Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নির্বাচনব্যবস্থা ও গণতন্ত্রের জন্য একজন ‘চেঞ্জমেকার’ প্রয়োজন

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২৪ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

শতকোটি মানুষের দেশ ভারতে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সাত ধাপে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে প্রবল প্রতাপশালী ক্ষমতাসীন দল বিজেপির ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন ক্রমে ফিকে হয়ে আসছে। এটাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বৈচিত্র্য ও স্বার্থকতা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের মালিকানা জনগণের। জনমতের প্রতিফলন নির্ধারিত হয় নির্বাচনের দ্বারা। নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলনের প্রশ্নে সামান্যতম আপস করার সুযোগ গণতন্ত্রে নেই। গত ১০ বছরে সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সূচকে নানাভাবে প্রভূত উন্নয়ন ঘটিয়েছে বলে আমরা দাবি করছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার দাবি করছি। জীবন মানের উন্নয়ন, গড় আয়ু বৃদ্ধি, স্যানিটেশন ব্যবস্থাসহ কিছু সামাজিক সূচকে ভারত থেকে এগিয়ে থাকার বাস্তবতা খোদ ভারতীয়রাও স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু যেসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে এবং এই পিছিয়ে পড়ার সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্য ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে তাও এখন নড়বড়ে হয়ে যেতে শুরু করেছে। দেশে অবকাঠামো খাতে উন্নয়ন হচ্ছে, পরিবেশগত ঝুঁকি অনেক বেড়েছে, জননিরাপত্তা ও সামাজিক অবক্ষয় অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বিপদগ্রস্ত অবস্থায় উপনীত হয়েছে। নুসরাত হত্যার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টির পর বাংলাদেশে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও মূল্যবোধের সঙ্কট নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। অবকাঠামো উন্নয়ন, একের পর এক নির্বাচন হাইজ্যাক করা এবং জনমতের পথ রুদ্ধ করে দেয়ার বাস্তবতায় জনগণ কোনটিকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে জনপ্রিয়তা ও জনসর্মথনের স্বার্থে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং সরকার যদি সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চাইত তবে আমাদের প্রত্যাশিত গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তনে সহায়ক হতো। এ ক্ষেত্রে তাদের বেপরোয়া মনোভাব এবং কথিত উন্নয়নের প্রতি বেশি মনোযোগী হওয়ার প্রেক্ষাপটে সরকারের প্রতি মানুষের সমর্থন নেতিবাচক প্রান্তসীমায় উপনীত হয়েছে। আমাদের গণতন্ত্র এবং নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি আস্থা ও জনভিত্তি গড়ে তোলা ক্রমেই দুরূহ হয়ে পড়ছে। অধিকাংশ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের বাইরে রেখে, অধিকাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা, ভোটের দিন ভোটারবিহীন ভোটকেন্দ্র থেকে মনগড়া নির্বাচনী ফলাফল তৈরির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকেই পক্ষপাতপূর্ণ নির্বাচন কমিশন এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্পর্কে সাধারণ জনগণের আস্থা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলা হয়েছে। অবশ্য এর আগে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে এক-এগারোর কুশীলবদের কথিত সমঝোতা, প্রতিবেশী বড় দেশ এবং পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীদের নেপথ্য ভূমিকা এবং নির্বাচনে অস্বাভাবিক ফলাফল সচেতন মহলে প্রথম প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পরবর্তীতে কোনো কোনো ভারতীয় ও পশ্চিমা রাজনীতিকদের বক্তব্য ও লেখা থেকে এ বিষয়ে যেসব তথ্যাবলি উঠে আসে তা আমাদের গণতন্ত্র এবং স্বাধীন রাষ্ট্রসত্তার জন্য চরম অবমাননাকর। এসব বাস্তবতার নিরিখে দেশের সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবে আশা করেছিল সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের ধারাবাহিকতা থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে ডায়ালগ অথবা কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সব রাজনৈতিক পক্ষের মতামত অগ্রাহ্য করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্ত¡াবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার কারণে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রশ্নে রাজনৈতিক সমঝোতা একটি বিকল্পহীন-অবধারিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ লক্ষ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে উদ্যোগ ও চেষ্টা-তদ্বিরও কম হয়নি। মূলত সরকারি দলের একগুঁয়ে মনোভাব এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের দুর্বল অবস্থান ও যথাযথ রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে ব্যর্থতার কারণেই তা সম্ভব হয়নি। তবে রাষ্ট্র এবং গণতন্ত্রে কতিপয় রাজনৈতিক দল ও নেতার কোনো মনোপলি বিষয় হতে পারে না। দেশে শক্তিশালী, দক্ষ ও ন্যায়পরায়ণ আমলাতন্ত্র, বিচারব্যবস্থা এবং শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন থাকলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব আপস করলেও গণতন্ত্র ও জনগণের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দুত্ববাদী উগ্র জাতীয়বাদের উত্থান সত্তে¡ও সেখানকার গণতান্ত্রিকব্যবস্থা সমুন্নত থাকার পেছনে সেখানকার গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা মূল ভূমিকা পালন করছে।
বিশেষত স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা, সক্ষমতা এবং গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক মূল্যবোধের প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনারদের কমিটমেন্ট না থাকলে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না। ভারতের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ এবং নির্বাচন কমিশনের কর্মকাÐে ক্ষমতাসীন সরকারের দলীয় রাজনীতির প্রভাব কখনো বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। কর্পোরেট মিডিয়া এবং কর্পোরেট অর্থনীতির নেপথ্য কুশীলবদের দ্বারা এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা গণতন্ত্রও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে। নরেন্দ্র মোদি বা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একদেশদর্শী নেতার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম হলেও জনগণের সমর্থন ও আস্থা ধরে রেখে বার বার ক্ষমতায় আসা তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। রাজনৈতিক স্বার্থে নির্বাচন কমিশনসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা ও নিরপেক্ষতা ধ্বংস করতে পারলে তবেই ক্ষমতাসীনরা নির্বাচনকে নিজেদের ইচ্ছামতো পরিচালিত করতে পারে। নব্বইয়ে সৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিন জোটের রূপরেখা অনুসারে নির্বাচনকালীন তত্ত¡াবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। সে ব্যবস্থাধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচন ছাড়া স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনসহ প্রশাসনিক-সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। অতএব সেসব নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ছিল কি না তা সব সময়ই বিতর্কিত ইস্যু। এ সম্পর্কে পাবলিক পারসেপশন রাজনৈতিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগকে অন্যান্য বিভাগের সাথে সমন্বয় করে চলতে হয়। একটি বিভাগের সাথে আরেকটি বিভাগের সম্পর্ক ও দায়-দায়িত্ব আইন এবং রীতিনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও সুসমন্বিত। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এই ভারসাম্য নীতি শুধুমাত্র উগ্র জাতীয়তাবাদ ও বর্ণবাদী হিস্টিরিয়ার দ্বারা বিনষ্ট হতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানি ও ইতালিতে হিটলার ও মুসোলিনীর নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদের উত্থানের ঘটনা এর বড় উদাহরণ। এরা জনগণের ভোটে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর সব রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে চরম জাতীয়তবাদী ¯েøাগান তুলে ধরেন, যা শেষ পর্যন্ত ইউরোপকে বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। প্রথম মহাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয়দের হাতে ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ আরো বিস্তৃত হওয়ায় মহাযুদ্ধ প্রায় সব মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। আবার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারণে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের সম্পৃক্ততা ও স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জন অনেকটা নির্ধারিত হয়ে যায়। একই সময়ে স্বাধীনতা লাভ করলেও বহুমত ও পথের ভারতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টেকসই হলেও পাকিস্তান-বাংলাদেশসহ অন্য দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশ না হওয়ার পেছনে শুরু থেকে অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কুশীলবরা সক্রিয় ছিল। বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, নির্বাচনব্যবস্থা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নে পশ্চিমাদের তরফ থেকে রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য চাপ এক ধরনের লোক দেখানো চাপ থাকলেও বাংলাদেশে এই পারসেপশন রয়েছে যে, একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা ধরে রাখা শুধুমাত্র ভারতের ক্ষমতাসীনদের অন্ধ সমর্থনের কারণেই সম্ভব হয়েছে। তবে রাজনৈতিক চাপ ও কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর ব্যর্থতা ও ভুল পদক্ষেপ এ ক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী।
দশম জাতীয় নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে বিনাপ্রতিদ্ব›িদ্বতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া এবং অবশিষ্ট আসনগুলোতে ভোটারবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে এবং শতকরা প্রায় ৪৭ ভাগ ভোট পড়ার দাবি করে নির্বাচন কমিশন। গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক মানদÐে উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হলেও অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের বর্জন সত্তে¡ও নির্বাচনটি ছিল সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। এ বোধ থেকেই ক্ষমতাসীনরা শিগগিরই আরেকটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিলেও তা রক্ষা করেনি। তবে সেই নির্বাচন এবং পরবর্তীতে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে রাতেই সিল মেরে ভোটের বাক্স বোঝাই করার নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সাফাই গাওয়ার মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে এই প্রশ্ন উঠে এসেছে যে, নির্বাচন কমিশনের কাজ কি ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছায় যেনতেন প্রকারে একেকটি নির্বাচন বাস্তবায়ন করা ও নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে ঘোষণা দেয়া? নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা, ক্ষমতাসীন মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব, ক্ষমতাসীন দলের পৃষ্ঠপোষকতায় বৈধ-অবৈধ অস্ত্রধারীদের সন্ত্রাসী কর্মকাÐ ও অন্যায় প্রভাব এবং প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক ভূমিকার বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের কি কিছুই করণীয় নেই? তথ্যপ্রযুক্তি ও উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের মানুষ ভারতীয় সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক প্রভাবে প্রভাবিত হলেও এ ক্ষেত্রে ভারতের নির্বাচনী সংস্কৃতি ও নির্বাচন কমিশনগুলোর দৃষ্টান্তমূলক নানা পদক্ষেপ থেকে আমাদের নির্বাচন কমিশন, আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন ও রাজনৈতিক পক্ষগুলো কোনো শিক্ষাই নেয়নি। নব্বই দশকের শুরুতে বাংলাদেশে যখন নির্বাচনকালীন তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদীয় নবযাত্রা সূচিত হয়। সে সময়ে ভারতে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে টি এন সেশান নামে এক সাবেক আমলাকে নিয়োগ দেয়া হয়। টি এন সেশান ভারতীয় রাজনীতি ও আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের খপ্পর থেকে নির্বাচনব্যবস্থাকে জনমতের প্রতিফলনের জায়গায় নিয়ে যেতে আপসহীন আইনি যুদ্ধে নেমেছিলেন। উচ্চ আদালতের নিরপেক্ষ ভূমিকার কারণেই প্রবল রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে টি এন সেশন বার বার সফল হয়েছেন। ভারতীয় গণতন্ত্র এবং নির্বাচনব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য টি এন সেশানকে ‘চেঞ্জমেকার’ বলে অভিহিত করা হয়। এই পরিবর্তনের জন্য তার নাম ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন এবং নির্বাচনব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে বাংলাদেশে একজন টি এন সেশান দরকার। আমাদের আমলাদের মধ্যেই হয়তো টি এন সেশনের মতো ব্যক্তিরা আছেন। সময়ের প্রয়োজনে কেউ যদি সাহস করে দাঁড়িয়ে যায়, উচ্চ আদালত এবং পুরো জাতি তার পাশে দাঁড়াবে বলে আমার বিশ্বাস।
যেখানে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি লাভ করেনি। বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আইনগতভাবে স্বাধীন এবং নিরপেক্ষভাবে কাজ করার এখতিয়ার থাকলেও বাংলাদেশে এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও পদায়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ এবং রাষ্ট্রপতি দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। এসব প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে যারা দায়িত্ব পালন করেন তারা রাষ্ট্রীয় আইন, পদমর্যাদা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা ভুলে গিয়ে ক্ষমতাসীনদের দলীয় ক্যাডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থায় যে বিপর্যয় ঘটে বাংলাদেশে এখন তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনব্যবস্থায় নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা ছাড়া এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, জেলা পরিষদ নির্বাচন, একাদশ জাতীয় নির্বাচন, সাম্প্রতিক ডাকসু নির্বাচন এবং চলমান উপজেলা নির্বাচন পর্যন্ত জাতীয় ও স্থানীয় প্রতিটি নির্বাচনে ক্রমবর্ধমান অবক্ষয়, অস্বচ্ছতা এবং ভোটার ও জনগণের আস্থাহীনতা লক্ষ করা গেছে। প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং ডাকসু নির্বাচনের পর দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বক্তব্য ও প্রতিক্রিয়া দেখে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে মানুষের মধ্যে হতাশা ক্রমে বেড়েছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য প্রথমত একটি স্বচ্ছ ও শক্তিশালী রাজনৈতিক প্লাটফর্ম প্রয়োজন। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, নির্বাচনব্যবস্থাকে প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহল এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক বলয়ের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা। বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক সমাজে কোনো একটি রাজনৈতিক মতাদর্শিক ছকে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রিত করার কোনো সুযোগ নেই। ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট সুপারমেসিস্ট বা আমেরিকা ফার্স্ট নীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব জার্মানির নাজি দলের মেনিফেস্টোর মতোই শোনা যায়। এসব জাতীয়তাবাদী ¯েøাগানের সাথে আধুনিক গণতন্ত্রের মৌলিক বিরোধ রয়েছে। বাংলাদেশে এ ধরনের সমস্যা না থাকলেও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক স্বার্থে জনমত উপেক্ষা করে বার বার সংবিধান পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তি ধসিয়ে ফেলা হয়েছে। এখন একপাক্ষিক, একতরফা, নিয়ন্ত্রিত ও রাতের আঁধারে বিশেষ প্রতীকে ব্যালট বাক্স ভরিয়ে রাখার নির্বাচনেও নির্বাচন কমিশনের কোনো আপত্তি নেই। বিরোধ নেই। অথচ ভারতের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে মাঝখানে দু-একজন কংগ্রেস ও বিজেপি পন্থী নির্বাচন কমিশনারের কিছু বিতর্কিত ভূমিকার কথা বাদ দিলে সেই ১৯৫১ সালে প্রথম নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন থেকে বর্তমান মুখ্য নির্বাচনী কমিশনার সুনীল অরোরা পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনকে বরাবরই প্রবল রাজনৈতিক শক্তি ও ক্ষমতাসীনদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। এবারের চলমান লোকসভা নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই ভারতের নির্বাচন কমিশন নরেন্দ্র মোদিসহ বিজেপি নেতাদের নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত দেখা যাচ্ছে। গত সপ্তায় ভারতের একজন নির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনী সফরে হেলিকপ্টার তল্লাশি করে সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা রক্ষীদের না জানিয়ে হেলিকপ্টার তল্লাশি করায় এই পর্যবেক্ষক বরখাস্ত হয়েছেন। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুনীল অরোরা ভারতের ৯০ কোটি ভোটারকে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ নিশ্চিত করার প্রতিশ্রæতি দিয়ে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করেছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার সরকারের এবং সরকারি দলের আজ্ঞাবহ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করতেই যেন গর্ববোধ করেন। এরপরও আমাদের এবারের নির্বাচন কমিশনেও মাহবুব তালুকদারের মতো একজন যোগ্য নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনার রয়েছেন। একাদশ জাতীয় নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরু থেকে অদ্যাবধি তিনি স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়া, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষপাত ইত্যাদি বিষয়ে অনেক কথা বলেছেন, যা সরকার ও সরকারি দলের অবস্থানের সাথে সাংঘর্ষিক। দলীয় সরকারের অধীনে সরকারের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনের অধীনে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন অসম্ভব। এখানেই মাহবুব তালুকদারের সাথে নির্বাচন কমিশনের অন্যদের মতবিরোধ। গত সপ্তাহে মাহবুব তালুকদার বলেছেন, স্বাধীন দেশে অস্বচ্ছ নির্বাচন এবং কুয়াশাচ্ছন্ন গণতন্ত্র কাম্য নয়। মাহবুব তালুকদার প্রধান নির্বাচন কমিশনার হলে তিনি ভারতের টি এন সেশানের মতো আমাদের নির্বাচনী আইন ও নির্বাচন ব্যবস্থায় একজন চেঞ্জমেকার হতে পারতেন বলে অনেকের ধারণা। স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন এবং স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থায় সরকার ও সরকারি দলের সব প্রয়াস ব্যর্থ করে দিয়েই নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেয়া সম্ভব। হিন্দুত্ববাদের জিগির, কর্পোরেট অর্থনীতির নেপথ্য ভূমিকা, অনেক ত্রæটি-বিচ্যুতি, ইভিএম বিতর্ক ও কিছু অস্বচ্ছতা সত্তে¡ও ভারতের নির্বাচন কমিশন তার উজ্জ্বল উদাহরণ।
[email protected]



 

Show all comments
  • Mh Milton ২৪ এপ্রিল, ২০১৯, ১:৩৮ এএম says : 0
    Change maker confined in central prison.
    Total Reply(0) Reply
  • Haji Samsul Hoque Samu ২৪ এপ্রিল, ২০১৯, ১:৩৮ এএম says : 0
    Nice
    Total Reply(0) Reply
  • Saifur Rahman ২৪ এপ্রিল, ২০১৯, ১:৩৮ এএম says : 0
    কত ভালো চেঞ্জ মেকার পেলাম! দিনের কাজ রাতে করতে পারেন আর কি চেঞ্জ চাচ্ছেন?
    Total Reply(0) Reply
  • Md Alamgir ২৪ এপ্রিল, ২০১৯, ১:৩৮ এএম says : 0
    নামাজ পর‍্লে যদি মাপ হয়
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নির্বাচন

২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন