পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
একের পর এক নৃশংস, ভয়াবহ ও অকল্পনীয় ঘটনা দেশকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। একশ্রেণীর মানুষ মানবিকতা হারিয়ে খুন, ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটিয়ে যেন উল্লাসে মেতে উঠছে। এমন কোনো দিন নেই যেদিন পত্রিকার পাতায় রোমহর্ষক ঘটনা থাকে না। বরগুনায় স্ত্রীর সামনে স্বামীকে কী অবলীলায় কুপিয়ে হত্যা করে খুনিরা পালিয়ে গেল। শত চেষ্টা করেও খুনিদের রাম দা’র কোপ থেকে স্বামীকে বাঁচাতে পারল না। আশপাশের মানুষের কাছে সাহায্য চেয়েও পেল না। একজন মানুষকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করছে, আর কিছু মানুষ তা চেয়ে চেয়ে দেখছে। এই যে যারা চেয়ে চেয়ে দেখল এবং ভিডিও করল, তারা কি ঐ খুনিদের চেয়েও কম দায়ী? তারা কি প্রকারন্তরে খুনিদের সহযোগিতা করল না? মানুষগুলো যদি সমবেত হয়ে সমস্বরে চিৎকার করে এগিয়ে যেত, তাহলে কি দুই-তিনজন খুনি খুন করে পালিয়ে যেতে পারত? এ থেকেই কি বোঝা যায় না এক ধরনের নির্মমতা ও পৈশাচিকতা প্রকট হয়ে উঠেছে? মানবিক মূল্যবোধ লোপ পেয়েছে? আমরা যারা এখনও চলাফেরা করছি, রাম দা’র কোপ থেকে বেঁচে আছি এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খুন হওয়ার দৃশ্য দেখছি, এগিয়ে যাচ্ছি না, যদি এভাবে কোপানোর মধ্যে পড়ি, কেউ এগিয়ে না আসে, তখন কি রিফাতের অসহায়ত্ব এবং খুন হওয়ার দৃশ্য মনে পড়বে না? তখন কি মনে প্রশ্ন জাগবে না, মানুষের মধ্যে কি কোনো মায়া-মমতা নেই? মানুষ কি নিষ্ঠুর হয়ে গেল? এসব প্রশ্ন তখন অর্থহীন মনে হওয়া ছাড়া কি কোনো উপায় থাকবে? আমাদের রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে পরিবার ও সমাজ কোন পথে যাচ্ছে এবং কী অবস্থায় আছে তা কারো বুঝতে বাকি নাই। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন ক্রমেই শিথিল হয়ে পড়ছে। তা নাহলে মা-বাবা সন্তানকে, সন্তান মা-বাবাকে, ভাই ভাইকে, স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে খুন করতে পারে? ৯ মাসের নবজাতক থেকে শুরু করে শতবর্ষী বৃদ্ধাকে ধর্ষণ করতে পারে? এসব আলামত কোন রাষ্ট্র ও সমাজের? দুঃখের বিষয় যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, তারা এ বিষয়গুলো আমলে নিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না। তাদের একটাই নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে, উন্নয়ন করতে হবে। এ কথা ভাবছে না, এ উন্নয়ন কাদের জন্য? যে পরিবার ও সমাজ দিন দিন অসভ্য, বর্বর ও নিষ্ঠুরতার দিকে ধাবিত, সেই পরিবার ও সমাজের জন্য? যদি তাই হয়, তবে এ উন্নয়ন কোনো কালেই কাজে আসবে না। মানুষের নীতি- নৈতিকতা, মানবিকতা, মূল্যবোধই যদি না থাকে, তবে উন্নয়নের এ তত্ত¡ কোনো কল্যাণই বয়ে আনবে না। যদি নীতিনির্ধারকরা এমত পোষণ করেন, পরিবার ও সমাজ গোল্লায় যাক আমরা নিজেরা সুরক্ষিত থেকে উন্নয়ন করব, তাহলে কিছু বলার নেই। তবে এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে তারা যে সুরক্ষিত থাকবেন, এ গ্যারান্টি কি দেয়া যায়। কারণ ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকে তার সৃষ্ট দানবের হাতেই প্রাণ দিতে হয়েছে।
দুই.
এ কথা এখন আশঙ্কার নয়, বাস্তবিকই আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধে বড় ধরনের ধস নেমেছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, মায়া-মমতা, একের দুঃখে অন্যের দুঃখী হওয়া, পাশে দাঁড়ানো, সংঘবদ্ধ হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মতো মানবিক গুণগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। হিং¯্রতা, নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, অন্যায়ের প্রতিবাদ না করা, পারস্পরিক অশ্রদ্ধাবোধ স্থান করে নিয়েছে। এসব এতটাই প্রকট হয়ে উঠেছে, যা শোনা, দেখা ও বর্ণনা করা যায় না। একেকটি লোমহর্ষক ঘটনা কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। দুর্বৃত্তদের অবাধ বিচরণে সমাজ এখন শ্বাপদশংকুল হয়ে উঠেছে। সমাজ যেনা অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আস্থা রাখার কথা, তাদের প্রতিও এক ধরনের অনাস্থা রয়েছে। এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরই হাজার হাজার সদস্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধ দমন ও সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা বা সংস্কার করবে কি, তাদেরই সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। একটি দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি যদি এই হয়, তবে সেখানে অকল্পনীয় ঘটনা ঘটা নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু থাকে না। বলা বাহুল্য, পরিবার ও সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রাতারাতি ঘটে না। আবার সামাজিক নীতি-নৈতিকতা ধরে রেখে সময়কে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়াও হঠাৎ করে হয় না। দশকের পর দশক ধরে এর পরিবর্তন হয়। তবে এ পরিবর্তন পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ অটুট রেখে হচ্ছে কিনা, তা বিবেচনায় রাখতে হয়। মানুষের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, সভ্যতার দিকে ধাবিত হওয়া। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের যে বিবর্তন, তা সভ্য হওয়ারই ধারাবাহিকতা। এই সভ্য হতে গিয়ে মানুষ ভাল-মন্দ দুটো পথের দিকেই এগিয়ে চলেছে। দেখা গেছে, বেশির ভাগ মানুষই ভাল পথের পথিক হয়েছে। সমাজ গঠনে নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ সম্পন্ন মানবিক গুণাবলি প্রতিষ্ঠা করেছে। যুথবদ্ধ সমাজ গড়ে তুলেছে এবং তাদেরই আধিপত্য স্থাপিত হয়েছে। তারাই সমাজকে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং দিয়ে আসছে। বলা হচ্ছে, এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগে এসে প্রযুক্তি মানুষকে গতি দিয়েছে। গতি এতটাই বেড়েছে যে, পারিবারিক ও সামাজিক রীতি-নীতি, মূল্যবোধ এমনকি ধর্মীয় অনুশাসন এই গতির কাছে হার মানছে। পেছনে পড়ে যাচ্ছে। এসব গুণাবলীর দিকে তাকানোর প্রয়োজনীয়তাবোধ করছে না। যার ফলে আমাদের দেশের মতো আবহমান কাল ধরে চলে আসা রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থা এবং বন্ধন শিথিল হয়ে পড়ছে। এ সুযোগে দুর্বৃত্ত শ্রেণী একের পর এক নৃশংস ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। নৈতিক মূল্যবোধ অবক্ষয়ের একটি অন্যতম উদাহরণ হতে পারে দেশে অধিক হারে বিয়ে বিচ্ছেদ তথা পরিবার ভেঙে যাওয়ার প্রবণতা। পত্র-পত্রিকার তথ্যানুযায়ী, রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের মাসে গড়ে প্রায় তিন হাজারের বেশি ডিভোর্সের আবেদন জমা পড়ে। ডির্ভোসের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীরাই বেশি আবেদন করছে। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় ডিভোর্সের হার বেশি। এর কারণ হিসেবে ধরা হয় নারীদের মধ্যে অধিকমাত্রায় স্বনির্ভর হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি। এছাড়া নীতি-নৈতিকতার স্থান দুর্বল হয়ে যাওয়া, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে নারী-পুরুষের যোগাযোগ স্থাপন, বিয়ে ও অবশেষে প্রতারণার শিকার হওয়া। শুধু অভিজাত এলাকাই নয়, নি¤œবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তের মধ্যেও ডিভোর্সের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে রয়েছে পারিবারিক মূল্যবোধের অভাব এবং নীতি-নৈতিকতার স্খলন। সমাজবিদরাও বলছেন, নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাবে পারিবারিক বন্ধন ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। যান্ত্রিক জীবনে বাড়ছে অস্থিরতা ও হতাশা। অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে মানুষ। শহরাঞ্চল ও উচ্চবিত্তদের মধ্যে পারিবারিক অপরাধের মাত্রা বেশি। এসব ক্ষেত্রে ভিনদেশি বিশেষ করে ভারতীয় টেলিভিশন সিরিয়ালের বিকৃত গল্প, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাব দায়ী। এছাড়া অর্থনৈতিক দুরবস্থা, পরকীয়া সম্পর্ক, মাদকাসক্তি, আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতা, অসুস্থ প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব মানুষের মূল্যবোধকে নষ্ট করে দিচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানীরা এ কথাও বলছেন, সামাজিক ও পারিবারিক পর্যায়ে সংহতি ও বন্ধন আলগা হয়ে যাওয়ায় মারাত্মক অপরাধের ঘটনা ঘটছে। তা নাহলে একজন পিতা বা মাতা তার সন্তানকে, সন্তান পিতা-মাতাকে খুন করতে পারে না। এ ধরনের ঘটনা কোন স্বাভাবিক ঘটনা নয়।
তিন.
সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ ধরে রাখার মূল নিয়ামক শক্তি রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থায় যদি গলদ থাকে, তবে এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সর্বত্র পড়তে বাধ্য। সুশাসন থাকলে তার ফলাফল পরিবার ও সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। যারা শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত, তাদের মনোভাব যদি হয় বেডরুম পাহারা দেয়া সম্ভব নয়, তাহলে তো অপরাধীরা বেডরুমে প্রবেশ করে মহাউল্লাসে নাচার প্রশ্রয় পাবেই। তা তারা করছেও। বেডরুমের মতো চারদেয়ালের মধ্যে নয়, প্রকাশ্যেই কুপিয়ে মানুষ হত্যা করছে। কোন নাগরিকই প্রত্যাশা করে না, সরকার তার বেডরুম পাহারা দিক। তার প্রয়োজনও নেই, যদি সরকার ঘরের বাইরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। এখন পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, ঘরের বাইরেই মানুষকে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হচ্ছে। তাদের স্বাভাবিক চলাচল ও নিরাপত্তা নাজুক হয়ে পড়েছে। অথচ বাইরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রয়েছে। তাহলে মানুষ কেন নিরাপদবোধ করছে না? এ প্রশ্নের উত্তর সহজ। যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জননিরাত্তা বিধান করবে, তাদের একটি শ্রেণীর বিরুদ্ধে খুন, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, বিনা কারণে মানুষকে হয়রানি, আটকে রেখে অর্থ আদায়, থানায় নিয়ে নির্যাতনের মতো মারাত্মক অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ এখন হরহামেশা উঠছে এবং তার প্রমাণও মিলছে। সাধারণ মানুষ তো বটেই সাংবাদিক, আইনজীবী, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ পর্যন্ত তাদের হয়রানি থেকে বাদ যাচ্ছে না। রক্ষকই যদি ভক্ষক হয়ে উঠেÑতবে নিরাপত্তা বলে কোনো কিছু থাকার কথা নয়। এ কথাও অস্বীকার করা যায় না, অপরাধের সাথে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন অনেক সদস্যর শাস্তিও হয়। শাস্তি হতেই পারে। কারণ তারাও মানুষ এবং ভুল-ত্রæটির উর্ধ্বে নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, শাস্তিপ্রাপ্তদের সংখ্যাটি যদি দুই-চার-পাঁচজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে একটা কথা থাকত। তা ন হয়ে এ সংখ্যা শত শততে গিয়ে ঠেকছে। অপরাধের এই চিত্র নিশ্চিতভাবেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা বৃদ্ধিতে সহায়ক নয়। অর্থাৎ যারা সমাজ থেকে অপরাধ দূর করার দায়িত্বে নিয়োজিত, তারা যদি অপরাধে জড়িয়ে পড়ে এবং অপরাধীকে প্রশ্রয় দেয়, তবে সমাজ ঠিক থাকবে কীভাবে? তাদের যদি বেডরুম পাহারা দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়, তাতেও মানুষের নিরাপদবোধ করার কোন কারণ থাকতে পারে না। তাদের মধ্যে এ শঙ্কা কাজ করতে পারে, বেড়ায় যদি ক্ষেত খেয়ে ফেলে, তখন কি হবে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যর ভয়ংকর অপরাধে জড়িয়ে পড়ার কারণ কি? এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, পুলিশকে যদি দলীয় বাহিনীর মতো ব্যবহার করা হয়, তখন এ ধরনের ঘটনা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শাসক শ্রেণীর রক্ষাকবচ হয়ে উঠে। শাসক ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্যে চলে যায়। এর বাইরে রয়ে যায় সাধারণ নাগরিক। তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্য তাদের প্রতি অবিচার করলেও, তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ তাদের মধ্যে এ ধারণা জন্মায়, আমরা সরকার দলীয়, আমাদের বিচার করবে কে? আবার এ কথাও শোনা যায়, কোন কোন বিশেষ থানার দায়িত্ব পাওয়ার জন্য ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা উন্মুখ হয়ে থাকেন। প্রয়োজনে তারা কোটি কোটি টাকা খরচ করতেও রাজী। এ যদি হয়, পরিস্থিতি তাহলে যে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কোটি টাকা খরচ করে কাক্সিক্ষত থানায় পোস্টিং পায়, তার পক্ষে কি সংশ্লিষ্ট এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং সামাজিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? সম্ভব নয়। কারণ তাকে পোস্টিং পেতে যে কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে তা তুলে তাকে লাভ করতে হবে। তাকে এ অর্থ লাভ করতে হবে অপরাধীদের কাছ থেকে। কাজেই অপরাধ ও অপরাধী যদি না থাকে তবে তার এই অর্থ কখনোই ফিরে আসবে না। একশ্রেণীর পুলিশের এমন অসদাচরণ এবং অলিখিত প্রশ্রয় পেয়েই দুর্বৃত্তরা দাপিয়ে বেড়ায় ও বেড়াচ্ছে। তবে যেসব পুলিশ সদস্য সৎ এবং প্রকৃতই জনসাধারণের বন্ধু হতে চান, তারা স্বীকার করেন, রাজনৈতিক কারণে এবং কিছু অসৎ পুলিশ সদস্যর কারণে পুরো বাহিনীর বদনাম হচ্ছে। তাদের প্রশ্রয়েই সন্ত্রাসীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
চার.
পারিবারিক, সামাজিক নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ধর্মীয় অনুশাসনÑএসব কোন আইনের মাধ্যমে হয়নি। জীবনকে সুশৃঙ্খল ও সঠিকপথে পরিচালিত করার লক্ষ্যেই মানুষ নিজস্বার্থে এসব মানবিক গুণাবলী ধারণ করেছে। তা নাহলে মানুষ সেই আদিম যুগেই পড়ে থাকত, আজকের সভ্যযুগে বসবাস করত না। আইনের মাধ্যমে অপরাধীকে শাস্তি দিয়ে হয়তো দৃষ্টান্ত স্থাপন ও অন্যদের সতর্ক করা সম্ভব। তবে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে শোধরানো সম্ভব নয়। এজন্য পরিবার ও সমাজের মহৎ ব্যক্তিদের এগিয়ে আসা উচিত। পরিবার ঠিক থাকলে সমাজে তার প্রতিফলন ঘটে। পরিবারের অভিভাবক শ্রেণীকেই এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে হয়। নবীণ সদস্যদের আচার-আচরণ ও চলাফেরার দিকে তী² নজর রাখা এবং পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয়মূল্যবোধের চেতনা তুলে ধরা তাদের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে এখন টান ধরেছে। ফলে মূল্যবোধের অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করেছে। তরুণরা রোমহর্ষক ঘটনা ঘটিয়ে চলছে। এ পরিস্থিতি উত্তরণে পরিবার ও সমাজের অভিভাবক শ্রেণীকে সচেতন হতে হবে। নিজ নিজ পরিবার ও এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে উদ্যোগী হতে হবে। যেসব তরুণ অপকর্মে লিপ্ত তাদের পরিবারের অভিভাবকদের সাথে কথা বলতে হবে। স্কুল, কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয়মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে শিক্ষকদের মোটিভেশনাল ভূমিকা রাখতে হবে। জুম্মার নামাজের সময় মসজিদের ইমামদের এ ব্যাপারে বয়ান দিতে হবে। এখন আমরা এমন এক সময় অতিক্রম করছি, কেউ ধর্মীয় কথা বললে তাকে বক্রদৃষ্টিতে দেখা হয়। অথচ সারা বিশ্বেই এখন মানুষ স্ব স্ব ধর্মের প্রতি সবচেয়ে বেশি ঝুঁকছে। পার্শ্ববর্তী দেশসহ উন্নত বিশ্বের সিনেমাগুলোতে অহরহ তাদের ধর্মকে উপস্থাপন করছে। এর মূল অর্থই হচ্ছে, মানুষকে মানবিক করে তোলা। আমাদের দেশ নিশ্চয়ই তাদের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত নয়। তবে আমরা যে পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয়মূল্যবোধ থেকে তাদের চেয়ে এগিয়ে, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। এ প্রজন্মের তরুণ-তরুণী, যারা সোস্যাল মিডিয়া নিয়ে সারাক্ষণ পড়ে থাকে, সেই তাদেরকেই দেখা গেছে ভূমিকম্পের মতো বিপদের সময় অসহায় হয়ে পড়তে। অনেককেই দেখা যায়, ধর্মীয় কথাবার্তা লিখে এবং অন্যকেও ধর্মীয় আচার-আচরণে উদ্বুদ্ধ করতে। এ থেকেই বোঝা যায়, এ প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা সাময়িক মোহে ধর্মীয় অনুশাসন থেকে বিস্মৃত হলেও, ভয়াবহ বিপদ থেকে রক্ষা পেতে ধর্মের কাছেই আত্মসমর্পন করছে। তাদের এই বিস্মৃতপ্রায় ধর্মীয় শাসন-বারণকে জাগিয়ে তুলতে পরিবার ও সমাজের অভিভাবকদের ভূমিকা রাখা এখন সময়ের দাবী। তা নাহলে আত্মহত্যা, পরিবারের সদস্যদের খুনের মতো মহাঅপরাধ কোনভাবেই ঠেকানো যাবে না। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যথাযথ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করা দরকার। তাদের কাছ থেকে অপরাধীর প্রতি কঠোর ও সাধারণ মানুষের প্রতি বন্ধুসুলভ আচরণ কাম্য। সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে শুধু অপরাধ বা অপরাধীদের ধরণ নিয়ে গবেষণা করলে চলবে না। পারিবারিক ও সামাজিক পরিবর্তন কীভাবে হচ্ছে, কোন দিকে ধাবিত, এসব বিষয় নিয়েও গবেষণা করা প্রয়োজন। দলীয় দিক বিবেচনা না করে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের দিকে তাকাতে হবে। অপরাধীর ক্ষমতার উৎসের দিকে না তাকিয়ে অপরাধীর অপরাধকে আমলে নিতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।