পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
প্রতিবারের মতো এবারেও যাঁদের নোবেল পুরষ্কার পাবার, তাঁরা পেয়ে গেছেন। অবশ্য সাহিত্য বিভাগের হিসাবটা হয়নি। গত শতাব্দীর বিশের দশক থেকেই তো নোবেল পুরষ্কারের সমারোহ চলে আসছে বার্ষিক পার্বণের মতন- খুব কিছু আর চমক নেই। কিন্তু ২০১৮ হয়ে উঠেছে স্বতন্ত্র। স্বাতন্ত্র্য, পদার্থ বিজ্ঞানের নির্বাচনে। নোবেল পেলেন পদার্থ বিজ্ঞানে আরও দু‘জনের সাথে ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড। বিস্ময় এখানেই; একজন মহিলা পদার্থবিদ নোবেলযোগ্য হলেন ৫৫ বছর পরে। মেরি ক্যুরির পর ডোনা স্ট্রিকল্যান্ডই তৃতীয় মহিলা এই পুরস্কারের জন্য যোগ্য বিবেচিত হলেন, নোবেল পুরস্কারের প্রায় ১০০ বছরের ইতিহাস। সত্যিই কি আর কোনো মহিলা পদার্থবিদের এই যোগ্যতা ছিল না এত দীর্ঘ সময়ে?
থাকলেই তাঁর স্বীকৃতি দিতে হবে নাকি? হাজার হোক ‘মেয়েমানুষ’ বইতো নয়, সে তো সব সময়ই পুরুষের থেকে পিছিয়ে বিদ্যায়-বুদ্ধিতে, শক্তিতে-ক্ষমতায়। কারণ, এটা পুরুষের পৃথিবী। গ্রহের পাশে উপগ্রহের মতো। ফলে সে মানুষই নয় কেবলই ‘মেয়েমানুষ’, তার তো সব কিছুই কম হবে মানুষের থেকে, অধিকারও। মেয়েদের মতো, সমাজের কম অধিকারের মানুষ আরও আছে, যাদের অধিকারই অস্বীকার করা হয়। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ভাবনা চিন্তা করে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবস সনদ ঘোষণা করে। এরপর থেকে ১০ ডিসেম্বের মানবাধিকার দিবস পালিত হয়ে আসছে সব মানুষের অধিকার থাক বা না থাক। জাতিসংঘের এই ঘোষণা অবশ্যই সাধু। শুধু এই ফল ফলাবার জমিটা কীভাবে তৈরি হবে, সেই কথাটা বলা নেই, বা এই সত্তর বছরে এর জন্য কোনো নিদানও দেয়নি। ফলে, যে পৃথিবী তার ঐশ্বর্য দিয়ে, তার সমস্ত সন্তানের মুখে খাদ্য তুলে দিতে পারে, তৃষ্ণায় পানি দিতে পারে, বর্ষ-গরম-শীত থেকে রক্ষা করার মতো একটা আস্তানা করে দিতে পারে, সভ্য জগতে চলার মতো পোশাক পরাতে পারে, রোগে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারে, সর্বোপরি পারে তাকে আরও ঐশ্বর্যশালী করতে সকলের হাতে কাজের যোগান দিতে। সে পৃথিবীতেই যে পানির আর এক নাম জীবন, সে পরিশ্রুত পানীয় পানিটুকুও তৃষ্ণার্থ সন্তানের গলায় ঢেলে দিতে পারে না বিশাল এই পৃথিবী। কোটি কোটি প্রাণে জ্ঞানের আলো জ্বালাবার কথা তো বাদই দেওয়া গেল।
হিংসা-যৌন হিংসা আদিম প্রবৃত্তির একটা অসুস্থ প্রকাশ। স্নেহ-প্রেম যদি সুকুমার আবেগ হয়, হিংসা একেবারেই তার বিপরীতে। হিংসা যে কেবল মেয়েদের বিরুদ্ধেই দেখা দেয় তা-ও নয়। তবে, আর্থ-সামাজিকভাবে যাকে দুর্বল করে রাখা যায় হিংসায় তাকে বেশি ছিন্নভিন্ন করা যায়- পুড়িয়ে খাক করে ফেলা সহজ যায় এবং সে প্রশ্নে ঘর না ঘরের বাইরেটা বেশি বিপজ্জনক মেয়েদের জন্য? জাতিসংঘের তথ্য বলছে, সবচেয়ে বিপদজ্জনক পরিবার বা নিজের সঙ্গীর হাতে সারা বিশ্বে দৈনিক গড়ে ১৩৭ জন মহিলা খুন হন। ২০১৭ সালের একটি রিপোর্টে জানা যায়, ৮৭ হাজার মহিলাকে খুন হতে হয়েছে নানাভাবে ওই বছরে, যার ৫০ হাজারের মতো স্বামী-সঙ্গী বা নিকট আত্মীয়ের হাতেই প্রাণ গেছে- অর্থাৎ বিশ্বজুড়ে প্রতিঘণ্টায় ৬ জন মহিলা নিহত হয় পরিবার-পরিজন বা বন্ধু-বান্ধবের হাতে শিকার হওয়া মেয়ে তো প্রায় একটা সাধারণ ঘটনা- এর সাথে আছে সন্তান না হওয়া এবং কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়ার অপরাধ চরিত্রহীনতার অজুহাত- রুটি পুড়ে যাওয়া বা গোল না-হওয়া অর্থাৎ গৃহস্থালির ত্রুটি আর তো আছেই পরিবারের সম্মান রক্ষার নামে ‘অনার কিলিঙের’ বাহাদুরি। আছে পবিত্র প্রেমের নারকীয় অ্যাসিড আক্রমণ ও ধর্ষণও। নারীর কোনো দেশ নেই শুধু না, অভিমানে মেয়েরা তো বলতেই পারে তাদের কোনো ঘরও নেই। কারণ ঘর মানে তো কেবল ছাউনি দেওয়া চার দেয়াল না- ঘর মানে আশ্রয়, ঘর মানে শান্তি আর নিরাপত্তা।
নিরাপদ পৃথিবীতে নিরাপদ রাষ্ট্র, আর নিরাপদ রাষ্ট্রে নিরাপদ ঘরের ঠিকানা পাওয়া সম্ভব। আজকের দুনিয়ায় সে রাষ্ট্র তো বিরল থেকে বিরলতর। মেয়েদের এই পারিবারিক হিংসার আগুনে পুড়ে যাওয়া এক সাঙ্ঘাতিক সামাজিক ব্যাধির কারণে। মেয়েদের জীবনে জাতিসংঘের এই মানবাধিকার ঘোষণা তো একটা নিতান্ত ঠাট্টা। সমাজ-সংসারে পূর্ণ মানুষের স্বীকৃতি নেই মেয়েদের। মানুষ, পুরুষই। মেয়েরা যেন তাদের ছায়ামাত্র- মেয়েমানুষের ঊর্ধ্বে তাদের অস্তিত্ব নেই। তাই পুরুষ প্রধান সমাজে মেয়েরা পুরুষের অধীন- তাদের সম্পত্তি, আবার তাদের চোখে মেয়েরা যৌন সম্ভার এবং সন্তান প্রজননের যন্ত্র আর যৌনতার প্রতীক।
মানবী বিদ্যার বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ ও মতামতের ভিত্তিতে প্রস্তুত টমসন রয়টার ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক রিপোর্ট জানাচ্ছে, মেয়েদের পক্ষে সব থেকে বেশি নিরাপত্তহীন দেশ এখন ভারত ও বাংলাদেশ। আফগানিস্তান-সিরিয়া তারপরে। তৃতীয় স্থানে যে দেশ, তার নাম আমেরিকা। আমেরিকার এই শিরোপা স্বামী বা সঙ্গীদের দ্বারা ধর্ষণের কারণে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন যৌন হিংসা বা ধর্ষণ রোধের কোনো গ্যারান্টি না। মেয়েদের এভাবে মেরে ফেলায় অনুন্নত আফ্রিকা আর উন্নত আমেরিকা সমান এগিয়ে।
ডলারের স্রোতে ভাসা আমেরিকা কী ব্যাখ্যা দেবে মেয়েদের অস্তিত্বের এই বিপন্নতার, যখন তার কোনো একটি প্রদেশে মাত্র এক বছরে স্বামী বা বয়ফ্রেন্ডের গুলিতে ২৫ জন মহিলা নিহত হয়? এ বিশ্লেষণের মানে হলো, আমেরিকার পুঁজিবাদী সমাজ সংস্কৃতি- যেখানে ‘হিজ’ আর ‘হার’-এর মধ্যে মস্ত বড় দেয়াল, যেখানে একটা অনলাইন শপে, ‘কিপ কাম অ্যান্ড রেপ এ লট’ বা ‘কিপ কাম অ্যান্ড হিট হার লেখাটি মাত্র ২০ ডলারে দু’টি কেকের মতো বিক্রি হয়ে যায়। যৌন হিংসা, মুজুরি বৈষম্য- সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার অসাম্য থেকে মেয়েদের যে প্রতিপদে লিঙ্গ বৈষম্যের কাঁটা মাড়িয়ে চলতে হয় তার মূলে আছে অর্থনৈতিক হিংসা বা শোষণ। শোষণের ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে যে ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’ শুধু নিজের দেশ নয়, সারা পৃথিবীজুড়ে মার্কিন শাসকের যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লিপ্সা, যার হিংসার আগুনে ইরাক ধ্বংস হয়, সিরিয়া-লিবিয়া-প্যালেস্তাইন রক্তাক্ত হয়, সেই স্ট্যাচু আজ প্রকৃত পক্ষে পঙ্গু ও স্থবির স্বাধীনতার প্রতিমূর্তি। ট্রাম্পের গ্লামার মেয়েদের পরাধীনতা, নির্যাতন ঢেকে দিতে পারছে না। সে দেশের বৈভবের ছটা প্রসাধনী উন্নয়ন ও নারী স্বাধীনতাকে লুকিয়ে রাখতে অক্ষম।
আর এই ‘তোমাকে বঞ্চিত করে, আমিই সব দখলে রাখব’- পৃথিবীর এই প্রাচীনতম হিংসা জন্ম দিয়েছে, নারী বিদ্বেষ ছাড়াও, ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িক-সন্ত্রাসবাদী হিংসা থেকে জাতি ঘৃণা-বর্ণবিদ্বেষের। ক্ষমতাবানদের স্বার্থে এই ঘৃণা জ্বালায় হিংসার আগুন। দরিদ্রকে ধনীর এই শোষণ করাই প্রাচীনতম হিংসাত্মক সাম্প্রদায়িকতা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।