পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আমাদের দেশের রাজনীতিক, মিডিয়া এবং এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী রাজনীতি নিয়ে এতই ব্যতিব্যস্ত যে দেশের সমাজ এবং পরিবার যে রসাতলে যাচ্ছে তা তাদের নজর এড়িয়ে যাচ্ছে। সামনে দিয়ে মশা গেলে তাকে মারতে চেষ্টা করে, কিন্তু পেছন দিয়ে হাতি গেলেও খেয়াল করে না। ধর্ষণ এবং নরহত্যা এখন যেন একে অপরের সহচর হয়ে গেছে। ধর্ষণ এবং নারী হত্যা যেন পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার সাথে সবচেয়ে ভয়াবহ এবং উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো এই যে, এখন সমাজ বিরোধীরা চার পাঁচ বছরের শিশুকেও ধর্ষণ করছে। যতই দিন যাচ্ছে ততই মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান এবং ইবনে সিনার নার্স শাহিনুর আক্তার তানিয়ার হত্যাকান্ড সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। এসব খবর পড়ার পর আমরা ভাবছি, দেশটি কোথায় যাচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বিশেষ করে বিএনপি জামায়াতকে দমন করার জন্য সরকার যে এনার্জি খরচ করছে তার এক ভগ্নাংশও যদি দেশের ক্রাইম অর্থাৎ ধর্ষণ ও হত্যাকান্ড প্রতিরোধে ব্যয় করা হতো তাহলে এই ধরনের ভয়াবহ অপরাধ সম্পূর্ণ দুরীভূত না হলেও অনেকটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসতো।
ইবনে সিনার নার্স শাহিনুর আক্তার তানিয়ার ধর্ষণ এবং হত্যাকান্ড সম্পর্কে শুধুমাত্র চাঞ্চল্যকর নয়, ভয়াবহ খবর পাওয়া যাচ্ছে। গত রবিবার এক দৈনিকের খবরে প্রকাশ, চলন্ত বাসের দরজা জানালা লাগিয়ে শাহিনুরকে ধর্ষণ করে ড্রাইভার, হেলপার এবং আরও একজন। এই তৃতীয় ব্যক্তির পরিচয় তদন্তের স্বার্থে পুলিশ এখনো প্রকাশ করেনি। শাহিনুর নিজেকে বাঁচানোর জন্য তাদেরকে কিল ঘুষিও মারে। ধর্ষণের পর তাকে সম্ভবত গলা টিপে হত্যা করা হয়েছিল। তারপর মাথার খুলি ফাঁটিয়ে চলন্ত বাস থেকে ফেলে দেওয়া হয়। এই দুর্বৃত্তরা তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রথমে গাজীপুরের অন্য একটি বাসের নাম করে। সেই বাসটি আটক করে পুলিশ ধর্ষণের কোনো আলামত পায়নি। তখন পুলিশ ড্রাইভার নুরুজ্জামান ও হেলপার লালনের ওপর প্রচন্ড চাপ প্রয়োগ করে। সেই চাপে পড়ে তারা তাদের অপরাধ স্বীকার করে।
অপরাধীরা প্রথমে এই হত্যাকান্ডকে সড়ক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। শাহিনুরকে বাস থেকে ফেলে দিয়ে অপরাধীরা বাসটি নিয়ে কিছু দূর যায়। তারপর আবার ফিরে আসে। এসে দেখে, তখনও লাশটি সেখানে পড়ে আছে। ইতোমধ্যে সেখানে কিছু লোক জড়ো হয়। মৃত শাহিনুরকে অচেতন বলে ঘোষণা করে ওরা পিরিজপুর বাজারের ‘সততা ফার্মেসীতে’ নিয়ে যায়। সেখান থেকে তারা তাকে কটিয়াদি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। তবে বাস চালক নুরুজ্জামান নুরু ও হেলপার লালন মিয়াসহ মোট পাঁচ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। ড্রাইভার নুরু এবং হেলপার লালন মিয়া পুলিশকে প্রথমে বলেছিল যে নার্স শাহিনুর চলন্ত বাস থেকে জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে রাস্তায় নামে এবং দুর্ঘটনায় পতিত হয়। কিন্তু পুলিশ পাল্টা প্রশ্ন করে যে এমন কী ঘটেছিল যার ফলে শাহিনুরকে চলন্ত বাসের জানালা থেকে ঝাঁপ দিতে হয়েছিল? এই প্রশ্নে ঐ দুই দুর্বৃত্ত থতমত খায়। তখন বাসটি আটক করে পুলিশ বাসের ভেতরে ছোপ ছোপ রক্ত দেখতে পায়।
ঘটনার বিস্তারিত বিবরণে প্রকাশ শাহিনুর আক্তার তানিয়া দুপুর ৩টায় ঢাকা মহাখালী থেকে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি যাত্রার উদ্যেশ্যে ‘স্বর্ণলতা পরিবহন’ নামক একটি বাসে ওঠে। রাত ৮টায় কটিয়াদিতে থামলে বাসের ১৯ জন যাত্রীর মধ্যে ১৬ জনই নেমে যায়। রয়ে যায় শুধুমাত্র ৩ জন। এরা হলো বাসের ড্রাইভার, হেলপার এবং একজন তৃতীয় ব্যক্তি। এই স্থান থেকে তানিয়া একাই বাসে ছিল। এই সুযোগে ড্রাইভারসহ ঐ ৩ ব্যক্তি তানিয়াকে ধর্ষণ করে এবং হত্যা করে বাস থেকে ফেলে দেয়।
দুই
দেশে সামাজিক ক্ষেত্রে যে ভয়াবহ নৈতিক অবক্ষয় চলছে সেই নৈতিক অবক্ষয়ের সাথে তুলনা চলে শুধুমাত্র ৭১ এর সেই ভয়াবহ দিনগুলির। একথা বলেছেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের এমিরেটাস প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রমিক সংহতি আলোচনা সভায় ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, দেশের দ্রুত উন্নতি হচ্ছে বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু এই উন্নতির অন্তরালে মানুষ আর্তনাদ করছে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের কোনো মানুষ নিরাপদে নেই। এমন অনিরাপদ অবস্থা আমরা ৭১ সালেই দেখেছিলাম। এর বড় উদাহরণ হচ্ছে ধর্ষণ। এসব অন্যায় রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
দেশে নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে দাবি করে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আজকে দেশে যে রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছে, তার চেয়ে খারাপ অবস্থা অতীত ইতিহাসে ছিল কি না আমার জানা নেই। আমরা দুর্ভিক্ষ দেখেছি যে দুর্ভিক্ষে অনেক মানুষ মারা গেছে। কিন্তু আজকে বাংলাদেশে দৃশ্যমান কোনো দুর্ভিক্ষ না থাকলেও নীরব দুর্ভিক্ষ আছে।’
প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, ‘আমরা দেখেছি, নুসরাত জাহানের ঘটনার সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতা জড়িত ছিল এবং সবাই মিলে প্রমাণ করতে চাইল যে নুসরাত আত্মহত্যা করতে চেয়েছে। ইতোমধ্যে একজন নার্সকে বাসের মধ্যে ধর্ষণ করে হত্যা করা হলো।’
তিনি দেশের আাইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্নীতি নিয়েও কথা বলেন। বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন মুক্তিযুদ্ধের ভুয়া সনদে পদোন্নতি নিতে গিয়ে ধরা খেয়েছেন। অথচ যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবে তারাই যদি দুর্নীতি করে তাহলে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলার অবস্থা কী তা সহজেই অনুমেয়।
দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা উন্নয়নের তুবড়ি ছোটাচ্ছে। তাদের কথা বার্তায় দেখা যাচ্ছে যে দেশে উন্নয়নের বান ডেকেছে। আর সেই বানের জোয়ারে সারা বাংলাদেশ সয়লাব হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এই ধরনের কথা বলতে বলতে এতটাই লাগাম ছাড়া হয়েছে যে তারা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কানাডার অর্থনীতির সাথে তুলনা করছে। আমাদের অর্থনীতি নাকি কানাডার অর্থনীতির সমান হয়েছে।
এদের কথা আর কি বলবো। এই ধরনের অর্বাচীনদের বালখিল্যতায় নিজেরাই বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। আজ যারা বাংলাদেশকে কানাডার সাথে তুলনা করেন তাদেরকে পুলিশ কমিশনার জাহিদের একটি কাহিনী শোনাই। গত শনিবার পুলিশ কমিশনার জাহিদ তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে একটি চুরির কাহিনী বর্ণনা করেছেন।
পুলিশ কমিশনার জাহিদ লিখেছেন, গতকাল রাত আনুমানিক ৮.৪৫ মিনিট, বাকি সড়কে চেকপোস্ট ডিউটি তদারকি করছিলাম। হঠাৎ এক জায়গায় মানুষের হট্টগোল দেখতে পেলাম। ঘটনা কি তা দেখার জন্য আমার এক সাব-ইন্সপেক্টরকে পাঠালাম। কিছুক্ষণ পর বেশ কিছু লোক ২৫-৩০ বছর বয়সী একজন লোককে টেনে-হিচড়ে আমার সামনে নিয়ে আসলো। ঘটনা জানতে চাইলাম। একজন বললো, স্যার, লোকটা চোর, চুরি করে পালাচ্ছিল। পাশে লোকটাকে শক্ত করে ধরে রাখা এক সিকিউরিটি গার্ড আমাকে বললো, স্যার, লোকটা ‘স্বপ্ন সুপার শপ’ থেকে চুরি করে পালাচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী চুরি করেছে? সিকিউরিটি গার্ড বললো, ‘স্যার, সে এক প্যাকেট দুধ চুরি করে পালাচ্ছিল। আমার খটকা লাগলো, আমি জিজ্ঞেস করলাম দুধ?’ তখন সিকিউরিটি গার্ড অতি উৎসাহ নিয়ে বলল, স্যার বাচ্চাদের ন্যান দুধের প্যাকেট। আমি লোকটার দিকে তাকালাম। আমার বয়সেরই হবে। দেখতে ভদ্রলোকই মনে হলো। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, চুরি করলেন কেন? সে কেঁদে ফেলল। তারপর বললো, স্যার, তিনমাস হলো চাকরি নাই, বেতন নাই। ঘরে ছোট বাচ্চা, দুধ কেনার টাকা নাই। সাথে সাথে আমার ছেলের চেহারা মনে পড়ল! মনে হলো কতটা নিরুপায় হলে একজন বাবা এই কাজ করতে পারে! ওর জায়গায় আমি থাকলেও হয়ত একই কাজ করতাম। সিকিউরিটি গার্ডকে জিজ্ঞেস করলাম, দুধের প্যাকেটের দাম কত? সে বললো, ৩৯০ টাকা স্যার। আমি তাকে ৫০০ টাকা দিয়ে বিল রাখতে বললাম এবং লোকটিকে ছেড়ে দিতে বললাম।
তিন
পুলিশ কমিশনার অতঃপর তার মন্তব্যে লিখেছেন, আজ আমাদের দেশের এক অসহায় বাবা তার বাচ্চার জন্য দুধ চুরি করে। কত মানুষ বেকারত্বের অভিশাপ ঘোচাতে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। হয়ত আমি ভালো চাকরি করে আজ ভালো আছি, কিন্তু সমাজের কত মানুষ আজ এই বাবার মতো নিরূপায়! এর দায়ভার কার?
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তর এখন পচে গেছে। ধর্ষণ, হত্যা অহরহ ঘটছে। এ ধরনের প্রত্যেকটি ঘটনার বিচার করতে হবে। তিনি আরও বলেন, দেশে এক ধরনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ধর্ষণ, হত্যা এখন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এটা কোনোভাবেই সভ্য সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নুসরাত হত্যার ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না।
ধর্ষণ বা গণধর্ষণ সম্পর্কে গত মাস খানেক ধরে অনেক পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে। আমি সাধারণত আমার লেখায় পরিসংখ্যান দিয়ে পাঠক ভাইদের ভারাক্রান্ত করি না। তবে আজ এখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কাজি মোহিনী ইসলামের একটি পরিসংখ্যান না দিয়ে পারছি না। তাঁর পরিবেশিত তথ্য মোতাবেক গত ৮ দিনে ৪১ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এসব শিশুর মধ্যে তিনটি হলো ছেলে শিশু আর ৩৮টি হলো কন্যা শিশু। পাঠক ভাই এবং সেই সাথে দেশবাসী ভেবে দেখুন, একটি জাতি কতখানি অধপতিত এবং পাশবিক হলে এমন ভয়ংকর কাজ ঘটতে পারে। এই সব ধর্ষক আর মানুষের পর্যায়ে নেই। তারা পশুর পর্যায়ে নেমে গেছে। তাই তাদের সাথে পশুর মতোই আচরণ করতে হবে। কিন্তু এব্যাপারে সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমন কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে? সেজন্যই বলছি, সরকার এসব পাশবিক বলাৎকারের পেট্রোনেজ করছে, এমন কথা বলবো না। কিন্তু এসব দানবের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় সেই বলাৎকারকে লাই দেওয়া বা প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে।
এসব কারণেই আমরা বারবার বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, সরকার রাজনৈতিক প্রতিদ্ব›িদ্বদের শায়েস্তা করার ব্যাপারে যতখানি সিরিয়াস সামাজিক অপরাধে যারা দাগী ও প্রমাণিত অপরাধী তাদেরকে শায়েস্তা করার ব্যাপারে ততখানিই উদাসীন। তাহলে তো বলতেই হয়, Something is grossly wrong somewhere.. ডাল মে জরুর কুছ কালা হ্যায়। সরিষায় ভূত থাকলে সেই ভূত তাড়াবে কে?
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।