পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
নিয়ত করেছিলাম, ভারতের নির্বাচন এবং গৈরিক নিশান উড্ডীন সম্পর্কে কিছু লিখবো। লিখতে বসেই হাতের কাছে আজকের দৈনিকগুলো পেলাম। একাধিক দৈনিকে একটি নিউজ ছাপা হয়েছে। খবরটির শিরোনাম, ‘গাছে বেঁধে পেটানো হলো তিন মুসলিমকে/ ভারতে গো রক্ষকদের তান্ডব’। খবরে প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ দিয়ে বলা হয়েছে , একটি গরু নিয়ে অটোরিক্সায় চেপে সিওনি দিয়ে যাচ্ছিলেন এক নারীসহ তিন মুসলিম। বিষয়টি গোরক্ষকদের কানে গেলে তারা তাদের ওপর চড়াও হয়। লাঠি, বাঁশ নিয়ে তাড়া করে অটোরিকশাকে। এক পর্যায়ে ধরে ফেলে তাদেরকে। তারপর তাদের গাড়ি থেকে নামিয়ে একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে বেধড়ক পেটানো হয়। পরে তাদের মাটিতে ফেলেও প্রচন্ড মারধর করা হয়। রাস্তায় ভিড় করা উৎসুক জনতা বিষয়টি প্রত্যক্ষ করলেও কেউ তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। গোটা ঘটনাটির ভিডিও পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। ঘটনাটি গত ২২ মে’র হলেও কয়েকদিন পর ভারতীয় মিডিয়ায় বিষয়টি ব্যাপক প্রচার পায়। এ ঘটনায় মধ্যপ্রদেশের এআইএমআইএম (অল ইন্ডিয়া মজলিশ ই ইতিহাদুল মুসলিমিনি) দলের প্রধন আসাদুদ্দিন ওয়াইসি তীব্র নিন্দা জানিয়ে তার এক টুইটে বলেছেন, মোদির ভোটররা এভাবে মুসলিমদের ওপর অত্যাচার আবার শুরু করে দিল। এটাই নতুন ভারতের ছবি।
এটি তো সবে শুরু। মোদির বিশাল বিজয় ভারতের ১৪ শতাংশ মুসলমান অর্থাৎ ১৮ কোটি মুসলমানের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয়ের সৃষ্টি করতে পারে। মোদির এই বিশাল বিজয় সম্পর্কে বাংলাদেশের ভারতপ্রেমীরা নানান রকম ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। এসব ব্যাখ্যা বহু বছর আগে থেকেই শুনে আসছি। সেক্যুলাররা সব সময় বলে আসছে যে ধর্ম একটি জাতির ঐক্যের বন্ধন কোনো সময় হতে পারে না। এই কথাটি বলা হতো পাকিস্তানকে লক্ষ্য করে। তাই বলা হতো যে ধর্ম পাকিস্তানের সংহতি ও অখন্ডতা রক্ষা করতে পারবে না। আসলে পাকিস্তানের ভৌগলিক অখন্ডতা বিনষ্ট হয়েছে ধর্মের অকার্যকারিতার কারণে নয়। প্রথম কারণ হলো, পাকিস্তানের দুইটি অঞ্চলের একটি থেকে আরেকটি দেড় হাজার মাইল দূরে অবস্থিত। মাঝ খানে বৈরি ভারত। দ্বিতীয় কারণ ছিল পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী অর্থাৎ পাঞ্জাবীদের বৈষম্য ও অবিচার। এই বৈষম্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক প্রভৃতি সর্বক্ষেত্রেই বিরাজমান ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সারা পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জনের পরেও শেখ মুজিবের হাতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসন ভার অর্পণ না করা। উপরন্তু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাত্রিতে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীদের ওপর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর গণহত্যা। সেদিন যদি শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের মন্ত্রী সভা গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হতো এবং পূর্ব পাকিস্তানকে আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন দেওয়া হতো তাহলে ইতিহাস হয়তো অন্যরকম ভাবে লেখা যেতো। তখন ধর্ম পাকিস্তানের ঐক্যের বন্ধন নয়, সেই কথাটি হয়তো উঠতো না।
এই কথাটি আজ বলতে পারছি, ভারতের গত নির্বাচনে গেরুয়া বসনের বিশাল বিজয় এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রবল উত্থান দেখে। বিজেপির জন্ম কথা, বিকাশ ও বর্তমান প্রবল উত্থান দেখলে সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হবে যে, বিজেপির ভিত্তিই হলো উগ্র হিন্দুত্ববাদ এবং হিন্দুত্বের ভিত্তিতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ। বিজেপির আদি পিতা হলেন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। এই শ্যামাপ্রসাদের সাথে মিলে বাংলাদেশের নেতা এ.কে ফজলুল হক অবিভক্ত বাংলায় শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৯৫১ সালে ভারতীয় জনসংঘ দল প্রতিষ্ঠা করেন। সেই ভারতীয় জনসংঘ দলটি পরবর্তী কালে সময়ের আবর্তনে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস), জনতা পার্টি প্রভৃতি নাম ধারণ করে অবশেষে ১৯৮০ সালে বর্তমান ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি নামে আত্ম প্রকাশ করে। ১৯৮৪ সালে অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে এই দলটি মাত্র ২টি আসন পায়। পরবর্তী ৩০ বছরের মধ্যে ২০১৪ সালে বিজেপি লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসকে বিপুল ভোটে হারিয়ে ২৮২টি আসন নিয়ে একক সংখ্যা গরিষ্ঠ দল হিসাবে আত্ম প্রকাশ করে। আর এবার ৩০২টি আসন নিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে।
বিজেপির এই প্রবল উত্থানের পেছন প্রধান ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা এবং সেই জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণের দাবি। সেই সময় সারা ভারতে ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি অর্থাৎ হিন্দু ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি ছড়িয়ে দেন লাল কৃষ্ণ আদভানি। সারা ভারত চষে বেড়ান আদভানি। প্রতিটি জনসভায় বিশাল আকারে হিন্দুদের ভগবান রামের ছবি টাঙানো হয়। সেই ছবির নীচে আদভানি, বিজেপি নেতা মুরলী মনোহর যোশী প্রমুখ বক্তৃতা করেন।
১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতের প্রধান মন্ত্রী ছিলেন কংগ্রেসের নর সীমা রাও। তার প্রধান মন্ত্রিত্বের আমলে সরকারের প্রশ্রয় পেয়ে বর্তমান বিজেপির মূল সংগঠন আর এস এসের উপশাখা কর সেবকরা বাবরি মসজিদে হামলা চালায় এবং মসজিদটি গুঁড়িয়ে দেয়। তাদের দাবি ছিল ঐ মসজিদের স্থলে হিন্দুদের ভগবান রামের নামে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা করা। বাবরি মসজিদ ভাঙার এই পৈশাচিক ও বর্বর ঘটনার প্রতিবাদে মুসলমানরা বিক্ষোভ করলে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়। এই দাঙ্গার নায়ক ছিলেন গুজরাটের তৎকালীন মূখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যিনি আজ ভারতের প্রধান মন্ত্রী। এই দাঙ্গায় ২ হাজার মানুষ নিহত হয়, যাদের প্রায় সকলেই ছিলেন মুসলমান। যে জনসংঘ বা আজকের বিজেপি ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে মাত্র ২টি আসন পায় সেই জনসংঘ বাবরি মসজিদ হামলার পর সারা ভারতে সুতীব্র মুসলিম বিদ্বেষ এবং উগ্র হিন্দুত্ববাদ ছড়িয়ে দেয়। এর পরিণতিতে ক্ষয়িষ্ণু শ্যামাপ্রসাদের হিন্দু জাতীয়তাবাদ আবার নবজীবন লাভ করে।
দুই
প্রথম জীবনে মাত্র ৮ বছর বয়সে নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি বর্তমান বিজেপির মূল শক্তি রাষ্ট্রীয় স্বয়ক সেবক সংঘের (আর এস এস) সদস্য হন। ১৯৭০ সালে আর এস এসেরএকজন সার্বক্ষণিক প্রচারক হিসাব তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন। এখনো তার ধমনীতে বইছে আর এস এসের আদর্শ। এই আর এস এসই তাকে প্রথমে জনতা দল এবং পরে বিজেপির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়। সেই মোতাবেক ধীরে ধীরে সুপরিকল্পিত ভাবে তিনি বিজেপির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। এই নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে যেয়ে তিনি ধীরে ধীরে লালকৃষ্ণ আদভানি, মুরলী মনোহর যোশী প্রমুখ সিনিয়র নেতাদেরকে কোণঠাসা করেন।
কেন বিজেপির এই বিশাল বিজয়? রাজনৈতিক পন্ডিতরা ধারণা করেছিলেন যে, বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ এবারও নির্বাচনে সংখ্যা গরিষ্ঠতা পাবে। কিন্তু তাদের গতবারের তুলনায় সংখ্যা গরিষ্ঠতা কমে যাবে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি এবার খেলেছেন ২টি তাস। একটি হলো হিন্দুত্ব। আর একটি হলো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হামলা তথা কাশ্মীর তাস।
নির্বাচনী প্রচারণার পূর্বাহ্নে বেকারত্ব, রুপি ডিমানিটাইজেশন প্রভৃতি কারণে বিজেপির জনপ্রিয়তা কমে যায়। এছাড়া হিন্দুপ্রধান ৫টি রাজ্য, যেগুলোকে ভারতের হার্টল্যান্ড স্টেট বলা হয়, সেগুলোর বিধান সভা নির্বাচনে বিজেপি হেরে যায়। ঐ দিকে উত্তর প্রদেশে বহুজন সমাজবাদী পার্টির মায়াবতী এবং সমাজবাদী পার্টি অখিলেশ যাদব ঐক্যজোট গঠন করেন। এর ফলে ধারণা করা হয় যে উত্তর প্রদেশ এবং হার্টল্যান্ড স্টেট সমূহে বিজেপির আসন অনেক কমবে। কিন্তু কাশ্মীরের ঘটনা সমস্ত রাজনৈতিক হিসাব নিকাশকে লন্ডভন্ড করে দেয়।
নির্বাচনের আগে কাশ্মীরের স্বাধীনাত সংগ্রামীরা গেরিলা আক্রমণ করে ভারতের ৪২ জন আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যকে হত্যা করে। মোদি দেখেন যে নির্বাচনের আগে এটিই তার জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ। তিনি পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিমান হামলা করেন এবং সারা দেশ ব্যাপী তীব্র পাকিস্তান বিরোধী জিগির তোলেন। ভারতীয়রা ১৯৪৭ সালের পর থেকেই প্রবল ভাবে পাকিস্তান বিরোধী। সুতরাং তারা মনে করেন যে, মোদির মতো শক্ত মানবের হাতেই ভারতের নিরাপত্তা সুরক্ষিত। আর সেই কারণে জনগণ সাময়িক ভাবে বেকারত্ব এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক সমস্যা ভুলে গিয়ে স্ট্রং ম্যান মোদির পেছনে জমায়েত হন।
তিন
নরেন্দ্র মোদির বিশাল বিজয় বাংলাদেশের ওপর কি প্রভাব বিস্তার করতে পারে? আওয়ামী লীগাররা মনে করেন যে এর ফলে তিস্তার পানি সমস্যার একটি সন্তোষজনক সমাধান হবে। কিন্তু রাজনৈতিক পন্ডিতরা বলেন, ব্যাপারটি হবে সম্পূর্ণ বিপরীত। যেভাবে পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূলের আসন ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে তার ফলে মোদি এবং মমতার বিরাজমান তিক্ততা আরও বৃদ্ধি পাবে। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মমতা অবশ্যই চাইবেন তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় ফিরতে। কিন্তু বিজেপি চাইবে এই ক্ষমতা থেকে মমতা ব্যানার্জিকে হটিয়ে দিতে। সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচন এ ব্যাপারে বিজেপিকে চাঙ্গা করেছে। কারণ তাদের আসন সংখ্যা ২ থেকে ১৮ তে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং পশ্চিমঙ্গ রাজ্য বিধান সভার আগামী নির্বাচনে বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস উভয়েই পূর্ণ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। মমতা তার দূর্গকে সুসংহত রাখতে তার বাংলা অর্থাৎ পশ্চিম বাংলার স্বার্থকে বিন্দুমাত্র বিসর্জন দিতে দিবেননা। কারণ সেটি হলে তার আসন নড়বড়ে হয়ে যাবে।
এই পটভূমিতে ২০২১ সালের আগে তিস্তার পানি বন্টন সমস্যার কোনো সমাধান হবে বলে মনে হয় না। এছাড়া নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহর ভাষায় আসামে যে জন নিবন্ধন হয়েছে পশ্চিম বঙ্গেও সেটি করা হবে বলে তার দুজনেই বলেছেন। মমতা বলেছেন যে, তিনি এই জন নিবন্ধন হতে দেবেন না। যে কোনো মূল্যে তিনি সেটি প্রতিরোধ করবেন। বলা বাহুল্য এর প্রভাব বাংলাদেশেও এসে পড়বে। সুতরাং নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয় মেয়াদে আসার ফলে ভারত বাংলাদেশ সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে আওয়ামী লীগাররা যে আশা করছেন সেটি যদি অতি আশাবাদে পরিণত হয় তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।