Inqilab Logo

বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ০১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৬ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

তিন স্তরের মানব জীবন

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ৮ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

ভারতবর্ষের চানক্য পণ্ডিত মানুষকে ‘দ্বিজ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ‘দ্বিজ’ বলতে তিনি দ্বিতীয়বার জন্মকে বুঝিয়েছেন। হিন্দু ধর্মে পুনঃ জন্মের কথা বলা হয়েছে। অন্যকোন ধর্মে এ ধরনের বিধান থাকতে পারে, কিন্তু ইসলাম ধর্মে পুনঃ জন্মের কথা বলা নাই, তবে জবাবদিহিতার কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। যেমন- প্রত্যেক মানবকেই জবাবদিহি অর্থাৎ বিচারের সম্মুখীন হতে হবে এবং কর্মফল পরবর্তী অনুযায়ী তার অবস্থান (জান্নাত বা জাহান্নাম) নির্ধারিত হবে। এগুলি ধর্মীয় বিধান বটে। তবে চানক্য পণ্ডিতের বক্তব্য ধর্মীয় শ্রাস্ত্র মতে নয়, বরং অভিজ্ঞতার আলোকে তার নিজস্ব মতবাদ। ধর্মের দিক থেকে তিনি হিন্দু, ফলে তিনি পুনঃ জন্মের কথা না বলে মানুষের দ্বিতীয় জন্ম হয় বলে ‘দ্বিজ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন কেন? ভাষাগত পার্থক্যকেই বুঝা যায় যে, পুনঃজন্ম ও জীবিত থেকেই দ্বিতীয় জন্ম এক কথা নয়। তার সাথে একমত পোষণ করা বা না করার পূর্বে সমসাময়িক দুই জন দার্শনিকের নিজস্ব মতবাদকে এখানে উপস্থাপন করা হলো। ইটালীর জেলখানার চিকিৎসক যিনি দীর্ঘদিন সেনাবাহিনীর চিকিৎসক হিসাবেও কাজ করেছেন সিজার লমব্রোসো। তিনি বলেছেন, মানুষ জন্মগতভাবেই অপরাধী হয়ে জন্ম গ্রহণ করে। শারীরিক গঠন প্রক্রিয়াই একটি মানুষের স্বভাব চরিত্র কী হবে তা বলে দিতে পারে। যেমন- তিনি বলেছেন যে, বড় ধরনের নাক ও কান, চিকন-লম্বা দাঁত, লম্বা চোয়াল একটি অপরাধী মানুষের শারীরিক চিহ্ন। অপরদিকে তৎসময়ের অন্যতম চিকিৎসক ও দার্শনিক সিজার বেকারিয়া বলেছেন, মানুষ জন্মগতভাবে অপরাধী হয়ে জন্মায় না, সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থান একটি মানুষকে অপরাধী হতে বাধ্য করে। দুইটি পারস্পারিক ও স্ববিরোধী মতবাদদাতাদের অবশ্যই নিজস্ব যুক্তি রয়েছে। কিন্তু অপরাধ জগৎ এখন যেভাবে বিস্তৃতি লাভ করছে তা’কি শুধু জীবন জীবিকার তাগিদে বা পারিপার্শ্বিক অবস্থানের কারণে? তিন বছরের একজন শিশু যখন ধর্ষিত হয় এবং ধর্ষণের পর যখন শিশুটিকে হত্যা করা হয় তখন এই অপরাধকে কোন বৈষিষ্ট্যে ফেলা যাবে? মাদরাসার অধ্যক্ষ (অভিযোগ মতে) যখন প্রেম প্রার্থনায় ব্যর্থ হয়ে ছাত্রীকে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দেয় তখন তার অপরাধকে কোন বিশেষণে বিশেষায়িত করা যাবে?

অপরাধ প্রবণতা কি শারীরিক না মানসিক না জৈবিক? জীবন জীবিকার স্বার্থে অর্থাৎ জৈবীক প্রয়োজনে মানুষ অপরাধ করে। সম্প্রতি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায় যে, একজন মানুষ একটি দোকান থেকে দুধ চুরির অপরাধে গণপিটুনির শিকার হন। এ ঘটনায় খিলগাঁও পুলিশী অঞ্চলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার চুরির কারণ জিজ্ঞাসা করলে অভিযুক্ত ব্যক্তি বলেন যে, “আমি পেশাগত চোর নহি, তবে আমার ছেলের খাওয়ার দুধ নাই, দুধের টাকা জোগাড় করতে পারি নাই বলে আমি চুরি করেছি।” এ কথা শোনার পর পুলিশ অফিসারের নিজের সন্তানের কথা মনে পড়ে যায় এবং তৎক্ষনাৎ ৫০০/- টাকা দিয়ে দুধের দাম পরিশোধ করে বাকী টাকা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দিয়ে দিতে বলেন। পুলিশের মধ্যে অপসংস্কৃতি রয়েছে। পুলিশ নিজেও অপরাধ করে। পুলিশের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অনেক অভিযোগ থাকলেও এ মহানুভবতাকে শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করতে হয়। অভিযুক্ত ব্যক্তি এখানে চুরি করলেও এটা ছিল তার জৈবিক কারণ। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে বা প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য মানুষ অপরাধ করার একটি যুক্তি থাকতে পারে, কিন্তু তিন বৎসরের একজন শিশুকে ধর্ষণ করা বা ধর্ষণের পরে তাকে হত্যা করার পিছনে কি যুক্তি আছে? ১১ই মে ২০১৯ জাতিসংঘ ঘোষিত “মা” দিবস উৎযাপিত হয়ে গেলো। অপ্রসাঙ্গিক হলেও বলতে হয় যে, মায়ের জাতিকে সম্মান দেয়া ও নিরাপত্তার জন্যই এ দিবসটি জাতিসংঘের উদ্দ্যেগে পৃথিবীব্যাপী উৎযাপিত হয়ে আসছে, অথচ মায়ের জাতিই আজ সর্বক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীন। সর্বত্র সব সয়সের নারীরাই গণধর্ষণের শিকার হচ্ছে। সকলেই এসব ঘটনার শাস্তি দাবী করছে এবং অবশ্যই শাস্তি হওয়া দরকার, কিন্তু তিন বৎসর থেকে বয়স্ক নারী ধর্ষিত হওয়ার মহামারী সৃষ্টি হওয়ার পিছনের কারণ কি তাহাও গভীর ভাবে তলিয়ে দেখা দরকার।

আইন অমান্য করাই “অপরাধ”। উবারধহপব কোন অপরাধ নহে, কিন্তু সমাজ কর্তৃক ধিকৃত বিষয়। আইন ও সমাজ উভয় কর্তৃক ধর্ষণ ঘৃনিত। ধর্ষণ বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রে অনেক কঠিন কঠিন আইন প্রনয়ণ করেছে বটে, কিন্তু ধর্ষণকে বন্ধ করার মনস্তাত্বিক কোন উদ্দ্যোগ গ্রহণ করে নাই, বরং উল্টো পথে উৎসাহিত করা হচ্ছে। সংস্কৃতির নামে নারীকে পন্য হিসাবে বিক্রির জোড়ালো প্রতিযোগীতা চলছে।

জৈবিক চাহিদা বা অভাবকে মোকাবেলা করেও মানুষ অপরাধে না জড়ানোর দৃষ্টান্ত অনেক রয়েছে। জাতীয় পত্রিকায় সম্প্রতি প্রকাশিত একটি সংবাদ আলোচনার সুবিধার্থে নি¤েœ তুলে ধরা হলো: ‘টাকাভর্তি ব্যাগ রাস্তায় পেয়ে মালিককে ফিরিয়ে দিয়ে অসাধারণ সততার নজির স্থাপন করলেন বরিশালের গৌরনদী উপজেলা সদরের মোটরসাইকেল মেকানিক আল আমীন বেপারী (২৫)। ঘটনাটি ঘটেছে গত রবিবার দুপুরে উপজেলা সদরের গৌরনদী বন্দর এলাকায়। জানা গেছে, উপজেলার চরগাধাতলী গ্রামের মৃত দলিল উদ্দিন বেপারীর ৪র্থ ছেলে মোটরসাইকেল মেকানিক আল আমীন বেপারী প্রতিদিনের ন্যায় গত রবিবার সকাল থেকে গৌরনদী বন্দরের নিজের মোটরসাইকেল গ্যারেজে বসে কাজ করছিল। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নিজের গ্যারেজের সামনের রাস্তার ওপর কালো রংয়ের একটি অফিসিয়াল ব্যাগ রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে কুড়িয়ে নেন। এরপর ব্যাগ খুলে দেখেন ভেতরে নগদ ৭০ হাজার টাকা ও ২০ হাজার টাকার একটি চেকসহ মূল্যবান কাগজপত্র রয়েছে। এরপর আল আমীন খুঁজতে থাকেন ব্যাগের ভেতরে মালিকের কোন মোবাইল নম্বর আছে কিনা। এক পর্যায়ে একটি মোবাইল নম্বর পেয়ে সেটিতে ফোন দিয়ে আল আমীন ব্যাগের প্রকৃত মালিককে খুঁজে বের করেন। এবং পুরো টাকাসহ ব্যাগটি তার মালিককে ফিরিয়ে দেন।’

নৈতিকতা বোধ (সচেতন বা অবচেতনভাবে) যে কোন ব্যক্তির (বয়স প্রকান্তরে না হয়েও) উদ্ভব হতে পারে। দুটি বিষয়ই একজন মানুষকে অপরাধ থেকে দূরে রাখতে পারে। যথা- (১) নৈতিকতা ও (২) শাস্তির ভয়। অন্যদিকে ‘চাহিদা আইন চিনে না’ এ প্রবাদটি অবশ্যই দীর্ঘ দিন চলে আসছে। তবে এ প্রবাদের উপর ভিত্তি করে চললে দুনিয়াতে সভ্যতা বলে কিছু থাকবে না। যখনই কোনো রাষ্ট্রের শাসক বেকায়দায় পড়ে তখন তার উচ্ছা শক্তিকে প্রয়োগের জন্য কোনো আইন বা পন্থা খুঁজে না পায় তখন অবৈধ কর্মকে জায়েজ করে একটি মতবাদের মাধ্যমে কোর্ট কাচারীর ভাষায় যা ডকট্রিন অফ নেসেসিটি হিসেবে পরিচিত। ১/১১ সরকার এ মতবাদের দোহাই দিয়েই অনেক কার্য সম্পাদন করেছেন।

মূল আলোচনাটি চানক্য পন্ডিতের “দ্বিজ” অর্থাৎ “দ্বিতীয় জন্ম” থেকেই শুরু করতে চাই। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কারো মতে মানুষ অপরাধের মনোবৃত্তি নিয়েই জন্মগ্রহণ করে বা ভিন্ন মতে পারিপার্ষিক অবস্থার কারণে অপরাধ করে। পরস্পর বিরোধী বক্তব্যের মধ্যে দ্বিতীয়বার (অর্থাৎ পুন: জন্ম নহে) জন্ম গ্রহণ করার বিষয়টি কি হতে পারে? পশু প্রাণী বা বৃক্ষ তরুলতার সাথে মানুষের তারতম্য কি? বিষয়টি বিশ্লেষিত হওয়া দরকার।

মানুষ সহ পৃথিবীর সব কিছুই সৃষ্টি কর্তার সৃষ্টি, কিন্তু প্রকৃতিগতভাবে মানুষ ছাড়া সকলেই আপনা আপনি নিজস্ব অবস্থান থেকে বেড়ে উঠে এবং কোন প্রকার জবাব দিহিতার উর্দ্ধে থেকেই বাচা মরার স্বাদ গ্রহণ করে। কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু মানুষের বেলায়। কারণ মানুষও একপ্রকার প্রাণী, কিন্তু তারা সামাজিক প্রাণী। সামাজিক প্রাণী হওয়ার কারণেই ‘জবাবদিহিতার’ সৃষ্টি। ফলে মানুষের জন্ম অর্থাৎ শারিরীক জন্ম অর্থাৎ মাতৃগর্ভ থেকে পৃথিবীতে আগমন মানবজীবনের প্রথম ধাপ এবং জবাবদিহিতামূলক জীবন শুরু করা হলো দ্বিতীয় ধাপ। এখানে প্রাসাঙ্গিক না হলেও ‘জন্ম হউক যথাতথা কর্ম হউক বড়’ প্রবাদটি অনেক প্রানিধানযোগ্য। পূবেই বলেছি যে, নৈতিকতা বোধই মানুষকে অপরাধ প্রবনতা থেকে দূরে রাখতে পারে। মানুষের মনে নৈতিকতার সৃষ্টি হওয়ার জন্য অনেকেই “শিক্ষার” উপর গুরুত্ব অর্পন করেন বটে, তবে “শিক্ষা” নৈতিকতার সম্পূরক, কিন্তু একক নিয়ন্ত্রক নহে। শুধুমাত্র “বিবেকই” নৈতিকতাকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে। প্রকৃতিগত বিবেক মানুষের ভিতরই আছে বা থাকার কথা, যার নাই সে একটি প্রাণী মাত্র। বিবেকের কারণেই মানুষ হয়েও কেহ সমাজের আর্শীবাদ বা কেহ অভিশাপ। ধর্মীয় মূল্যবোধই জবাবদিহিতামূলক বিবেককে শানিত করে। কিন্তু যারা ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর গুরুত্ব অর্পন করেন তাদেরকে বর্তমান কথিত সংস্কৃতিমনা বুদ্দিজীবিরা “সম্প্রদায়িক” বলে আখ্যায়িত করছেন, যে বুদ্দিজীবিরা অবাধ যৌনাচারকে ভিন্ন পন্থায় রগরগিয়ে দিচ্ছেন। আকাশ সংস্কৃতি যৌনাচারকে মহামারীতে পরিণত করেছে, যা আইন করে বন্ধ করা সম্ভব নয়। ফলে বিষয়গুলি গভীর ভাবে তলিয়ে দেখার সময় চলে যাচ্ছে।

সার্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, একজন মানুষ জীবনের তিনটি স্তর অতিক্রম করে, যথা- (১) জন্ম গ্রহণ, (২) মৃত্যু ও (৩) একজন বিবেকমান মানুষ হিসাবে নিজেকে প্রস্তুত করা, নতুবা “মানুষ” নামক প্রাণীটি (সমাজবদ্ধ প্রাণী হয়েও) শুধুমাত্র একটি প্রাণীই থেকে যায়, কিন্তু মানবিক গুনসম্পন্ন একজন “মানুষ” হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। একটি প্রাণী (জীব) ও সামাজিক প্রাণীর মধ্যে তারতম্য এ টুকু যে, একটি প্রাণী তার চাহিদা পূরণ করে নিজের ইচ্ছামত এবং একজন সামাজিক প্রাণী নিজের চাহিদা পূরণে সমাজের চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সকে রক্ষা করে। স্বরণ করা দরকার মানুষ জীব। একজন মানুষের “বিবেকের” কার্যকারিতার উপরই নির্ভর করে তার মানুষ্য জীবনের সার্থকতার পরিধি। মানুষ যখন বিবেক বর্জিত হয়ে পড়ে তখন হিংস্যাত্বক পশুর চেয়েও বেশি বর্বর হতে কুন্ঠা বোধ করে না এবং এটাই বাস্তবতা। তখন হিং¯্র প্রাণী ও মানুষের মধ্যে কোন তফাৎ থাকে না, বরং অধিক মাত্রায় ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে। সমাজের প্রভাবশালী এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে রাজা, বাদশা, জেনারেল ও দেশ কর্তাদের মধ্যেই এ প্রবনতা সবচেয়ে বেশী, কিছু ভিন্নতা থাকলেও।

লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবি



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জীবন

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন