ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
মো. তোফাজ্জল বিন আমীন : শিশু কথাটা শুনলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে সুন্দর-নিষ্পাপ এক মায়াবী চেহারা। শিশু আল্লাহ তায়ালার বিশেষ নেয়ামত। তাই তো সহৃদয় মানুষে শিশুকে কাছে পেলে কোলে টেনে নিয়ে আদর করে। শিশুরা বাবা- মা ও আত্মীয় স্বজনের আনন্দের খোরাক। হবিগঞ্জের বাহুবলে চার শিশু হত্যার খবর যেসময়ে পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হয়েছে সে সময়টা অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে নাজুক। প্রতিনিয়ত পত্রিকার পাতায় চোখ বুলালেই শিশুহত্যা আর নির্যাতনের বীভৎস কাহিনীর সংবাদ দেখতে হয়। বর্বরতা ও নির্মমতার রোমহর্ষক ঐসব ঘটনা দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, আমরা কি আদৌ কোন সভ্য দেশে বসবাস করছি? নাকি জাহেলিয়াতের যুগে চলে যাচ্ছি। এমন নিষ্ঠুর কি করে হয় মানুষ ? সৃষ্টির সেরা জীব হয়ে মানুষ কেমন করে কোমলমতি শিশুকে হত্যা করছে তা কল্পনা করতেই গা শিউরে ওঠে।
এই নিষ্ঠুর-পৈশাচিক হত্যাকা-গুলো রীতিমতো বাবা-মাকে অস্থির করে দিচ্ছে। সন্তানকে স্কুলে পাঠাতেও ভয় পাচ্ছেন অভিভাবকরা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই দেশ শিশু হত্যার দেশে পরিণত হয়েছে। গুম, খুন, অপহরণ, ধর্ষণের মহোউৎসব চলছে সর্বত্র। দেশের কোথাও আজ এতটুকু জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে না. যেখানে দাঁড়িয়ে বলতে পারি, আমরা ভালো আছি। ভেলকিবাজির উন্নয়নের কথা যেভাবে চারদিকে শোনা যায় সেভাবে যদি শিশু হত্যা বন্ধের শাস্তির কথা শোনা যেত তাহলে নদী-নালা, খাল-বিল, ঝোপঝাড়ে কোমলমতি শিশুদের গলিত-অর্ধগলিত লাশ পাওয়া যেত না। শিশুর প্রতি এমন নিষ্ঠুর আচরণ বনের হিং¯্র জানোয়াররা করলে একটা কথা ছিল। মানুষ হয়ে এমন অমানুষের কাজ মানুষ কী করে করতে পারে, তা কি ভাবা যায়! ঔসব নরঘাতকের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, তোমাদের বাড়ীতে কি কোনে শিশু নেই? তারা কি তোমাদের বাবা বা ভাই বলে সম্বোধন করে না। শিশুর প্রতি কারও মনে যদি ভালোবাসার উদয় না হয় তাহলে তাকে মানুষ হিসেবে গণ্য না করাই ভালো। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার ‘ছাড়পত্র’ কবিতায় শিশুর কাছে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেও বাংলাদেশের পরিস্থিতি তার বিপরীত ¯্রােতে ভাসছে।
সভ্যসমাজের মানুষরা যেখানে শিশুদের জন্য বাস উপযোগী পৃথিবী গড়ে তুলতে প্রতিনিয়ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে একশ্রেণীর মানসিক বিকারগ্রস্ত নিষ্পাপ শিশুদের নির্মমভাবে হত্যা করে উল্লাস করছে। সাম্প্রতিক সময়ে বর্বরভাবে একের পর এক শিশুহত্যার ঘটনা বিবেকবান মানুষকে কাঁদিয়ে চলেছে। শিশু রাজন, রাকিব, তক্কী, আব্দুল্লাহর খুনের স্মৃতি মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়। সর্বশেষ করুণতম দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো হবিগঞ্জের বাহুলবল উপজেলা সুন্দ্রাটিকি গ্রাম। মাটির ভেতর থেকে শিশুর বেরিয়ে থাকা হাত! নির্মম এক খবরে ঘুম ভেঙেছে মানুষের। আবারো দেশবাসীকে দেখতে হয়েছে সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির মতো নির্মম কষ্টের চিত্র। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে মানুষের দায় থাকলেও শেষ পর্যন্ত স্রেফ দুর্ঘটনাতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু হবিগঞ্জের বাহুবলের শিশু হত্যার ঘটনাকে কোনভাবেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যায় না। নিখোঁজের পাঁচদিন পর ৭ থেকে ১০ বছর বয়সী চার শিশুর মৃতদেহ উদ্ধারের চিত্র ২০০৯ সালের পিলখানার ঘটনা আবারও মনে করিয়ে দিয়েছে দেশবাসীকে। এই মানুষরূপী হায়েনাদের চরম অমানুষিকতার শিকার শুভ, মনির, তাজেল এবং ইসমাইল। লাশ দেখে স্বজনদের কান্না আর আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে সুন্দ্রাটিকি গ্রামের বাতাস। স্বজনদের চোখের পানি, আহাজারি আর নিষ্পাপ শিশুগুলোর করুণ মুখ দেখে চোখের বাঁধ ধরে রাখতে পারেনি সাধারণ মানুষও।
গত কয়েক সপ্তাহে পত্রিকার পাতায় সন্তানহারা মা-বাবার আর্তনাদের ছবিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সভ্যতার কত নীচে চলে যাচ্ছে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের আইনের শাসন। একের পর এক জঘন্যতম ঘটনায় মা-বাবার রঙিন স্বপ্ন মরুভূমির বালির মতো ঝড়ো হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে। সাজানো-গোছানো সংসারে নেমে আসছে অমানিশার অন্ধকার। সিলেট ও খুলনার বর্বরোচিত হত্যাকা-ের শিকার তিন শিশু রাজন, রাকিব এবং সাঈদের মামলার কার্যক্রম নি¤œ আদালতে যে দ্রুততার সাথে সম্পন্ন হয়ছে, তা বিচার বিভাগের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ন্যায়বিচারের এই নমুনা যদি সর্বত্র বিরাজ করতো তাহলে শিশু হত্যাসহ সকল হত্যাকা-ের রাস টেনে ধরা যেত। নিকট অতীতের ৭ খুন, ৫ খুন, ৪ খুন আর পরিবার শুদ্ধ খুনের লোমহর্ষক ঘটনাগুলো নাগরিকদের শুধু স্তম্ভিত করেনি রীতিমতো অস্থির করে তুলেছে। শুধু অপরাধীদের হাতেই নয়, অনেক সময় মা-বাবার হাতেও শিশু খুনের শিকার হচ্ছে। রাজধানীর বেইলি রোডে একটি ভবনের ৬ তলা থেকে সদ্যজাত সন্তানকে ফেলে দিয়েছেন এক মা! কিন্তু মাটিতে না পড়ে ভবনের দ্বিতীয় তলার সানশেডে আটকে কান্না করতে থাকে শিশুটি। হৈ-চৈ শুরু হয় আশপাশের বাসিন্দাদের মধ্যে। পরে স্থানীয়রা শিশুটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়। ধামরাইয়ে পলিথিনের ব্যাগে জীবন্ত এক শিশু পাওয়া গেছে। যে শিশুটির ঘুমিয়ে থাকার কথা ছিল মায়ের কোলে পরম যতেœ, তাকে কিনা পাওয়া গেল একটি পলিথিন ব্যাগে। বুধবার সকালে ঢাকার ধামরাইয়ে সূয়াপুর বাজারের দক্ষিণ পাশে গ্রামীণ ফোন নেটওয়ার্কের (টাওয়ার) কাছে একটি পুকুর পাড়ে এ ঘটনা ঘটে। ওই দুই ঘটনা সত্যিই মানবিক মূল্যবোধের চরম বিপর্যয়ের নমুনা মাত্র। উন্নয়নের জোয়ারের সাথে পাল্টা দিয়ে শিশুর প্রতি সহিংসতা বেড়েই চলেছে। একের পর এক শিশু খুন করা হলেও কারও ঘুম ভাঙছে না।
যেভাবে পৈশাচিক কায়দায় হত্যাকা- যত্রতত্র অহরহ সংগঠিত হচ্ছে তা সভ্য সমাজে নজিরবিহীন। এই পৈশাচিক, ভয়ানক ও বীভৎস হত্যাকা-ের স্থিরচিত্র ধারণ করে তা সামাজিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে মানুষরূপী হায়েনারা। সম্প্রতি যে নৃশংস ঘটনাগুলো সংঘটিত হয়েছে তার কিছু বিবরণ পাঠকদের জ্ঞাতার্থে পেশ করা হলো। গত ৩ জানুয়ারি ঝিনাইদহের শৈলকুপার কবিরপুর মসজিদপাড়ায় তিন শিশুকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। ৯ জানুয়ারি গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার হরতুকিচালা থেকে রাব্বী হোসেন নামের এক শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের ২ নম্বর বাবুরাইলে পাঁচজনকে হত্যা করা হয়, তাদের মধ্যে দু’জন শিশু। ১৯ জানুয়ারি কক্সবাজারের রামুর বড়বিল গ্রামের একটি ফলের বাগান থেকে মোহাম্মদ শাকিল ও মোহাম্মদ কাজল নামের দুই সহোদরের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২৮ জানুয়ারি শুক্রবার রাতে রংপুর নগরের আদর্শপাড়া থেকে রাহিমুল ইসলাম রনক নামে এক শিশুর বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয়। ২৮ জানুয়ারি শুক্রবার ঢাকার ধামরাইয়ে শাকিল ও ইমরান নামে দুই স্কুলছাত্রের লাশ উদ্ধার করা হয়। ৩০ জানুয়ারি মুন্সীগঞ্জ সদরের মালির পাথর এলাকার একটি পরিত্যক্ত ঘর থেকে নীরব নামে এক মাদ্রাসা ছাত্রের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ৩১ জানুয়ারি শেরপুরে নুর আলম নামে এক স্কুলছাত্রের লাশ পাওয়া যায়। চলতি মাসের ২ ফেব্রুয়ারি কেরাণীগঞ্জে স্কুলছাত্র আবদুল্লাহর লাশ উদ্ধার করা হয়। ৫ ফেব্রুয়ারি সাভারের আশুলিয়ায় ইমন নামে এক স্কুলছাত্র নিখোঁজ হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের ছাতকে ১০ বছরের এক শিশুর গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ১০ ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রামের শিমুলবাড়ি উপজেলায় মাদ্রাসার এক শিশুকে অপহরণ করা হয়। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরে কাশিমপুর এলাকায় সোলায়মান নামে চার বছরের এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএফ) তথ্য অনুযায়ী, গত চার বছরে একহাজার ৬৯ শিশু হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে ২৯২, ২০১৪ সালে ৩৫০, ২০১৩ সালে ২১৮ এবং ২০১২ সালে ২০৯ শিশু খুন হয়েছে। চার বছরে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯৭৬ শিশু। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত হত্যার শিকার হয়েছে ২৯ শিশু। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৫ সালে দেশে ১৩৩ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। আর ২০১৪ সালে হত্যার শিকার হয়েছে ৯০ শিশু। নতুন বছরের প্রথম মাসেই হত্যার শিকার হয়েছে ১১ শিশু। শিশু অধিকার ফোরামের সূত্র থেকে জানা যায় যে, ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ৪৯ মাসে হত্যাকা-ের শিকার ১ হাজার ৮৫ ও ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯৭৬ শিশু। এর মধ্যে ২০১৫ সালে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২ হাজার ৮৮১ শিশু। যার মধ্যে খুন ২৯২, ধর্ষণ ৫২১ ও অপহরণের শিকার ২৪৩ শিশু। ২০১৪ সালে শিশু খুন হয়েছে ৩৬৬, ২০১৩ সালে ২১৮ ও ২০১২ সালে ২০৯ শিশু। ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে শিশু ধর্ষণ বেড়েছে ১৬১ দশমিক ৮১ শতাংশ, অপহরণ বেড়েছে ১৬ দশমিক ২৭ শতাংশ। তবে ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে অপহরণের পর উদ্ধারের হার বেড়েছে ৮১ দশমিক ৫২ শতাংশ। শিশু অধিকার ফোরাম সূত্র আরও জানায়, ২০১৫ সালে হত্যাকা-ের শিকার ২৯২ শিশুর মধ্যে ৪০ জনকে অপহরণের পর হত্যা, ৬৭ শিশু নিখোঁজ হওয়ার পর লাশ উদ্ধার, ৪০ শিশুকে পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা, ৩০ শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা ও ২৫ শিশু নিহত হয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতায়।
মানুষের পাশবিকতার বহিঃপ্রকাশ তো একদিনে হয়নি। অপরাধ করে দিনের পর দিন অপরাধীরা পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতিই মানুষের ভেতরে হতাশা তৈরি করছে। অবক্ষয় যখন সমাজের সর্বত্র বিরাজ করে তখন এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে কেউ রেহাই পায় না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক হত্যাকা-ের বিচারহীনতার সংস্কৃতিই মূলত সন্ত্রাস, খুন, অপহরণ, শিশুদের প্রতি সহিংসতার জন্য দায়ী। পারিবারিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণেও শিশুরা নির্যাতন ও হত্যাকা-ের শিকার হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুদের অপহরণ ও হত্যা করা হয় মুক্তিপণের জন্য। শিশু নির্যাতন রোধকল্পে কেউ যেন এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তির সাহস না পায়, সেজন্য শিশু নির্যাতনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। যে দেশের শিশু ক্ষমতাসীন এমপির গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালের বেডে কষ্টের যাতনায় ছটফট করে সে দেশের শিশুর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কে দেবে? এই প্রশ্ন হাজারো অভিভাবকের। মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করার জন্যে আদর্শিক মূল্যবোধের বিকল্প নেই। আইনের শাসন রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে গলিত-অর্ধগলিত-বীভৎস লাশের ছবিগুলো প্রতিকার ও প্রতিরোধহীন নির্বিকার অকৃতজ্ঞ রাষ্ট্রকে শুধু ধিক্কারই দেবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।