পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
শতকোটি মানুষের দেশ ভারত শত শত বছরে হিন্দু-মুসলমান সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। জাতিগত বৈচিত্র্য ও বিশাল জনসংখ্যার হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তিভুমি গড়ে উঠেছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ধর্মনিরপেক্ষ সাংবিধানিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তিতে। স্বাধীনতার ৭০ বছর পেরিয়ে এসে ভারতের শাসকরা এখন দেশকে হিন্দুত্ববাদের মোড়কে আবৃত করতে গিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাস ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অবশিষ্ট পরিবেশ নস্যাৎ করে দিতে চাইছেন। ভোটের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নতুন কিছু নয়। ভারতের মত বিভিন্ন ভাষা ও ধর্মীয় সংস্কৃতির দেশে মানুষের দারিদ্র্য, ধর্মান্ধতা ও অশিক্ষাকে পুঁজি করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আবেগ-অনুভুতিকে কাজে লাগিয়ে ভোটের বৈতরনি পার হয়ে ক্ষমতার মসনদ দখলের অপচেষ্টা ভারতের সংখ্যাগরিষ্ট হিন্দুরা কখনো মেনে নেয়নি। এ কারণেই ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের অনুসারি রাজনৈতিক দলের হাতেই সব সময় ক্ষমতার দন্ড তুলে দিয়েছে ভারতের জনগণ। গণতান্ত্রিক ও মানবিক ভারতের ঐতিহ্য মন্ডিত ভারতের সে ইতিহাস যেন পাল্টে দিতে চাইছে একটি ধর্মান্ধ গোষ্ঠি। তারা ভোটের রাজনীতিতে নিজেদের আসন পাকাপোক্ত করে নিতে দেশের সংখ্যালঘু মুসলমান তথা দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিচ্ছে। ভোটের অংকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যে অমানবিক মুসলিম বিদ্বেষ জমে উঠেছে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। ভারতের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক মুসলিম নির্যাতনের ঘটনায় মুসলমানদের পাশাপাশি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ, উদারপন্থী রাজনৈতিক নেতা ও সুশীল সমাজকেও প্রতিবাদি ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে।
ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে একের পর এক মুসলিম নির্যাতন, হত্যাকান্ড ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা শাসকদল বিজেপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর উগ্রজাতীয়তাবাদি রাজনীতিরই প্রত্যক্ষ ফল। মুসলিম বিদ্বেষ উস্কে দিয়ে ভোটের রাজনীতিতে সাফল্য নিশ্চিত করতে বিজেপির পরিকল্পনা সফল হয়েছে। সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পর বোঝা যাচ্ছে, শুধুমাত্র ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনই তাদের রাজনীতির মূল লক্ষ্য নয়। তাদের নির্বাচন পরবর্তি সাম্প্রতিক তৎপরতা দেখে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে, তারা ভারতের সব নাগরিকের উপর উগ্র হিন্দুত্ববাদি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। এ লক্ষ্যে তারা প্রথমেই বৃহত্তম সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠি হিসেবে মুসলমানদের টার্গেট করেছে। পিটিয়ে হত্যা করার আগে চুরির মিথ্যা অভিযোগ, গরুর গোস্ত খাওয়া বা রাখার অভিযোগের পাশাপাশি জয় শ্রীরাম, জয় হনুমান ইত্যাদি সাম্প্রদায়িক শ্লোগান দিতে বাধ্য করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হতে দেখা যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই সেদেশের কোথাও না কোথাও এমন ঘটনা ঘটে চলেছে। এসব ঘটনার অতি সামান্যই গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসে। সিংহভাগ ঘটনাই লোক চক্ষুর আড়ালে থেকে যায়। দেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক গোষ্ঠির প্রত্যক্ষ মদতে স্থানীয় রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠি প্রকাশ্য দিবালোকে একের পর এক নৃশংস ঘটনার জন্ম দিয়ে চলেছে। মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে নতুন নাগরিক পঞ্জির ইস্যু তৈরী করে কোটি কোটি মুসলমান বাংলাভাষাভাষি মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। সংখ্যার হিসেবে ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মুসলমান জনবহুল দেশ। ভারতে মুসলমানদের হাজার বছরের ইতিহাস ভারতীয় সভ্যতা ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে ওঠার ইতিহাস। কোনো উগ্রবাদি রাজনৈতিক গোষ্ঠি এই ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে কলঙ্কিত করে টিকে থাকতে পারবে না। এ ধরণের বাস্তবতা ভারতের জাতীয় সংহতি ও রাজনৈতিক অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে ভারতের মুসলমানদের হিন্দুত্ব বরণে বাধ্য করা যাবে না। ৩০/৩৫ কোটি জনগোষ্ঠীকে নির্মূল বা দেশছাড়া করাও সম্ভব নয়। এতে ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাসকেই শুধু কলঙ্কিত করা হচ্ছে। মুসলমানদের সাথে ভারত রাষ্ট্রের আচরণ শুধু বিশ্বের মুসলমানরাই প্রত্যক্ষ করে ব্যথিত হচ্ছে না সেই সাথে বিশ্বসম্প্রদায়ও দেখছে এবং মুখ খুলতে শুরু করেছে। ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম বিষয়ক এক প্রতিবেদনে, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের তরফে মুসলমানদের সাথে ভারতের আচরণের নিন্দা জানানো হয়েছে। সাম্প্রদায়িক এজেন্ডাকে সামনে রেখে উগ্রপন্থি গ্রুপগুলোর মুসলমানদের উপর হামলা, মুসলমানদের বাড়িঘর, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙ্গচুর অগ্নিসংযোগ ও পিটিয়ে হত্যার মত নৃশংস ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিস্ক্রীয়তা অথবা মুসলিম বিদ্বেষী ভূমিকাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হিসেবেই গণ্য করা যায়। উগ্র জাতীয়তাবাদি গ্রুপের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমর্থন ও বৈধতা দেয়ার নজির থেকেই বিজেপির মুসলমান বিদ্বেষের রাজনৈতিক এজেন্ডা পরিস্কার হয়ে যায়। ভারতে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠির দাঙ্গা ও মুসলমান বিদ্বেষের ইতিহাস নতুন নয়। ভারতের এই মুসলিম বিদ্বেষী নির্যাতনের ঘটনার প্রভাবে কখনো বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উপর প্রভাব ফেলতে পারেনা। ইসলাম এবং গণতান্ত্রিক মুল্যবোধের রাজনীতি কখনো সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতাকে প্রশ্রয় দেয় না। তবে নিকটতম প্রতিবেশী দেশে মুসলমানদের উপর নির্যাতনে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের হৃদয় ব্যথিত হয়। এ অবস্থায় আমাদের সরকার নিরব থাকতে পারে না। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মুসলিমবিদ্বেষী সহিংসতা উপমহাদেশের শান্তি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইতিমধ্যে ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা বিজেপির মুসলিম বিদ্বেষকে ফ্যাসিবাদি ভূমিকা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ এবং গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা একসাথে চলতে পারে না। ভারতের ক্ষমতাসীন রাজনীতিক ও জনগণকে যে কোনো একটি বেছে নিতে হবে। তাছাড়া ভারতের গতিপথ ইতিহাসই নির্ধারণ করবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সম্প্রীতির জয় হোক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।