Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভারত থেকে নিম্নমানের পাটবীজ আমদানি বন্ধ করতে হবে, গড়ে তুলতে হবে বীজ ভান্ডার

| প্রকাশের সময় : ২৭ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৬ এএম | আপডেট : ১২:১১ এএম, ২৭ এপ্রিল, ২০১৯

এক সময় দেশের প্রধান অর্থনৈতিক ফসল পাট এখন আর প্রধান ফসল নেই। যে পাট রফতানি করে দেশের সিংহভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হতো এবং ‘সোনালী আশ’ হিসেবে বিখ্যাত ছিল, তা এখন অবহেলিত। পাট সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর অবহেলা আর যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে এ ফসল তার ইতিহাস এবং ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। বাংলাদেশের পাট বিশ্বে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট। এক সময় সারাদেশে বিভিন্ন জাতের পাট চাষ হলেও ‘তোষা পাট’ ছিল খুবই উন্নত। বিশেষ করে ময়মনসিংহে উৎপাদিত পাট ছিল সর্বোন্নত। কালের পরিক্রমায় এখন দেশে পাটের উৎপাদন যেমন হ্রাস পেয়েছে, তেমনি উৎকৃষ্ট পাটও চাষ হচ্ছে না। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, সময় বেশি লাগে বলে কৃষকরাও এখন পাট চাষে খুব একটা আগ্রহবোধ করছে না। তারা স্বল্প সময়ে উৎপাদন করার মতো সবজি ও রবি শস্যর দিকে আগ্রহী বেশি বলে মন্ত্রণালয়ের সচিব জানিয়েছেন। সুদীর্ঘকাল ধরে চলে আসা পাটের এই দুর্দিনেও অনেক কৃষক প্রতি বছরই পাট চাষ করে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, যে পাটে দেশ বিশ্বখ্যাত ছিল, সেই পাটের বীজের এখন প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হচ্ছে ভারত থেকে। তাও অত্যন্ত নিম্নমানের। গতকাল একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পাটের বীজের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পুরোপুরি ভারতনির্ভর হয়ে গেছে। ভারত থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার টন নিম্নমানের বীজ আমদানি করে পাট চাষ করা হচ্ছে।
বিশ্বে পাটের সুখ্যাতির জন্য নারায়ণগঞ্জকে এক সময় বলা হতো ‘প্রাচ্যের ডান্ডি’। বন্দর নগরী নারায়ণগঞ্জে গড়ে উঠেছিল বিশ্বখ্যাত পাটের কারখানা। আদমজী জুট মিল ছিল বিশ্বের অন্যতম প্রধান পাটের কারখানা। সোনালী আঁশের এই সোনালী দিন এখন প্রায় বিলুপ্ত। একটি দেশের প্রধানতম অর্থনৈতিক ফসল কীভাবে নিঃশেষ হয়ে যায়, তা বাংলাদেশের পাটের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। পাটকে কেন্দ্র করে যে মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, গবেষণা কেন্দ্রসহ অন্যান্য সংস্থা গড়ে উঠেছে, এদের উদাসীনতা এবং অবহেলার কারণেই পাটের এই দুর্দশার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের পাট নিয়ে ভারতের ষড়যন্ত্রের কথা অনেক আগে থেকেই শোনা যায়। ১৯৩৬ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় পাট কমিটির সদর দপ্তর এই ঢাকাতেই গড়ে তোলা হয়। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তা বলবৎ থাকে। ১৯৭২ সালে এই কমিটির সর্বশেষ পরিচালক বি সি কুন্ডু বলেছিলেন, ভারত সবসময়ই বাংলাদেশ থেকে পাটের বীজ নিয়ে যায়। এই তথ্য থেকেই বোঝা যায়, বাংলাদেশের পাট নিয়ে ভারতের ষড়যন্ত্র অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল এবং তা সফল হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের পাট শাখার হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর পাটের বীজের চাহিদা ৬০৬৬ টন। এর মধ্যে সরকার আমদানি করে ৫ হাজার টন এবং বাকি এক হাজার টন স্মাগলিয়ের মাধ্যমে ভারত থেকে আসে। অর্থাৎ পাটের বীজের জন্য বাংলাদেশ এখন পুরোপুরি ভারতের উপর নির্ভরশীল। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, পাট নিয়ে ভারতের সুদীর্ঘ এই ষড়যন্ত্র জানা সত্তে¡ও দেশের পাট সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তা রক্ষায় কোনো উদ্যোগই নেয়নি। আমাদের গর্ব করার মতো হাতে গোনা যে কয়টি খাত রয়েছে, তার মধ্যে পাট খাত দীনহীন হয়ে পড়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ই দায়ী। এই কয়েক বছর আগে গবেষকরা পাটের ‘জীবন রহস্য’ উন্মোচন করে আমাদের ধন্য করেছিলেন। এর মাধ্যমে দেশে ব্যাপক হারে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত জাতের পাট উৎপাদন করা যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশে পাটের বীজ ভান্ডার বলে কিছু নেই। যেখানে ভারত থেকে হাজার হাজার টন নিম্নমানের পাট বীজ আমদানি করতে হচ্ছে, সেখানে ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন সরবরাহ করেছে ২৩৬ টন এবং কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের বীজ শাখা সরবরাহ করেছে মাত্র ২৬ টন। এ পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, দেশে হাজার হাজার টন পাট বীজের চাহিদার তুলনায় পাট সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর পাটের বীজ ভান্ডার গড়ে তুলতে পারেনি। প্রধানতম অর্থকরী ফসল নিয়ে এমন অবহেলা ও উদাসীনতা অমার্জনীয়। যে কোনো দেশ তার প্রধানতম অর্থকরী ফসল ও অন্যান্য ফসলের আলাদাভাবে বীজ ভান্ডার গড়ে তোলে। তারপর তারা অন্যদেশে রফতানি করে। আমাদের দেশে ঘটছে এর উল্টো। এমনও কথা প্রচলিত রয়েছে, আমাদের দেশে রবিশস্যসহ যেসব ফসলের ভাল ফলন হতো, সেগুলোর বীজও নাকি সুগভীর পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারত সরিয়ে নিয়েছে বা নিচ্ছে। মুসুরের ডাল, পেঁয়াজ, রসুনসহ এমন আরও শস্যের বীজ ভারতের হাতে চলে গেছে। বাস্তবেও দেখা যায়, এসব শস্যের ক্ষেত্রে আমাদেরকে ভারতের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হয়েছে। আমাদের দেশের যেসব শস্যের ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে এবং অধিক ফলন হতো সেসব শস্যের বীজ এখন ভারতের হাতে চলে গেছে। এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে! এ দায় অবশ্যই কৃষি মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের উপর বর্তায়। তারা পাট খাত রক্ষায় পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। তারা যদি দেশের চাহিদা অনুযায়ী এর বীজ যথাযথভাবে মজুদ এবং বীজ ভান্ডার গড়ে তুলত, তাহলে আমাদেরকে ভারতের উপর নির্ভরশীল হতে হতো না।
আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিয়ে গর্ববোধ করি। অথচ প্রতিষ্ঠিত এবং প্রধান অর্থকরী ফসল পাটকে রক্ষা করতে পারছি না। রক্ষা করতে পারলে এক পাট থেকেই দেশের রফতানির মূল আয় হতো। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, আমরা নিজেরাই এই খাতটিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছি। এখন ভারত থেকে নিম্নমানের বীজ আমদানি করে চাষ করতে হচ্ছে। এতে যেমন নিম্নমানের পাট উৎপাদিত হচ্ছে, তেমনি বিক্রি করতে গিয়ে কৃষক দাম পাচ্ছে না। দাম না পাওয়ায় কৃষকও পাট চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। বলা যায়, অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে পাট খাতটিকে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেছেন, ভারতের সীমান্ত এলাকায় পাটের বীজ এলাকা গড়ে তোলার জন্য ভারতকে ‘চুক্তিভিত্তিক ফার্ম’ গড়ে তোলার প্রস্তাব দেয়া হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, পাটের বীজতলা গড়ে তুলতেও কি ভারতের সহায়তা নিতে হবে? কৃষি সচিবের বক্তব্য অত্যন্ত দুঃখজনক। তাকেই প্রশ্ন করতে হয় উন্নত, বীজ সংগ্রহ করে নিজ দেশেই বীজতলা সৃষ্টির মাধ্যমে পাটের বীজ ভান্ডার গড়ে তোলা কি অসম্ভব? আমাদের দেশে কী পাটের উন্নত বীজ নেই? যদি থেকে থাকে, তবে সেগুলো কাজে লাগিয়ে কেন বীজের ভান্ডার গড়ে তোলা হচ্ছে না? আমরা মনে করি, ভারত থেকে নিম্নমানের পাটের বীজ আমদানি বন্ধ করে পাট খাতকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, পাট গবেষণা কেন্দ্র ও অন্যান্য সংস্থাকে পাটের উন্নত বীজের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য জোর পদক্ষেপ নিতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন