পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
যে নির্বাচনে বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি ভূমিধস বিজয় লাভ করে দ্বিতীয় বারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্র্বাচিত হন, সে নির্বাচনে জনৈক বিজেপি নেতা নির্বাচনী প্রচারকালে এরকম মন্তব্য করেছিলেন যে, মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন ও দুর্বল করতে হলে নরেন্দ্র মোদিকে পুনরায় নির্বাচিত করুন। নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করেছে, বিজেপি নেতাকর্মীদের সে খাহেশ পূরণ হয়েছে। নির্বাচনে জয়ের পর তাদের প্রত্যাশিত প্রক্রিয়াও ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পরপরই একজন মুসলমানকে গাছের সাথে বেঁধে মারধোর করা হয় বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে সংবাদ-মাধ্যমে। শুধু তাই নয়। মুসলিম-অধ্যুষিত কাশ্মীরে জবরদস্তির শাসন আরও জোরদার করা হয়েছে। কাশ্মীরের জনগণের উপর নতুন করে চালানো অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছেন অমর্ত্য সেনের মতো নোবেল-বিজয়ী বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ। অমর্ত্য সেন বলেছেন, কাশ্মীরে চালানো বর্বরতা ভারতের সব চাইতে বড় কলংক। শুধু তাই নয়, উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বাংলাদেশকেও ভারত স্বাধীন করে দিয়েছে এই কুযুক্তিতে বাংলাদেশেও ভারতের সেনাবাহিনী পাঠাতেও আগ্রহী তিনি।
এসবের অর্থ হলো, এককালে যে ভারতকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে মনে করা হতো সে ভারত এখন দ্রুত সাম্প্রদায়িক ও বর্বর ভারতে পরিণত হতে চলেছে। এ কথা হঠাৎ করে এবং অকারণে মনে করা হচ্ছে না। বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন ভারতীয় পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। এ জন্য মমতাকে হত্যা করার পরিকল্পনা নিয়েছে কেন্দ্রীয় শাসকদল বিজেপি। তারা ঘোষণা দিয়েছে মমতাকে কেউ খুন করতে পারলে তাকে ১ কোটি রুপি পুরস্কার দেয়া হবে। গত রবিবার এমনি একটি চিঠি হাতে পান আরামবাগের তৃণমূল সাংসদ অপরূপা পোদ্দার। পরে তিনি ঐ চিঠিটি জমা দেন শ্রীরামপুর পুলিশ স্টেশনে। অপরূপা পোদ্দারের পাওয়া চিঠিতে রাজধার কিল্লা নামের কারোর সই করা ছিল। সেই চিঠিতে মমতা বন্দোপাধ্যায়কে খুন করতে পারলে এক কোটি টাকা পুরস্কার দেয়ার প্রস্তাব রয়েছে। চিঠিতে তাকে (মমতাকে) ডাইনী বলা হয়েছে। এদিকে রাজধার কিল্লা নামে এক ব্যক্তি তাকে ফাঁসানোর জন্য এই চিঠিতে তার নাম মিথ্যা করে দেয়া হয়েছে বলে বিধাননগর থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন।
এসব ঘটনা প্রমাণ করে এককালের বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারত এখন আর গণতান্ত্রিক দেশ নেই। সেখানে এখন চলছে একদিকে চরম হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতা, অন্যদিকে চরম বর্বর পরিস্থিতি। যার সাথে এককালের সেকুলার দাবিদার ভারতের গণতন্ত্রের ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। এসবই শুরু হয়েছে চরম সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী নেতা নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর। এখানে উল্লেখযোগ্য, নরেন্দ্র মোদির ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার মতো বড় ঘটনাও হঠাৎ করে ঘটেনি। নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপির ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দল ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। এই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস মুখে অসাম্প্রদায়িক দল বলে দাবি করলেও এটা ছিল মূলত: হিন্দুদের একটি রাজনৈতিক দল।
এ সম্পর্কে পাঠকদের ধারণা পরিষ্কার করার জন্য একটু অতীতে যেতে হচ্ছে। ১৯০৬ সালে যখন নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে ঢাকায় যে সম্মেলনে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ গঠিত হয় সে সম্মেলনে তদানীন্তন উদীয়মান রাজনৈতিক নেতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু মুহম্মদ আলী জিন্নাহ এই আমন্ত্রণে সাড়া দেননি। তিনি সে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন এই যুক্তিতে যে, মুসলমানদের জন্য আলাদা রাজনৈতিক দল গঠন করলে তাতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কর্তৃক পরিচালিত বৃটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন বিভক্ত ও দুর্বল হয়ে পড়বে।
এই মুহম্মদ আলী জিন্নাহই পরবর্তীকালে চরম বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে বুঝতে পারেন যে, কংগ্রেস মুখে হিন্দু মুসলমান উভয় জাতির দল বলে দাবি করলেও মূলত এটা হিন্দুদের একটি সাম্প্রদায়িক দল। এই বাস্তব উপলব্ধির পরে জিন্নাহ সাহেব নিখিল ভারত মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে হিন্দু-মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ভারত বিভাগ ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবি এগিয়ে নিয়ে মুসলমানদের প্রিয় নেতা কায়েদে আজম হয়ে-ওঠেন এবং উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকাসমূহকে নিয়ে আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলনকে এমন শক্তিশালী করতে সক্ষম হন যে, সে দাবির কাছে উপমহাদেশের প্রাচীনতম দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসও নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
বর্তমানে আমরা বাংলাদেশ নামের যে স্বাধীন রাষ্ট্রের গর্বিত নাগরিক, সেটাই ছিল ১৯৪৭ সালে কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ পূর্ববঙ্গ। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর প্রথমে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, পরে স্বায়ত্বশাসন আন্দোলন প্রভৃতির মাধ্যমে যে স্বাধিকার চেতনা সৃষ্টি হয় তাকে পশুবলে ধ্বংস করে দেয়ার যে অপচেষ্টা চালায় পাকিস্তান সেনা বাহিনী। তার বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের জনগণ জীবন-মরণ সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে ১৯৭১ সালে মাত্র নয় মাসের সংগ্রামের মধ্যদিয়ে পূর্ববঙ্গকে স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত করেন এদেশের সংগ্রামী জনগণ। ইতিহাসে এই সংগ্রাম একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নামে আখ্যায়িত হয়ে আছে।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ১৯০৬ সালে ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহ মুসলমানদের জন্য যে পৃথক রাজনৈতিক দল নিখিল ভারত মুসলিম লীগ গঠন করেন, তার ধারাবাহিকতায় ১৯৪৬ সালে বৃটিশ শাসন আমলের শেষ নির্বাচনে প্রধানত বাংলাদেশেই মুসলিম লীগ বিজয়ী হয়ে পাকিস্তান দাবির সমর্থক সরকার গঠন করে কায়েদে আজমের হাত শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়।
সে নিরিখে দেখা যায়, ১৯০৬ সালে অবিভক্ত ভারতকে প্রথম দীর্ঘস্থায়ী মুসলিম রাজনৈতিক দল গঠনে যেমন ঢাকার কৃতিত্ব ছিল প্রধান, তেমনি বৃটিশ শাসিত ভারতবর্ষে ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থক সরকার গঠনের কৃতিত্বও ছিল বাংলাদেশের। অথচ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কেন্দ্রীয় সরকারের রাজধানীসহ সেনা বাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীসহ সমগ্র প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদর দপ্তর পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত হওয়ায় পাকিস্তান আমলের শুরুই হয় পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ববঙ্গের বিরুদ্ধে অবিচারের মধ্যদিয়ে। এইসব অবিচারের বিরুদ্ধে জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশই ঘটে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে। যার প্রতি জনগণের ছিল অকুণ্ঠ ও ব্যাপক সক্রিয় সমর্থন।
সেদিক দিয়ে বিচার করলে প্রমাণিত হয়, ১৯০৬ সালের ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ নামের প্রথম দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক দল গঠিত হয় মুসলমানদের, যার ধারাবাহিকতায় ১৯৪৬ সালে বৃটিশ শাসন আমলে সর্বশেষ নির্বাচনেও একমাত্র তৎকালীন বাংলাদেশেই মুসলিমলীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয় জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে। সেই ধারাবাহিকতায়ই ১৯৭১ সালে এতদাঞ্চলের জনগণের সমর্থিত সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত হয় আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ।
সুতরাং আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ কোনক্রমেই ভারতের দান নয়, যেমনটা দাবি করতে চান ভারতের বর্তমান শাসকদল কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল বিজেপি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।