Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপজেলা ও ডাকসু নির্বাচন এবং স্বাধীনতার মর্মবাণী

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক | প্রকাশের সময় : ১৮ মার্চ, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল রোববার ১০ মার্চ। তার পরের দিন হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের বা ডাকসু নির্বাচন। দু’টি দিনের দু’টি ভিন্নধর্মী নির্বাচনের বিশ্লেষণ পত্রপত্রিকায় পাঠক পড়েছেন, টেলিভিশনের সংবাদে এবং টকশোতে পাঠকগণ শুনেছেন। আমরা মনে রেখেছি, উপজেলা নির্বাচন এবং ডাকসু নির্বাচন দু’টির আঙ্গিক-প্রকৃতি ইত্যাদি ভিন্ন; কিন্তু তাৎপর্য একই। এ কথার একটু ব্যাখ্যা করি। উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যমে পাঁচটি বিষয় প্রকাশিত। এক. জনগণ ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। অতএব, একটি আবশ্যিক প্রশ্ন হলো, কেন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে? দুই. নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য ও আকর্ষণীয় করার জন্য, নির্বাচন কমিশন এবং সরকার উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় এক রকম এবং সেটা নেতিবাচক। তিন. ক্ষমতাসীন সরকার ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, সমগ্র জনগোষ্ঠিকে রাজনীতিবিমুখ ও গণতন্ত্রবিমুখ করে ফেলছে। চার. ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮-এর নির্বাচন যেটা ২৯ ডিসেম্বর রাত থেকে শুরু হয়ে যায়, সেই নির্বাচন প্রসঙ্গে রাজপথের বিরোধী দল যে অভিযোগগুলো করে আসছিল ও যে মন্তব্যগুলো করে আসছিল, ডাকসু নির্বাচনে সেগুলোর যথার্থতা আবারো প্রমাণ হলো। ডাকসু নির্বাচনের তাৎপর্য এরূপ: এক. সরকার শত চেষ্টা করেও নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও সততার গ্যারান্টি দিতে পারেনি। দুই. ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো ব্যালট বাক্স ভরার ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানো হয়। ওইসব তরুণ যারা বিরোধীদলের অভিযোগকে বিশ্বাস করেনি যে, সরকার রাতের বেলায় বাক্স ভরিয়ে দিয়েছিল, ওরা এখন বিশ্বাস করল। তারা দেখল যে, দিনের বেলাতেই যদি ব্যালট বাক্স ভরা যায় তাহলে রাতে কেন সম্ভব হবে না? তিন. তরুণ সম্প্রদায়ের সচেতনতা এবং গণতান্ত্রিক আচরণের প্রতি নিষ্ঠা দিবালোকের মতো পুনরায় স্পষ্ট হলো। চার. সরকারপন্থী ছাত্র সংগঠন ছাড়া বাকিদের মতামত সম্পূর্ণ অভিন্ন। অতএব, যেকোনো মূল্যায়নকারীকে বেছে নিতে হবে যে, বৃহত্তর সমাজের সরকারপন্থী অংশ যেটা আকৃতিতে ছোট সেটা ঠিক, নাকি বৃহত্তর সমাজের বৃহত্তর অংশ সঠিক। পাঁচ. বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল এবং পত্রিকা নিজস্ব নিয়মে ডাকসু নির্বাচনের কাভারেজ দিয়েছে এবং এতেই বোঝা যায়, কে সরকারের পক্ষে ‘কতটুকু কাদায় নিমজ্জিত’।
‘গণতন্ত্র’ বলতে কোনোমতেই শুধু নির্বাচন অনুষ্ঠান করাকে বোঝায় না। তারপরও গণতন্ত্রের চর্চা ও গণতান্ত্রিক কর্মকান্ডের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নির্বাচন। এই শব্দটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্যই হলো, একজন ব্যক্তির সামনে চয়েজ বা অপশন বা বাছাই করার জন্য একাধিক বিকল্প থাকবে। একজন ব্যক্তি তার পছন্দমতো কোনো ব্যক্তিকে কোনো দায়িত্বের জন্য মনোনীত করবেন। কিন্তু এবার প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল দেখলেই বোঝা যায়, কতজন উপজেলা চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হলেন, কতজন ভাইস চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হলেন। আইনের দৃষ্টিতে বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি যেহেতু সিদ্ধ, সেহেতু এটাকে আমরা বেআইনি বলতে পারছি না; আইনটি বানানোই হয়েছিল এই সংজ্ঞা বহাল রেখে। কিন্তু একটি সাদামাটা প্রশ্ন অবশ্যই উপস্থাপন করতে হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ একটি উপজেলার নাম নিচ্ছি। উপজেলার নাম ‘মঙ্গল গ্রহ’। সে উপজেলায় নৌকা মার্কা নিয়ে ‘জনাব নেপচুন’ বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হলেন। বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় এ কারণে যে, নৌকা মার্কার বিপরীতে অন্য প্রধান রাজনৈতিক দল বা দলগুলো কোনো প্রার্থী দেয়নি যেকোনো কারণেই হোক। কিন্তু এর মানে তো এটা নয় যে, মঙ্গল গ্রহ উপজেলার জনসাধারণ, নেপচুন নামক ব্যক্তিকে উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে পছন্দ করছেন! অথবা নেপচুন নামক ব্যক্তিটি উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য যোগ্য। আবার এটাও বলা যাবে না যে, মঙ্গল গ্রহ নামক উপজেলার প্রাপ্তবয়স্ক মানুষেরা বা ভোটাররা নেপচুন নামক ব্যক্তিকে পছন্দ করছেন না। আমার আলোচনা থেকে স্পষ্টতই একটি প্রশ্ন উঠে আসছে: নেপচুন নামক ব্যক্তিটির পক্ষে বা বিপক্ষে মানুষের মতামত জানার কোনো সুযোগ কি আছে? আপাতত উত্তর হলো, ‘সুযোগ নেই’। কিন্তু কেন নেই? সুযোগ না থাকার কারণ এই যে, আমাদের দেশের আইনপ্রণেতারা, আইন প্রণয়নের সময় এই সুযোগ রাখেননি। এরূপ সুযোগ রাখা আমার মতে, জরুরি ছিল। আমাদের পার্লামেন্টে তথা আমাদের দেশে চার-পাঁচ দশক ধরে যে নিয়মে আইনকানুন প্রণয়ন করা হচ্ছে, সেগুলো দেখলে বা বিশ্লেষণ করলে দুঃখজনক হলেও এটা বলা যায় যে, সেখানে দূরদর্শিতার অভাব থাকে। অসম্পূর্ণ আইন বা অদূরদর্শী আইন বা অপরিপক্ব আইন, সমাজকে অগ্রগতির পথে পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে না। তাহলে কী করণীয়? করণীয় হচ্ছে, আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়াকে উন্নত করা, আইন প্রণয়নকারীদের বাস্তবতার সাথে অধিকতর সংশ্লিষ্ট করা এবং মেধাবী ও সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের আইন প্রণয়নের সাথে সম্পৃক্ত করা। সর্বোপরি, দলীয় স্বার্থ চিন্তা না করে দেশের স্বার্থ চিন্তা করা। আজকের কলামের এ পর্যন্ত যে কয়টি অনুচ্ছেদ আছে, সে অনুচ্ছেদগুলোর আলোচনার মর্ম বা স্পিরিট গণতন্ত্র নিয়ে। গণতন্ত্রের মর্ম বা স্পিরিটের সাথে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের সম্পর্ক আছে। তাই ২০১৯ সালের মার্চ মাসে লিখিত এ কলামে এই কথাগুলো লিখলাম। এখন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির আলোচনায় ফিরে যাই।
১৯৭১ সালের মার্চ মাস ছিল উত্তাল। কিঞ্চিত স্মৃতিচারণ করেছিলাম গত কলামে। সেই কলামে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি, ভাটিয়ারীতে আমার দায়িত্ব পালনের মেয়াদে নিজে আগ্রহ এবং পৃষ্ঠপোষকতায় স্থাপিত ‘স্বাধীনতা মানচিত্র’ নামক মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভাস্কর্যের প্রসঙ্গটি এনেছিলাম। আজো আনছি। ওই ভাস্কর্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, সেখানে কোনো মনুষ্য আকৃতি, মুখের হোক বা পুরো শরীরের হোক, নেই। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, এটিকে বানানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের একটি নীরব সাক্ষী হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিভাস্কর্যে কয়েকটি আলাদা আলাদা স্তম্ভ বা বস্তু আছে। এক. প্রথম ও প্রধানটি হলো, মাটিতে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা রয়েছে ও তার মধ্যখানে সাতটি অসমান উচ্চতার স্তম্ভ আছে। সাতটি স্তম্ভ সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের প্রতীক। সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ সব মুক্তিযোদ্ধার প্রতীক। সব মুক্তিযোদ্ধা ১৯৭১-এর জনগণের সবার প্রতীক এবং দেশের সন্তান। এর মানে হলো, মুক্তিযোদ্ধাদের দেহ ও আত্মার সাথে বাংলাদেশের মাটির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। এটিকে ফুটিয়ে তোলার জন্যই, সাত স্তম্ভ বাংলাদেশের মধ্যখান থেকে উঠে এসেছে। দুই. দ্বিতীয়টি হলো, একটি বটগাছের গুঁড়ি। বাংলাদেশের জনপদে এবং গ্রামে, স্থায়িত্বের প্রতীক, প্রবীণত্বের প্রতীক, ছায়াদানের প্রতীক বটগাছ। মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন বাংলাদেশের মানুষকে ছায়াদানের প্রতীক। বটগাছ যেমন ঝড়-তুফান উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকে, তেমনই মুক্তিযোদ্ধারা দেশের প্রতি হুমকি, যত প্রকারের ঝড়-তুফান, সেগুলোকে মোকাবেলা করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। তিন. তৃতীয়টি হলো, একটি পঞ্চাশ টন ওজনের পাথর আছে। এর গায়ে খোদাই করা আছে- ‘দেশ রক্ষার শপথ যেন হয় প্রস্তর কঠিন’, তথা পাথরের মতো শক্ত। চার. চতুর্থটি হলো, ‘বীর’ শব্দটি এমনভাবে বিন্যাস করা হয়েছে, ৫৭৬ জন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার নাম এমনভাবে খোদাই করা হয়েছে এবং সাজানো হয়েছে কালো রঙের মার্বেল পাথরের খোদাই করা অংশের ওপর সাদা রঙ দিয়ে, যেন আকাশ থেকে দেখলে বাংলা ‘বীর’ শব্দটি পড়া যায়। এ দু’টি অক্ষর দৈর্ঘ্যে ১২ ফিট ও প্রস্থে ৭ ফিটের মতো। এই বীরগণ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতার প্রতীক, সব জনগণের সাহসিকতা ও ধৈর্যের প্রতীক, বাঙালি জাতির আত্মত্যাগের প্রতীক। এই স্বাধীনতা মানচিত্রের স্বপ্নদ্রষ্টা ও অকারিগরি রূপকার ১৯৯৩-১৯৯৫ সালের ব্রিগেডিয়ার সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক; এই স্বাধীনতা মানচিত্রের কারিগরি রূপকার ও আন্তরিক বাস্তবায়নকারী ভাস্কর অধ্যাপক অলক রায়।
আমি রণাঙ্গনের একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে জীবিত বা প্রস্ফুটিত রাখার জন্য যথেষ্ট উদ্যোগ পরিলক্ষিত নয়; যদিও তার ব্যাখ্যায় আজকের কলামে যাচ্ছি না। রণাঙ্গনের একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির মতো মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের প্রধান হওয়ার। এই মিলিটারি একাডেমি হলো বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীগুলোর (আর্মি, নেভি ও এয়ারফোর্স) অফিসারদের ‘প্রথম জন্মস্থান’। সেনা অফিসারদের জন্য এ জন্মস্থানটিই একমাত্র এবং দীর্ঘমেয়াদি। নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অফিসারদের জন্য, যথাক্রমে চট্টগ্রামে পতেঙ্গায় ও যশোরে ‘দ্বিতীয় জন্মস্থান’ আছে। সুযোগ ছিল বিধায় আমার আগ্রহের তাড়নায়, বিবেকের তাড়নায় এবং অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ও সহযোগিতামনস্ক সহকর্মী থাকায়, আমি বা আমরা ভাটিয়ারিতে স্বাধীনতা মানচিত্র নামক ভাস্কর্য স্থাপন করেছি। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন প্রকারের স্মৃতি বা স্মারক ভাস্কর্য আছে। কিন্তু এই ভাস্কর্যগুলো কি শুধু দর্শনীয় বস্তু? এগুলো কি শুধু মনে করিয়ে দেবে একটি মাত্র বাক্য? ওই একটি মাত্র বাক্যটি কী? তা হলো: ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল; যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা বলা হয়।’ নাকি যে তরুণ যেকোনো একটি ভাস্কর্য দেখবে, সে যেন চিন্তা করে মুক্তিযুদ্ধটি কেন হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য কী ছিল, মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য কী ছিল এবং চূড়ান্তপর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কী ছিল? ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ৭ তারিখ বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়েছিলেন ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে। সেই ঐতিহাসিক ভাষণে কিছু তাৎপর্যপূর্ণ উপাদান ছিল। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ১৯ তারিখ, তৎকালীন ঢাকা শহর থেকে ২১ মাইল উত্তরে বৃহত্তর ঢাকা জেলার জয়দেবপুর থানার সদরে ভাওয়াল রাজাদের রাজবাড়ির সন্নিকটে, জয়দেবপুরের জনগণ ও দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল; এই বিদ্রোহের তাৎপর্য ছিল অতি সুদূরপ্রসারী। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৫ তারিখ দিনের শেষে এবং ২৬ তারিখের প্রথম প্রহরে, চট্টগ্রামের ষোলোশহর ও হালিশহর, ঢাকার জয়দেবপুর, ময়মনসিংহ শহর, টাঙ্গাইল শহর, পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাই ও রাঙ্গামাটি, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট, সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট, চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী শহর, ঢাকা মহানগরের পিলখানা ও রাজারবাগ ইত্যাদি স্থানে তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালিদের আক্রমণ করে এবং বাঙালিরাও তাৎক্ষণিকভাবে বিদ্রোহ করে ও প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলে, যে যুদ্ধ ব্যাপকভাবে দেশব্যাপী বিস্তৃত হয়ে ৯ মাস ধরে চলে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৭ তারিখে তৎকালীন চট্টগ্রাম শহরের অদূরে অবস্থিত কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তদানীন্তন উপ-অধিনায়ক তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান প্রথমে নিজের নামে এবং কিঞ্চিৎ পরে সংশোধিত ও উদার ভাষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের ১০ তারিখ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের রাজধানী কলকাতা নগরীতে (প্রতীকী অর্থে ‘মুজিবনগর সরকার’ দ্বারা ‘মুজিবনগর’ থেকে) বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা সম্মিলিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ (ইংরেজি পরিভাষায় দি প্রোক্লামেশন অব ইনডিপেনডেন্স) গৃহীত, প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের ১৭ তারিখ, তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার সদর থানার সীমান্তবর্তী গ্রাম বৈদ্যনাথতলার আ¤্রকাননে, মূলত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কিন্তু সর্বদলীয়ভাবে, প্রবাসী বা মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করে (ওই স্থানের নাম বর্তমানে মুজিবনগর; উপজেলা: মুজিবনগর, জেলা: মেহেরপুর)। বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের দৈর্ঘ্য ৯ মাস তথা ২৬৬ দিন; ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখ মুক্তিযোদ্ধাদের, তথা বাংলাদেশের বিজয়ের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
যতগুলো তারিখ উল্লেখ করলাম, তার মধ্যে ১০ এপ্রিল অতি তাৎপর্যপূর্ণ। ওই দিনের প্রোক্লামেশন অব ইনডিপেনডেন্স বা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, পুরো মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চালিকাশক্তি ছিল। এটি মুক্তিযুদ্ধের পরে স্বাধীন বাংলাদেশের চালিকাশক্তি হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মাঝামাঝি অংশ থেকে কিছু কথা হুবহু উদ্ধৃত করছি। সূত্র: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান অক্টোবর ২০১১ মুদ্রণ। ‘সেহেতু বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণ কর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে, নিজেদের সমন্বয়ে যথাযথভাবে একটি গণপরিষদরূপে গঠন করিলাম এবং পারস্পরিক আলোচনা করিয়া এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম এবং তদ্বারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ইতিপূর্বে ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করিলাম, এবং...।’ তিনটি বিশেষ শব্দ বা শব্দমালার প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যথা: সাম্য, মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচার। এ তিনটি ছিল ১০ এপ্রিল ১৯৭১-এর স্বর্ণালি শব্দ তথা গোল্ডেন ওয়ার্ডস। কিন্তু ২০১৯ সালের বাংলাদেশে, সাম্য, মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচার কতটুকু আছে, এটা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আমিও করি, সম্মানিত পাঠক আপনিও করুন। যত প্রকার দর্শনীয় উন্নয়নই করি না কেন, সেই উন্নয়নগুলো কি সাম্য, মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থী হওয়া উচিত নাকি সম্পূরক হওয়া উচিত- এটি বিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। স্বাধীনতার সুফল এবং উন্নয়নের সুফল কি জনগণের ১ শতাংশ মানুষ ভোগ করা উচিত নাকি জনগণের বৃহদাংশের ভোগ করা উচিত? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে গেলে অনেক দীর্ঘ আলোচনা প্রয়োজন। অতীতে বিভিন্ন কলামে করেছি; অদূর ভবিষ্যতে বা দূর ভবিষ্যতেও করব।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নির্বাচন

২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন