পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত ১৫ মার্চ শুক্রবার নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে জুমার নামাজের সময় এক উগ্রবাদী সন্ত্রাসী গুলি করে ৫০ জন মুসল্লিকে হত্যা করেছে। নিহতদের মধ্যে শিশু, বৃদ্ধ ও মহিলাও রয়েছে। তারা স্থানীয়সহ বিভিন্ন দেশের নাগরিক। আহত হয়েছে আরো অনেকে। ঘাতক ২৮ বছর বয়সী অস্ট্রেলীয় নাগরিক। নাম, ব্রেনটন হ্যারিসন টারান্ট। যারা নিরিহ-নিরপরাধ এবং নামাজরত অবস্থায় ছিল, তাদের এভাবে কেউ গুলি করে হত্যা করতে পারে, তাও নিউজিল্যান্ডের মতো শান্তির দেশ হিসাবে পরিচিত একটি দেশে, কেউ কল্পনাও করতে পারে না। নিউজিল্যান্ডবাসীসহ গোটা বিশ্বের মানুষ এ বর্বর হত্যাকান্ডে বিস্মিত, হতবাক। ঘাতক-সন্ত্রাসী টারান্ট এই হত্যাকান্ডের দৃশ্য ধারণ করে ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচার করেছে। সে এর আগে ৭৪ পৃষ্ঠা ব্যাপী একটি বিবৃতিও প্রচার করেছে। হত্যাকান্ডটি যে সুপরিকল্পিত ও চরম হিংসাত্মক, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। দেখা গেছে, আহতদের অনেকের ওপর বার বার গুলি চালিয়ে সে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। তাকে আটক করে যখন আদালতে তোলা হয়েছে, তখন তার মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা দেখা যায়নি। উল্টো সে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসের প্রতীকীচিহ্ন প্রদর্শন করেছে।
এই শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসের প্রতীকী চিহ্ন প্রদর্শন সে তার একটি পরিচয় নিশ্চিত করেছে। সে নিজেও, বলা বাহুল্য শ্বেতাঙ্গ। তার দেয়া বিবৃতিতে সে কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী গণহত্যাকারীকে তার আদর্শ হিসাবে উল্লেখ করেছে। সে একজন খৃস্টান এবং কট্টর মুসলিম বিদ্বেষী। এদিক দিয়ে সে খৃস্টান সন্ত্রাসী। তার বিবৃতিতে সে ইসলাম প্রচারের এক পর্যায়ে সংঘটিত মুসলমানদের সঙ্গে খৃস্টানদের ক্রুসেডের কথা স্মরণ করেছে। তার তৃতীয় পরিচয়, সে ইউরোপে ও খৃস্টান অধ্যুষিত দেশে অশ্বেতাঙ্গ, বিশেষ করে মুসলিম অভিবাসনের ঘোর বিরোধী। সংক্ষেপে বলা যায়, টারান্ট একাধারে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্টত্ববাদী, খৃস্টান শ্রেষ্ঠত্ববাদী ও উগ্র মুসলিম বিদ্বেষী এবং খৃস্টান বিশ্বে অভিবাসনবিরোধী সন্ত্রাসী। শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে শ্বেত্বাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের ধারণা বহু প্রাচীন। তারা মনে করে, শ্বেতাঙ্গরাই বর্ণশ্রেষ্ঠ। এই বর্ণবাদী ধারণা কখনই তাদের মধ্যে থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। নানা কারণে তা কখনো কখনো চাপা পড়ে গেলেও পুনরায় জেগে উঠেছে। এটা তাদের রক্তের সঙ্গেই মিশে আছে। সম্প্রতিক বছরগুলোতে উগ্র শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদ আবার মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়েছে। প্রধানত ইউরোপ-আমেরিকা শ্বেতাঙ্গদের আবাসস্থল হওয়ায় এই দুই মহাদেশে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদ স্বভাবতই অধিকতর দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। বিশ্বের অন্যান্য শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত এলাকায় বা দেশেও শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদ জেগে উঠতে শুরু করেছে। এ প্রসঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। নিউজিল্যান্ডও শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত দেশ। তবে সেখানে এতদিন একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানমূলক পরিবেশ বিদ্যমান ছিল। টারান্ট এই দেশটিকেই তার নৃশংস ও নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের ক্ষেত্র হিসাবে বেছে নিয়েছে। অত:পর সেখানে ভবিষ্যতে কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে তা ভবিষ্যতই বলতে পারে। নিউজিল্যান্ডের সরকার, প্রশাসন এবং জনগণ শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদের হুমকি যাতে কখনই দেখা না যায় এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নিবিশেষে সবাই যাতে আগের মতই সদ্ভাব-সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করতে পারে সে জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। তাদের প্রচেষ্টা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে।
বিশ্বের শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর প্রায় সবাই খৃস্টধর্মাবলম্বী। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের মতো খৃস্টান শ্রেষ্ঠত্ববাদ ও তাদের মধ্যে প্রবল। তারা মনে করে, খৃস্টধর্মই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। একই সঙ্গে তারা এও মনে করে, ইসলাম ধর্মই তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ। এক সময় যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের প্রধান ভীতির কারণ ছিল কমিউনিজম। বিশ্বজুড়ে কমিউনিজমের পতন ঘটায় সে ভীতি দূর হয়েছে। এখন পূর্ব ইউরোপের এক সময়ের কমিউনিস্ট দেশগুলোও খৃস্টান শ্রেষ্ঠত্ববাদে প্রভাবিত। দ্রæত সম্প্রসারণশীল ধর্ম হিসাবে ইসলামের অগ্রযাত্রায় গোটা খৃস্টবিশ্বই আতংকিত ও ভীতিগ্রস্ত। তারা মনে করছে, এমন একটা সময় আসতে পারে যখন ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বে খৃস্টান অধিপত্যের অবসান ঘটবে এবং তার জায়গাটি নিয়ে নেবে ইসলামের অনুসারীরা। গত কয়েক দশক ধরে খৃস্টান বিদ্বৎ সমাজের একাংশ, একশ্রেণীর রাজনীতিক ও ধর্র্মীয় নেতা এবং মিডিয়া ইসলাম-আতংক প্রচার করছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানারকম ষড়যন্ত্র করছে। ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। একই সঙ্গে খৃস্টান রাষ্ট্রশক্তিগুলো একট্টা হয়ে মুসলিম দেশগুলোকে একের পর এক ভেঙ্গে দিচ্ছে, নাজেহাল করছে। মুসলমানদের ঢালাওভাবে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে তাদেরই হত্যা করছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উগ্র ডানপন্থী রাজনীতির, যা আসলে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ ও খৃস্টান শ্রেষ্ঠত্ববাদ দ্বারা প্রভাবিত, বিস্তার ঘটছে। সে সব দেশে এই দুই শ্রেষ্ঠত্ববাদ প্রচারের পাশাপাশি লাগাতার মুসলিম বিদ্বেষ প্রচার করা হচ্ছে। মিডিয়াগুলো ব্যতিক্রমবাদে এক্ষেত্রে শর্তহীন ও স্বতর্স্ফূত সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। ইসলাম ফোবিয়াজাত এই বিদ্বেষবিষ ছড়িয়ে দেয়ার কারণে ব্যক্তি পর্যায়ে ও সংগঠন পর্যায়ে বহু শ্বেতাঙ্গ খৃস্টান সন্ত্রাসীর জন্ম হয়েছে, যারা সুযোগ মতো মুসলমানদের ওপর হামলা করছে। তাদের হত্যা করছে, রাস্তাঘাটে অপমান-অপদস্ত করছে। বলতে গেলে, তাদের জীবনের নিরাপত্তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
এটা সহজেই লক্ষ্যণীয়, কোনো ক্ষেত্রে আক্রমণকারী যদি মুসলমান হয়, তবে তাদের মুসলিম জঙ্গী বা জেহাদী বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু আক্রমনকারী যদি শ্বেতাঙ্গ ও খৃস্টান হয়, তবে তাকে খ্রীস্টান জঙ্গী বা খৃস্টান সন্ত্রাসী বলা হয় না। আক্রমনকারী যদি ইহুদি, বৌদ্ধ, হিন্দু বা অন্য সম্প্রদায়ের হয়, তাহলেও তাদের ক্ষেত্রে ধর্মীয় পরিচয় যুক্ত করা হয় না। মুসলমানদের বিরুদ্ধে অন্য সব ধর্মীয় জাতি-সম্প্রদায়ই একট্টা ও অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করে। ‘সব শিয়ালের এক রা’, প্রবাদের মতো মুসলমানরা সবাই জঙ্গী, জিহাদী বলে জোর অপপ্রচার চালানো হলেও এই জঙ্গী বা জিহাদীদের হামলার সংখ্যা কিন্তু খুবই নগন্য। সেই তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে শ্বেতাঙ্গ ও খৃস্টান শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের হামলার সংখ্যা অনেক বেশি। অস্ট্রেলিয়ার সিডনীভিত্তিক একটি সংস্থার হিসাবে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ১১৩টির মতো সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে, যাতে অন্তত ৬৬জন নিহত হয়েছে। ২০১৭ সালেই পশ্চিম ইউরোপে ৫৯টি হামলার নিহত হয়েছে ১৭জন। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংস্থার হিসাবে, সে দেশে ২০১৮ সালে বর্ণবাদী হামলায় অন্তত ৫০ জন নিহত হয়েছে।
অনেকেরই ইতোমধ্যে জানা হয়ে গেছে, নিউজিল্যান্ডের দুই মসজিদে হামলা ও হত্যাকাÐের পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মসজিদে মসজিদে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। তা সত্তে¡ও একই দিনে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বৃটেনে একটি মসজিদে হাতুড়ি হামলার ঘটনায়, একজন মুসল্লি আহত হয়েছে। কয়েক দিনের ব্যবধানে সেখানে আরও পাঁচটি মসজিদ হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। অস্ট্রেলিয়াতে এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটেছে। শ্বেতাঙ্গ ও খৃস্টান শ্রেষ্ঠত্ববাদ এখন কোন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, এসব হামলার ঘটনা থেকে তা সহজেই আন্দাজ করা যায়। শুধু তাই নয়, টারান্টের মুসলিম গণহত্যাকে অনেক দেশেই অনেকে সমর্থন জানিয়েছে। ভিন্ন চিত্রও অবশ্য আছে। সেদিক দিয়ে নিউজিল্যান্ড বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সেখানে শ্বেতাঙ্গ খৃস্টানসহ বিভিন্ন বর্ণ ও ধর্মের মানুষ একসঙ্গে ওই হামলা ও হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। মুসলমানদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে এবং সম্প্রীতি, সৌহার্দ ও সহাবস্থানের পক্ষে সোচ্চার হয়েছে, অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও শ্বেতাঙ্গ ও খৃস্টান হওয়া সত্তে¡ও বিপুল সংখ্যক মানুষ নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলা ও হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে। তারা স্ব-স্ব দেশে মুসলমানদের প্রতি সহমর্মিতাও প্রকাশ করেছে। এটা নি:সন্দেহে একটি আশার দিক। মানবতা যে একেবারে নি:শেষ হয়ে যায়নি, এটা তারই প্রমাণ।
বিশেষজ্ঞ ও ওয়াকিহাল মহলের মতে, নব পর্যায়ে শ্বেতাঙ্গ ও খৃস্টান শ্রেষ্ঠত্ববাদের অভিযাত্রা শুরু হয়েছে গত শতাব্দীর ৭০ এর দশক থেকে। আমরা ক্রুসেডের কথা জানি। ঊনিশ ও বিশ শতকের প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী সংগঠন ক্লু ক্লাক্স ক্লানের (কে কে কে) কথাও জানি। বছরের পর বছর ধরে চলা ক্রসেডে মত মানুষ হতাহত হয়েছে, তার হিসাব নেই। আর যুক্তরাষ্ট্রে কে কে কে’র হাতে লাখ লাখ কৃষ্ণাঙ্গ নিহত হয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গদের দাস বানিয়ে বেচাকেনার কথাও কারো অজানা নেই। অনেকেরই ধারণা, শ্বেতাঙ্গ খৃস্টানদের রক্ত ধারায় বহমান শ্বেতাঙ্গ ও খৃস্টান শ্রেষ্ঠত্ববাদের একটা বড় রকমের প্রকাশ ঘটেছে ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের মধ্যদিয়ে। ট্রাম্প একাধারে উগ্র শ্বেতাঙ্গবাদী ও খৃস্টবাদী। তিনি যেমন বিশ্বাস করেন শ্বেতাঙ্গরাই শ্রেষ্ঠ তেমনি মনে করেন, খৃস্টানরাই শ্রেষ্ঠ। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ ও খৃস্টান অধিপত্য ধরে রাখতে ও সেই অধিপত্য নিরাপদ করার অঙ্গীকার নিয়ে নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণা চালান। তিনি সোচ্চারে তার অভিবাসনবিরোধী মনোভাবও প্রকাশ করেন। এই প্রচারণা মধ্যবিত্ত ও সাধারণ শ্বেতাঙ্গদের বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ ও প্রভাবিত করে। এরাই মূলত ভোট দিয়ে তার বিজয় নিশ্চিত করে। নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৭ সালে ট্রাম্প কুখ্যাত শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী ঘাতক সংগঠন কে কে কে’র প্রতি সমর্থন জানান এবং ভাার্জিনিয়ার সালটিসভিলে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের বিক্ষোভে অংশ গ্রহণকারীদের ‘সজ্জন’ বলে অভিহিত করেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ ও খৃস্টান শ্রেষ্ঠত্ববাদের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। মুসলিমবিদ্বেষ এবং অভিবাসন বিরোধী মনোভাবও উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ ও খৃস্টান শ্রেষ্ঠত্ববাদের রাজনীতি বিজয় লাভ করায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এই উগ্র বর্ণবাদী ও সম্প্রদায়িক রাজনীতি বিস্তার লাভ করেছে। ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, হাঙ্গেরী প্রভৃতি দেশে শ্বেতাঙ্গ ও খৃস্টান শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা এখন বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনো দেশ তারা ক্ষমতাসীন হয়েছে। কোনো কোনো দেশে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় আছে। নিউজিল্যান্ডের ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হাঙ্গেরীর প্রধানমন্ত্রী ইউরোপে খৃস্টান সংস্কৃতি রক্ষার দাবি জানিয়ে বলেছেন, তা যদি না করা যায়, তাহলে ইউরোপ খৃস্টানদের হাত থেকে মুসলমানদের হাতে চলে যাবে। তার এ বক্তব্যে শ্বেতাঙ্গ ও খৃস্টান শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের মনোভাবেরই প্রতিফলন রয়েছে। অনেকেই জানেন, জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মার্কেল ১০ লাখ সিরীয় অভিবাসীকে আশ্রয় দিয়ে বিশ্বব্যাপী বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছেন। কিন্তু সে দেশের শ্বেতাঙ্গ ও খৃস্টান শ্রেষ্ঠত্ববাদীসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের শ্বেতাঙ্গ ও খৃস্টান শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা তার সমালোচনায় মুখর হয়েছে এবং এখনো রয়েছে। সেখানে তার প্রতিপক্ষে জোরদারভাবে দাঁড়িয়ে গেছে নব্য নাৎসীরা। সিরীয় অভিবাসীরা ইউরোপীয়দের মতোই সাদা। তাদের এই শ্বেতবর্ণ কোনো সহানুভতি পায়নি। কারণ, তাদের আর একটি বড় পরিচয় হলো, তারা মুসলমান। ‘অল্টার নেটিভ ফর জার্মান’ দলের আক্রোসটা এখানেই। ফ্রান্সে ‘ন্যাশনাল ফ্রণ্ট,’ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান, দেশগুলোতে ‘নরডিক রেজিস্ট্যান্স মুভমেন্ট’ প্রভৃতি শ্বেতাঙ্গ ও খৃস্টান শ্রেষ্ঠত্ববাদী সংগঠন ক্রমশই জোরদার হয়ে উঠছে।
টারান্ট সম্পর্কে বিশেষভাবে জানা গেছে, সে একটা দীর্ঘ সময় ইউরোপে কাটিয়েছে। এ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ ও খৃস্টান শ্রেষ্ঠত্ববাদী ও মুসলিমবিদ্বেষী রাজনীতি, রাজনীতিবিদদের উস্কানিমূলক বক্তব্য এবং প্রচার মাধ্যমের লাগাতার প্রচারণা তাকে শুধু প্রভাবিতই করেনি, অন্ধ করে দিয়েছে। তার বিবৃতিতে সে বলেছে, পাশ্চত্য সভ্যতাকে সে বহিরাগতদের আক্রমন থেকে রক্ষা করতে চায়। সে যে ট্রাম্প দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, সে কথাও অকপটে স্বীকার করেছে। পাশ্চাত্য সভ্যতা বস্তুতই শ্বেতাঙ্গ ও খ্রীস্টান সভ্যতা। আমরা এখানে স্মরণ করতে পারি ২০১৭ সালে দেয়া ট্রাম্পের সেই উক্তি, যেখানে তিনি বলেছেন, ‘খ্রস্ট ধর্ম আজ বিপন্ন। যারা তাকে ধ্বংস করতে চায় তাদের নিধন ও প্রতিরোধ করার সাহস কি আমাদের আছে?’ শ্বেতাঙ্গ ও খ্রীস্টান শ্রেষ্ঠত্ববাদ, যার অপর নাম পাশ্চাত্য সভ্যতাও বটে, তার সুরক্ষায় নিধন ও প্রতিরোধের যে উস্কানি তিনি দিয়েছেন, যদি বলা হয়, তাতে প্ররোচিত হয়েই টারান্ট এই হামলা ও হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে, তাতে কি খুব একটা ভুল হবে?
শ্বেতাঙ্গ ও খৃস্টান শ্রেষ্ঠত্ববাদ এখন আর শুধু ধারণা ও রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নেই, তা রীতিমত সন্ত্রাসে রূপ নিয়েছে। এটা মানব সভ্যতার জন্য এক বিরাট হুমকি, যদিও ট্রাম্প তা মানতে রাজি নন। তিনি মনে করেন, এরা কখনই বিশ্বের জন্য হুমকি নয়। সভ্যতার অর্থ যদি হয়, শান্তি, উদার মানবতাবাদ, সম্প্রীতি, সহাবস্থান, সকলের নিরাপত্তা ও উন্নয়ন, তবে বলতেই হবে, শ্বেতাঙ্গ ও খৃস্টান শ্রেষ্ঠত্ববাদ তা বিনাশে উদ্যত। এখনই তা রুখে না দেয়া হলে বিশ্বের মানব মন্ডলীর মধ্যে বিদ্বেষ, সংঘাত, সহিংসতা, নিধনযজ্ঞ, রক্তপাত বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থার সৃষ্টি হবে, যখন সভ্যতা বলতে আর কিছু থাকবে না। উপসংহারে আমরা একথাই বলতে চাই, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং মিডিয়া এই শ্বেতাঙ্গ ও খৃস্টান শ্রেষ্ঠত্ববাদী সন্ত্রাসের জন্য দায়ী। তাদের বোধদয় না হলে এবং এখনই তাদের রুখে দেয়ার পদক্ষেপ না নেয়া হলে শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন দূরাগত বাঁশির রাগিনী হয়েই থাকবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।