Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতা রুখতে হবে

প্রকাশের সময় : ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শিশুরা একটি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সবচেয় অগ্রাধিকার পাওয়া সদস্য। তারা একদিকে যেমন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের দয়া ও নিরাপত্তার উপর নির্ভরশীল, অন্যদিকে তাদের সঠিকভাবে গড়ে তোলার উপরই নির্ভর করে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি। শিশুদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের উপর নির্যাতন করার ইতিহাস কোন বর্বর সমাজেও বিরল ঘটনা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের সমাজে সেই নির্মম বাস্তবতার অসংখ্য উদাহরণ দেখা যাচ্ছে। শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত করা, চুরির মিথ্যা অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা, গাড়ির চাকায় হাওয়া দেয়ার কম্প্রেসার মেশিনে পায়ুপথে হাওয়া ভরে নির্মমভাবে হত্যা, গুলিতে আহত করা ইত্যাদির মতো ঘটনা ঘটেছে। মূলত: আমাদের পুরো সমাজব্যবস্থাতেই এক ধরনের পচন ধরেছে। সমাজের একশ্রেণীর প্রভাবশালী মানুষ বেপরোয়া দুর্নীতি, লুটপাট ও দখলবাজিতে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতাবানদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে পুলিশের একশ্রেণীর সদস্যও বেপরোয়া, অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠায় সাধারণ মানুষ চরম অসহায়ত্ব বোধ করতে শুরু করেছে। মানুষের মধ্যে পারিবারিক, সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার বোধ যতই বিস্তৃত হচ্ছে সমাজের দুর্বল শ্রেণী হিসেবে শিশুরা যেন বেশি নির্মম-নিষ্ঠুরতার সম্মুখীন হচ্ছে। অর্থনৈতিক বিরোধ এবং পারিবারিক কোন্দলের শিকার হয়েও প্রাণ হারাচ্ছে শিশুরা। সিলেটে রাজন হত্যা থেকে শুরু করে সম্প্রতি ঢাকার কেরানীগঞ্জে স্কুলছাত্র আব্দুল্লাহর অপহরণ এবং হত্যা পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহে আমাদের শিশুদের সামাজিক নিষ্ঠুরতার শিকার হওয়ার নির্মম চিত্র বেরিয়ে এসেছে।
 বাংলাদেশে শিশুদের প্রতি নৃশংসতার এই ভয়াল চিত্র সমাজের একটি শ্রেণীর মনোবিকলন এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাহীনতার বাস্তবতাই তুলে ধরে। গত বছর  অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্য শিশু হত্যা, অপহরণ ও নির্যাতন বৃদ্ধির ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শিশু সহায়তা সংস্থা ইউনিসেফ। ইউনিসেফের বিবৃতিতে শিশুদের উপর নৃশংসতা ও নির্মম হত্যাকা-ের সাথে জড়িতদের বিচারের সম্মুখীন করতে এবং এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে বাংলাদেশ সরকারকে সম্ভাব্য সব ধরনের উদ্যোগ বা পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। সিলেটে রাজন হত্যা এবং খুলনায় রাকিব হত্যার ঘটনায় আসামীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে ইতিমধ্যে সর্বোচ্চ শাস্তির রায় ঘোষিত হলেও দেশে শিশু অপহরণ, হত্যা ও শিশুদের উপর নির্যাতন কমেনি। গত সপ্তায় ইনকিলাবে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, সামাজিক হানাহানি, পারিবারিক সংঘাত, দুর্বৃত্তের আক্রমণ ও নির্যাতন ও দুর্ঘটনাসহ দেশে হতাহত হয়েছেন শিশুসহ আড়াই হাজারের বেশি মানুষ। সম্ভবত: গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশগুলোতেও একমাসে এমন বিপুলসংখ্যক মানুষ হতাহত হচ্ছে না।
যুদ্ধেরও কিছু নিয়মনীতি ও কনভেনশন থাকে। সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয় ও দুর্বৃত্তায়িত সমাজে তাও থাকে না। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নৈতিক অধ:পতন এবং আইনের শাসন না থাকায় আমাদের সমাজে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতা এখন চরম আকার ধারণ করেছে। জমিজমা ও ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব, পারিবারিক বিরোধ, মুক্তিপণ আদায়সহ প্রতিশোধ গ্রহণের সহজ লক্ষ্যবস্তু হিসেবে শিশুদের টার্গেট করছে দুর্বৃত্ত অপরাধিরা। অনেক ক্ষেত্রে শিশুকে অপহরণের পর মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দিয়েও পরিবারের সদস্যরা ফিরে পাচ্ছে প্রিয় সন্তানের মৃত-গলিত লাশ। গতকাল প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ঢাকা শহরের একটি সুপরিচিত প্রাইভেট হাসপাতালে দেড় বছরের এক শিশু চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়ার পরও আইসিইউতে রেখে টাকা আদায়ের কৌশল গ্রহণ করেছিল হাসপাতালের দায়িত্বরতরা। বুধবার র‌্যাবের বিশেষ অভিযানে এই তথ্য উদঘাটিত না হলে আইসিইউ বিল হিসেবে শিশুটির পরিবারকে হয়তো মোটা অংকের গচ্চা দিতে হতো। এভাবেই চিকিৎসার নামে এমনকি মৃত লাশ নিয়েও মিথ্যা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে সমাজের জোচ্চোর দুর্বৃত্ত শ্রেণীর মানুষ। সরকারের পক্ষ থেকে জাতিকে উন্নয়নের নানা প্রকার গালভরা বুলি শোনানো হচ্ছে। একটি শিশুও পথে ঘুমাবেনা বলে আশ্বস্ত করা হচ্ছে। অথচ শহরের বস্তিতে, ফুটপাতে মানবেতর জীবনযাপনকারী মানুষ ও শিশুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। অপহরণ ও খুনের শিকার হচ্ছে শিশুরা। এসব অপরাধের সাথে জড়িতদের খুব স্বল্পসংখ্যকই বিচারের সম্মুখীন হচ্ছে। শিশু হত্যার মতো পাশবিক নির্মমতার পরও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধিদের ধরতে পুলিশের ব্যর্থতা এবং বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি দেখা যাচ্ছে তা আমাদের পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার উপরই অনাস্থা সৃষ্টি করছে। সামাজিক, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া শুধুমাত্র তাৎক্ষণিক লোক-দেখানো পুলিশি অ্যাকশন ও রাজনৈতিক গলাবাজি করে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা রোধে কঠোর আইনী ব্যবস্থার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা ও আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারে সমাজকল্যাণকামী সংস্থা, আলেম-ওলামা ও সমাজনেতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতা রুখতে হবে
আরও পড়ুন