পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
পুরান ঢাকার চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ৩৭ দিন পর অভিজাত এলাকা বনানীর এফআর টাওয়ারে অনুরূপ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে জ্বলেপুড়ে মৃত্যুবরণ করেছে ১৯ জন। শুরুতে মৃতের সংখ্যা ২৫ বলা হলেও ফায়ার সার্ভিস কন্ট্রোল রুম থেকে জানানো হয় ১৯ জনের কথা। আহত হয়েছে শতাধিক। গত বৃহস্পতিবার দুপুর পৌনে একটার দিকে এই আগুনের সূত্রপাত হয়। ২২ তলা ভবনটির ৯ তালা থেকে আগুন অন্যান্য তালায় তা ছড়িয়ে পড়ে। কীভাবে আগুনের সূত্রপাত হয়, তা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, আগুন লাগার কারণ তদন্ত ছাড়া বলা যাবে না। এ বিষয়ে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডে ভবনটিতে অবস্থানরতরা প্রাণভয়ে দিগবিদিগ জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন। যে যেভাবে পেরেছে বের হতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ উঁচু তালা থেকে লাফ দিয়ে এবং কেউ কেউ বিভিন্ন ধরনের তার ধরে নামতে চেষ্টা করেছেন। এতে বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হন। অনেকে ভবনের ছাদে ওঠেন এবং পাশের ভবনে নামার চেষ্টা করেন। অনেকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে চেষ্টা করেও প্রচণ্ড ধোঁয়ার কারণে বের হতে পারেননি। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এত উঁচু ভবনের সিঁড়ি ছিল অত্যন্ত সরু। মাত্র তিন ফুট। এত সরু সিঁড়ি দিয়ে একসাথে অনেকের নামা সম্ভব নয়। ভবনে আটকে পড়া মানুষ জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে সাহায্যের আবেদন করতে থাকেন। চোখের সামনে বাঁচার এই আঁকুতির দৃশ্য সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিস তার সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালিয়ে যায়। আগুন নেভাতে ও আটকেপড়া মানুষদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর ৫টি হেলিকপ্টার অংশগ্রহণ করে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রাত ৮টার দিকে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে। আমরা তাদের অভিনন্দন জানাই। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর থেকে ভবনটির বিভিন্ন ফ্লোরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা প্রবেশ করে একের পর এক লাশ বের করে আনেন। আগুন লাগার পর ঘটনাস্থলে হাজার হাজার মানুষ ভীড় করে। এতে উদ্ধারকাজে যথেষ্ট ব্যাঘাতের সৃষ্টি হয়।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় আগুন লাগার ঘটনা অনেকটাই নিয়মিত হয়ে উঠছে। এক্ষেত্রে অসচেতনতা এবং অনিয়মই মূল কারণ হিসেবে বারবার উঠে আসছে। যখন এ ধরনের ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটে, তখনই এসব অনিয়মের বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও তদন্তের কথা বলে এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করে। কিছুদিন চলার পর তা বন্ধ হয়ে যায়। কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। যেন আরেকটি ঘটনা ঘটার জন্য অপেক্ষায় থাকে। রাজধানীর পুরান ঢাকা থেকে শুরু করে অভিজাত এলাকার বিভিন্ন ভবনে অগ্নিনির্বাপনের যথাযথ ব্যবস্থা আছে কিনা, তা উপেক্ষিত থেকে যায়। ঘটনা ঘটার পর বের হয়ে আসে নানা অনিয়মের কথা। ২২ তালা এফ আর ভবনটিতে যে অনিয়ম ছিল, তা এখন প্রকাশিত হচ্ছে। কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে অবস্থিত ভবনটির রাজউকের অনুমোদন ছিল ১৮ তালা পর্যন্ত। ভবন কর্তৃপক্ষ তা না মেনে আরও কয়েক তলা বাড়ায়। এমনকি বহুতল ভবনের চারপাশে জায়গা ছাড়ার যে বিধান রয়েছে তাও ভবন কর্তৃপক্ষ মানেনি। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ভবনটিতে অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এর আগে চকবাজারের চুড়িহাট্টার যে ভবনটিতে আগুন লাগে, সেটির কোনো অনুমোদনই ছিল না। দেখা যাবে, যথাযথভাবে তদারকি করলে রাজধানীর অনেক ভবনেই এ ধরনের অনিয়ম ধরা পড়বে। এ পর্যন্ত যে কয়টি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে সেগুলোর ব্যাপারে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও, তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, এমন খবর পাওয়া যায়নি। একের পর এক ট্র্যাজিক ঘটনা ঘটলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তো বটেই ভবন মালিকদের মধ্যে কোনো সচেতনতা বাড়েনি। এমন উদাসীনতা বিশ্বের আর কোনো দেশে আছে কিনা, তা আমাদের জানা নেই। বিশেষজ্ঞরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন, যেভাবে অপরিকল্পিতভাবে রাজধানী গড়ে উঠছে, তাতে আগুন লাগলে অসংখ্য প্রাণহানি ঘটবে। হচ্ছেও তাই। তবে এ কথা অনস্বীকার্য, রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে বহুতল ভবন গড়ে উঠা স্বাভাবিক। তার অর্থ এই নয়, এগুলো যথাযথ নিয়ম মেনে করা হবে না। এক কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের গায়ে গা লাগিয়ে আটটি বহুতল ভবন নির্মিত হয়েছে। এসব ভবনের চারপাশে যে প্রয়োজনীয় জায়গা থাকা দরকার, তা নেই। আগুন লাগার মতো ঘটনা ঘটলে দেখা যাবে, সবগুলোতেই তা ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের দেশে বহুতল ভবনে আগুন লাগলে তা নিয়ন্ত্রণ করার মতো প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং সক্ষমতা নেই বললেই চলে। যদিও আগের তুলনায় কিছুটা আধুনিকায়ন করার প্রক্রিয়া চলছে, তবে তা বাস্তব প্রেক্ষাপটে খুবই অপ্রতুল। যানজটের রাজধানীতে কোনো জায়গায় আগুন লাগলে সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতেও অনেক সময় লেগে যায়। ততক্ষণে জানমালেরও অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায়। এসব দিক বিবেচনা করলে রাজধানী অগ্নিকাণ্ডের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ডই অসচেতনতা এবং উদাসীনতার কারণে ঘটে থাকে। বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে অগ্নিকাণ্ডের বিষয়টি খুব একটা আমলে নেয়া হয় না। কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ ও বাণিজ্যিক ভবনে লোক দেখানো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখা হয়। তারা ভাবেন না, ভবনে আগুন লাগতে পারে এবং এজন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকা দরকার। ভবনগুলোতে জরুরি এক্সিট ব্যবস্থাও যথাযথভাবে থাকে না। থাকলেও তা দায়সারা গোছের। আমরা মনে করি, রাজধানীতে যেসব হাইরাইজ বিল্ডিং রয়েছে, সেগুলো যথাযথ নিয়ম মেনে করা হয়েছে কিনা, তা রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের খতিয়ে দেখা উচিত। যেসব ভবন নিয়ম মানেনি, সেগুলোর মালিকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। অন্যদিকে যেসব নতুন ভবন হচ্ছে, সেগুলোও আগে থেকে তাদারকি করতে হবে। আগুন লাগলে তা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ফায়ার সার্ভিসকে আধুনিক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তোলা অপরিহার্য, যাতে ঘিঞ্জি এলাকা থেকে শুরু করে অভিজাত এলাকার আগুন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে প্রতিষ্ঠানটি সক্ষম হয়। এক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের অগ্নিব্যবস্থাপনা অনুসরণ করা প্রয়োজন। আগুন লাগলে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা থাকা দরকার। রাজধানীতে একসময় প্রায় অর্ধশত খাল, অসংখ্য পুকুর, জলাশয় ছিল। এমনকি পার্কেও পুকুর, লেক দেখা যেত। এসব খাল, ঝিল, পুকুর, জলাশয় ভরাট করে রাস্তাসহ ভবন নির্মিত হয়েছে। যে গুটিকয় আছে সেগুলোও সংস্কারের অভাবে এবং দখলদারিত্বের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। এসব খাল, পুকুর যদি উদ্ধার ও যথাযথভাবে সংস্কার করা যায়, তবে অগ্নিকাণ্ডের সময় পানি সংকট অনেকটাই দূর হবে। গত বৃহস্পতিবার দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি অগ্নিনির্বাপণের জন্য রাজধানীতে পানির আধার সৃষ্টি করার জন্য ওয়াসাকে তাকিদ দিয়েছে। এটি একটি ভাল উদ্যোগ। আমরা আশা করব, ওয়াসা দ্রুত এ উদ্যোগ নেবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।