পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মহাকালের পরিক্রমায় আবার আমাদের দ্বারে ফিরে আসছে বাংলা নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ। পাকিস্তান আমলে এই দিনটি তেমন গুরুত্ব না পেলেও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর এই দিনটি যথেষ্ট গুরুত্ব ফিরে পেয়েছে। তবে অতীতে যখন বাংলা সন শহরের মানুষদের কাছে অনেকটা গুরুত্বহীন ছিল, তখন গ্রাম বাংলায় বাংলা সন যথেষ্ট গুরুত্ব লাভ করতো। গ্রাম বাংলার লোকেরা তাদের অধিকাংশ কাজকর্ম বাংলা সনের হিসাবেই সম্পাদন করে বাংলা সনকে নিজেদের দিনপঞ্জি হিসেবে মর্যাদা দিয়ে এসেছে।
এটা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যথেষ্ট বেড়ে গেছে। বাংলা সনকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মর্যাদা দেয়ার ফলে এটা ঘটেছে, যদিও এখনও ইংরেজি সন (আসলে খ্রিস্টীয় সন) শিক্ষিত মহলে সর্বত্র অধিক গুরুত্ব পেয়ে আসছে, ইংরেজি সনের ব্যাপক প্রভাবের কারণে।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, বাংলা সনের যে ব্যাপক গুরুত্ব বর্তমানে দেখা যায়, তার শুরু মোগল আমলে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে। এর আগে এ দেশে রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম পরিচালিত হতো হিজরি সাল অনুসারে। স¤্রাট আকবরের আমলে রাজস্ব আদায়ের সুবিধায় হিজরি সন থেকে বাংলা সনের যাত্রা শুরু হয়। সেই মোতাবেক, বাংলা সনের জন্মের পেছনে হিজরি সনের প্রভাব ছিল অসীম। সে হিসাবে হিজরি সনের গর্ভেই বাংলা সনের জন্ম। অর্থাৎ বাংলা সনের জন্মের পেছনে মুসলমানদের প্রভাব ছিল অনস্বীকার্য।
শুধু বাংলা সনই নয়, বাংলা ভাষা গৌরবময় ইতিহাসের পেছনেও মুসলমানদের অবদান অনস্বীকার্য। পৃথিবীতে কোনো বড় ঘটনাই হঠাৎ করে রাতারাতি ঘটে না। বাংলা ভাষার জন্মের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। বাংলা ভাষার এমনই দুর্ভাগ্য যে, জন্মের পর থেকেই এই ভাষাকে পদে পদে সংগ্রাম করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয়েছে। বাংলা ভাষার জন্ম পাল আমলে হলেও অল্প দিনের মধ্যেই দাক্ষিণাত্য থেকে আসা সেন রাজাদের কাছে পাল রাজাদের পরাজয় ঘটলে বাংলা ভাষার কপালে ঘোর দুর্দিন নেমে আসে।
সেন আমলে ব্রাহ্মণদের প্রচণ্ড প্রভাব ছিল। এই সেন-ব্রাহ্মণদের আমলে ব্রাহ্মণদের প্রভাবের কারণে সংস্কৃতকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অধিক গুরুত্ব দেয়া হতো। এই ব্রাহ্মণদের বক্তব্য ছিল: সংস্কৃত হচ্ছে দেবতাদের ভাষা, দেবতাদের অবহেলা করে সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত কোনো ভাষাকে গুরুত্ব দেয়া হলে তা হবে গুরুতর অপরাধ তথা পাপ। এই পাপের একমাত্র শাস্তি হলো চিরদিনের জন্য নরকবাস। সেই নরকে তাকে চিরকালের শাস্তি ভোগ করতে হবে। তার নামও তারা দেন। সে নরকের নাম রৌরব নরক। এই নরকের ভয় দেখিয়েই জনগণকে বাংলা ভাষা বাদ দিয়ে সংস্কৃত ভাষা ব্যবহারে বাধ্য করা হতো।
সৌভাগ্যক্রমে এ সময়ে বখতিয়ার খিলজীর আক্রমণে সেন রাজত্বের অবসান হয় এবং বাংলাদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম শাসনামলে সরাসরি বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহার শুরু হয়, তা নয়। তবে ভাষা প্রশ্নে উদার নীতি অবলম্বনের ফলে শুধু বাংলা ভাষা নয়, অন্যান্য ভাষা চর্চার ক্ষেত্রেও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ভাষা প্রশ্নে মুসলমান শাসকদের উদার নীতি গ্রহণের ফলে বাংলাসহ সকল ভাষা চর্চার মহাসুযোগ সৃষ্টি হয়। এ অবস্থার সৃষ্টির ফলে একই সময়ে বাংলা, সংস্কৃত, আরবী, ফার্সি প্রভৃতি ভাষা চর্চার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এ পরিস্থিতি চলতে থাকে বাংলাদেশে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত।
ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এক শ্রেণির ব্রাহ্মণ পণ্ডিত নতুন শাসকদের আনুকূল্য লাভ করে সংস্কৃত কণ্টকিত কঠিন বাংলা ভাষা সৃষ্টির চেষ্টা করেন, যাকে ভাষা প্রশ্নে ফোর্ট উইলিয়ামী চক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আধুনিক বাংলা ভাষা এভাবেই তার ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু করে। এর বিরুদ্ধে মুসলমান সাহিত্যসেবীরা প্রতিবাদ হিসেবে আরবি-ফার্সি শব্দ মিশেলে পুঁথি সাহিত্য সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করেন। এভাবে এক হিসেবে মুসলিম সাহিত্য-সাধকরা নিজেদেরকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা থেকে অভিমান করে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখেন। তবে কিছু দিনের মধ্যেই তাদের ভুল ধরা পড়ে। ভুল ধরা পড়ার আগেই তাদের হাত দিয়ে বিষাদসিন্ধুর মতো অমর গদ্য বাংলা সাহিত্যেকে উপহার দেয়া সম্ভব হয়। এরপর একে একে তাদের মধ্যে শেখ আবদুর রহিম, নওয়াব ফয়জুন্নেসা, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মোহাম্মদ আকবর খাঁ, বেগম রোকেয়া, মোজাম্মেল হক, কাজী ইমদাদুল হক, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী প্রমুখ এবং সর্বশেষ কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাবের ফলে আধুনিক বাংলা ভাষার অগ্রগতিতে তাদের অবদান অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ে। এর পর বাংলাভাষার মুসলমান কবি সাহিত্যিকদের আর পেছন ফিরে আসতে হয়নি।
এরই মধ্যে উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের অবসান হয় ১৯৪৭ সালে। ইংরেজ শাসনের অবসানে ভারতবর্ষ একটি অবিভক্ত ব্যবস্থাধীনে স্বাধীন হতে পারেনি। উপমহাদেশে স্বাধীন হয় যথাক্রমে হিন্দু-অধ্যুষিত স্বাধীন ভারত ও মুসলিম-অধ্যুষিত স্বাধীন পাকিস্তান হিসেবে। উপমহাদেশ ইংরেজ শাসনের অবসানে ভারত ও পাকিস্তান এই দুই স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হবার প্রসঙ্গে ভারত ও পাকিস্তানের বাইরে সার্বভৌম বাংলা নামের একটি রাষ্ট্র স্বাধীন করার একটা প্রচেষ্টা চলে। এর নেতৃত্বে ছিলেন মুসলিম লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম এবং কংগ্রেস নেতা শরৎচন্দ্র বসু, এ প্রচেষ্টার প্রতি মুসলিম লীগ হাইকমান্ড তথা কায়েদ আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর সমর্থন থাকলেও মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত নেহেরু, সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল প্রমুখ নেতার পাশাপাশি হিন্দু মহাসভার বাঙালি নেতা ড. শ্যামপ্রসাদ মুখার্জীর প্রবল বিরোধিতার কারণে তা ব্যর্থ হয়।
এদের মধ্যে ড. শ্যামপ্রসাদ মুখার্জী এমন কথাও বলেন যে, এই সার্বভৌম বাংলা কার্যকর হলে বাঙালি হিন্দুরা চিরতরে বাঙালি মুসলমানদের গোলাম হয়ে যাবে। অথচ ১৯০৫ সালে প্রধানত শাসনকার্যের সুবিধার জন্য বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত বিশাল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে বিভক্ত করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তারা কী আন্দোলনই না করেছিলেন। সেদিন বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে বঙ্গ ভঙ্গকে বাংলা মায়ের অঙ্গচ্ছেদ বলে তারা অভিহিত করেছিলেন। আর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই তারা সেই পাপ করার জন্য এমন কথা বলেছিলেন যে, ভারতবর্ষ ভাগ না হলেও বাংলা ভাগ হতেই হবে। নইলে তারা চিরতরে বাঙালি মুসলমানদের গোলাম হয়ে যাবে। বাঙালি মুসলমানদের স্থলে অবাঙালি হিন্দুদের গোলামী তাদের কাছে এত আদরের হয়ে উঠলো কেন, সে প্রশ্ন করা হলে তারা কী জবাব দেবেন?
আসলে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীসহ বাঙালি হিন্দু নেতাদের অন্ধ মুসলিম বিদ্বেষই তাদের এরকম স্ববিরোধী আচরণের মূল কারণ, সে কথা এখন দিবালোকের মতো সত্য প্রমাণিত হয়েছে। অন্ধ মুসলিম বিদ্বেষ না থাকলে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের প্রশ্নই উঠতো না এবং ’৪৭-এ কলকাতা ও বিহারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় লাখ লাখ মুসলমানকে প্রাণ দিতে হতো না। এখনো হিন্দু-অধ্যুষিত স্বাধীন ভারতে এমন কোনদিন যায় না যেদিন কোনো না কোনো স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কোনো মুসলমানকে প্রাণ দিতে না হয়। এরপরও ভারতের সাম্প্রদায়িক বিজেপি নেতা হুমকি দিয়েছেন, তারা বেছে বেছে অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশিদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেবেন। যদিও পশ্চিমবঙ্গের নেত্রী মমতা ব্যানার্জি সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, তার বাংলা (পশ্চিম বঙ্গে) রাজ্যে কোনো বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী নেই। এর পর ও কেন্দ্রের বিজেপি নেতানেত্রীদের মিথ্যা অভিযোগের পালা শেষ হবে বলে আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না।
আমরা ভারতের শাসক দল বিজেপি নেতৃবৃন্দকে তাদের সংকীর্ণ মুসলিম বিদ্বেষ ত্যাগ করতে আহ্বান জানাতে চাই উপমহাদেশের শান্তি ও সমৃদ্ধির স্বার্থে। এটা যদি তারা করতে ব্যর্থ হন, তাহলে বিশাল ভারত একদিন ভেঙ্গে টুকরা টুকরা হয়ে যেতে পারে, যার আশংকা ইতোমধ্যেই উত্তর-পূর্ব ভারতের কোনো কোনো রাজ্যে দেখা যাচ্ছে। সংকীর্ণ মন আর বিশাল দেশ একসাথে বেশিদিন চলতে পারে না, এ সত্যটা ভারতের শাসক দল বিজেপি নেতৃত্বকে সবসময় স্মরণ রাখতে আহ্বান জানাই। আমরা আন্তরিকভাবেই প্রতিবেশী দেশের সাথে সুসম্পর্ক কামনা করি। তবে এই সুসম্পর্ক কামনা বাস্তবে সম্ভব ও সফল হবে না যদি ভারতের ক্ষমতাসীন নেতৃত্বও একইভাবে সুসম্পর্ক কামনা না করে। শুধু শক্তি বলে অন্য দেশের উপর প্রভাব বিস্তার যে বেশি দিন সম্ভব নয়, তা প্রমাণিত হয়েছে। যে ইংরেজ রাজত্বে একদা সূর্য অস্ত যেতো না, সে ইংরেজ রাজত্বের অবসান ঘটেছে। যা ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি, তা ভারতীয় আধিপত্যবাদের ক্ষেত্রে সম্ভব হবে মনে করা হলে তা হবে ভুল, চরম ভুল, যা আত্মঘাতী ভুল বলেও প্রমাণিত হতে পারে। পৃথিবীতে যেভাবে সাম্রাজ্যবাদের দিন ফুরিয়ে গেছে, তেমনি আধিপত্যবাদের দিনও শেষ হয়ে গেছে। এ সত্যটা আমাদের প্রতিবেশী দেশের আধিপত্যবাদী নেতৃত্বকে মনে রাখতে হবে। এদেশের মুসলমান বাঙালি ও বাংলা ভাষা নিয়ে যে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত হয়েছে বাংলা নববর্ষের আলোচনায় তা অপ্রাসঙ্গিক নয়। ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত শেষ হয়ে যায়নি। এ সম্পর্কে আমাদের সদা-সতর্ক থাকতে হবে। পরিশেষে নববর্ষে সকলের কল্যাণ কামনা করি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।