Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গানে গানে নববর্ষ

মোবারক হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ১৪ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০১ এএম

পল্লীগান বা লোকসংগীত বাংলার মানুষের প্রাণ। এ সংগীত চিরায়ত। এ সংগীতে আছে মাটির মানুষের প্রাণের ছোঁয়া। তাদের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাক্সক্ষা, বিরহ-ব্যথা, হাসি-কান্নার কাহিনী এ সংগীতের মূল বিষয়বস্তু। গ্রাম্যজীবন, প্রকৃতি ও পল্লী মানুষের মনের কথা নিয়ে রচিত এই গান। তাই এ গানের সৃষ্টির মূলে রয়েছে কৃষক, জেলে, মাঝি, তাঁতী, কুমার আর কামারের মতো গ্রাম্য মানুষের আর্তি আর হৃদয়ের ভাষা। এ সংগীতের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আর এই বৈশিষ্ট্য গ্রামীণ মানুষের একান্ত আপন ধন। যেসব বৈশিষ্ট্য নিয়ে এ সংগীত সমৃদ্ধ সেগুলো হলো- এ গানের অনুশীলনের কোনো বিধিব্যবস্থা নেই। স্বভাব দক্ষতাই হলো গায়কের বৈশিষ্ট্য। কেবল কানে শুনেই এ গান লোকের মুখে মুখে প্রচলিত। এ গানের বাণী মুখে মুখে রচিত। কোনো বিশেষ অনুভূতি বা প্রেরণা গ্রাম্য কবিদের স্বতঃস্ফূর্ত কবিতা আর গান রচনায় উদ্বুদ্ধ করে। তাই এ গানের মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা নেই, কোনো কষ্ট কল্পনা নেই। এ গানের সাথে গ্রাম্য সমাজ জীবনের একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের দেশের মানুষের বিচিত্র সামাজিক জীবনের জন্য বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে এ গান বৈচিত্র্যময়। এ গান বিষয়, ভাব, রস আর সুরের দিক দিয়ে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। মোটকথা, বাংলাদেশের মানুষ যেমন মাটির, এদেশের গানও তেমনি বৈচিত্র্য, মাধুর্য ও ভাবসমৃদ্ধ।

বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে গ্রীষ্মের খরতাপের বৈশিষ্ট্য গানের মাঝেও প্রতিফলিত। এ ঋতুর গানের বাণীতে গ্রীষ্মের রূপ ফুটে উঠেছে। গ্রীষ্মের রূপ দু’ভাবে ধরা পড়েছে। একটি তার বহিরঙ্গ দৃশ্যমূর্তি, অপরটি অন্তরঙ্গ ভাবমূর্তি। গ্রীষ্মের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপটি রুক্ষ, কঠোর বিশুদ্ধ ও প্রচন্ড। প্রখর রোদের প্রচন্ডতায় যেন পৃথিবী জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যায়। চারদিকে বিরাজ করে এক বিবর্ণ পান্ডুরতা। মাঠঘাট-প্রান্তর ফেটে চৌচির হয়ে যায়। উত্তপ্ত আবহাওয়া পরিমন্ডলকে অগ্নিময় করে তোলে। চারদিকে যেন নিদাঘের রুদ্রদহন বিরাজ করে। এ যেন প্রকৃতির এক ভীষণ রুদ্ররূপ। যে বছর গতায়ু হয়েছে তার আবর্জনাকে যেন সে সইতে পারে না। তার উষ্ণ নিঃশ্বাসে যা কিছু পুরাতন, যা কিছু জীর্ণ, সবকিছুকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে চায়। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলার কথা বলেছেন।

ঋতু গ্রীষ্ম যেন খর রৌদ্রের বন্যা বইয়ে দেয়। তাপিত ধরণী রুদ্র রূপ ধারণ করে। ঝড়ের দাপটে প্রকৃতি হয়ে ওঠে চঞ্চল, দিশাহারা। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম গ্রীষ্মকালের সেই কঠোর রূপের বর্ণনা দিয়েছেন তার গানে ও সুরে। তিনি লিখেছেন,
খর রৌদ্রের হোমানল জ্বালি
তপ্ত গগনে জাগি
রুদ্র তাপস সন্ন্যাসী বৈরাগী।

গ্রীষ্ম ঋতুর রৌদ্রতপ্ত রূপের ভেতরই চুপটি করে বসে আছে নববর্ষ, নতুন বছরের প্রথম দিনটি। বাংলাদেশের ষড়ঋতুর মাঝ দিয়ে একে একে যুগলবন্দীতে বারো মাস শেষ হয়ে আবার ঘুরে আসে। শুরু হয় নতুন বছর। বৈশাখ আসে। আমরা নববর্ষ বলে বরণ করে নিই বৈশাখের প্রথম দিনটিকে। নতুন সবকিছুতেই একটা বৈচিত্র্য থাকে। নতুন বছরের প্রথম দিনটিও তা থেকে বাদ পড়ে না। পুরনো বছর গত হয়ে নতুন বছর আসে এক তারুণ্যের বাণী নিয়ে। মহাউল্লাসে নতুন রূপে আমরা বরণ করি এই নববর্ষকে গভীর অনুরাগে। নববর্ষের যে গান সে গান যেন, পুরনো বছরের আবর্জনাকে দূর করার আহবান জানায়। বৈশাখের প্রথম দিন থেকেই যেন সে সুরের অনুরণন শুরু হয়, যা এদেশের মানুষের মনে যাত্রার শুভলগ্ন হয় শুরু। চৈত্র মাসের পাতা ঝরার শেষে বনভূমি নব পত্রপুষ্পদলে সেজে অপরূপ হয়ে ওঠে। নব বিশালয়ের স্নিগ্ধশ্যামল শোভায় দোয়েল, কোয়েল, বউ কথা কও পাখির গানের সাথে পল্লী মানুষের কণ্ঠের সুর এক হয়ে নতুন আনন্দ-সংগীতে দেশকে ভরিয়ে তোলে। একটা খুশির উত্তরোল চারদিকে ছোটাছুটি শুরু করে। দেশের মানুষের মনে সৃষ্টি করে এক নতুন ভাবাবেগের। প্রকৃতির নিয়মে পৃথিবী যে আপন নিয়মে পথ-পরিক্রমণেরত সে কথা যেন আবার নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেয়। নববর্ষের আগমনে চির-পুরাতন কথাটিই সবার মনে জাগ্রত হয়। পহেলা বৈশাখ বিগত বছরের সব দুঃখ-বিষাদের স্মৃতি অন্তর থেকে ধুয়ে মুছে দিয়ে ভাবী সম্ভাবনার এক নতুন দুয়ার উন্মুক্ত করে আমাদের জন্য বয়ে আনে এক আনন্দের পসরা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই বৈশাখকে আহবান করে লিখেছেন,

তাপস নিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,
অশ্রæ বাষ্প সুদূরে মিলাক

বাংলা নববর্ষ তেমনি আবার স্মরণ করিয়ে দেয়, মুঘল সস্রাট আকরের কথা। তার সিংহাসনে আরোহণের ঘটনা স্মরণীয় হয়ে আছে এই বাংলা নববর্ষের সাথে। এই বাংলা সনের যিনি ¯্রষ্টা তার নাম ফতেহ্উল্লাহ্ শিরাজী। উৎপত্তির সময় থেকে এদেশের মানুষ চাষাবাদ, খাজনা পরিশোধ, সংবছরের হিসাব-নিকাশ সব কিছুতেই বাংলা বর্ষপঞ্জী অনুসরণ করে থাকে।

বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে দেশ। সর্বজনীন উৎসবের মধ্য দিয়ে এক অবিভাজ্য সাংস্কৃতিক রূপ মূর্ত হয়ে ওঠে। পহেলা বৈশাখ এ দেশের মানুষের সামাজিক বিচিত্র অনুষ্ঠানের বিচিত্র সমারোহে জড়িয়ে থাকা প্রকৃতির নব নব অভিষেক। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে কৃষ্ণচূড়ার শাখায় ফুলের রক্তিম উচ্ছাস যেমন এক নতুন সম্ভাবনার প্রতিচ্ছবি তোলে, নববর্ষের আনন্দোচ্ছল দিনও সেই উচ্ছাসের আরেক রূপ। সেই রূপের কথাই কবি লিখেন কবিতায়, গীতিকার লিখেন গানে।

নববর্ষের রূপ-কল্পনায় গানের ভূমিকা তাই বিশেষ তাৎপর্যময়। পুরাতনের সাথে নতুনের যে যোগাযোগ ঘটে মাসের পরিক্রমায়, সেই সুর গানের বাণীতেও হয়ে ওঠে মুখর। এদেশের মানুষের কণ্ঠে নতুন বছরের সে গান বৈশাখের দিনগুলোতে নতুন আশা ও আনন্দের তরঙ্গ বয়ে আনে। তাই নববর্ষ এদেশের মানুষের কাছে চির নতুন। (সংকলিত ও সংক্ষেপিত)

লেখক: সঙ্গীতজ্ঞ ও সাবেক মহাপরিচালক, শিল্পকলা একাডেমি



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নববর্ষ

১৪ এপ্রিল, ২০২২
১৪ এপ্রিল, ২০২২
১৪ এপ্রিল, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন