। পুলিশ যদি নিজেদের চামড়া বাচানোর জন্য ডাইরীটির গুরুত্ব প্রদান না করে তবে এ ধরনের একটি তথ্য ভবিষ্যতে হয়তো না পাওয়া যেতে পারে। কারণ ডাইরী তথ্য প্রকাশ হওয়ায় অন্য মাদক ব্যবসায়ীরা নিশ্চয় লিখিত পড়িত ভাবে আর কোন মাসোহারা প্রদান করবে না।
সরকারের একটি মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রক অধিদপ্তর রয়েছে। সে অধিদপ্তরের কার্যক্রম অতি ধীর গতি। তাদের ম্যান পাওয়ার নাই বলে অভিযোগ রয়েছে। মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার করা ছাড়াও মাদকের রুট খুজে বের করা তাদের দায়িত্ব। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাদক রুট বন্ধ করার জন্য তাদের কোন সফলতা দৃশ্যমান নহে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক মাদক ব্যবসায় ফাসিয়ে দেয়ার অভিযোগ নতুন কোন ঘটনা নয়। এমনও ঘটনা রয়েছে যে, শক্র পক্ষের অর্থের বিনিময়ে প্রতিপক্ষকে মাদক ধরিয়ে দিয়ে মাদক মামলায় চালান দেয়া হয়। মাদক নিয়ন্ত্রনে এসব কারণেও বাহিনীগুলি জনগণের আস্থার প্রশ্নে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। যে কোন পদ্ধতিতে দেশ মাদক মুক্ত হতে হবে এটাই জাতির প্রত্যাশা।
লেখক: কলামিষ্ট ও আইনজীবি
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।