পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
পুরান ঢাকার প্রত্যেকটি কেমিক্যাল গোডাউন ও প্লাস্টিক কারখানা বছরের পর বছর ধরে একেকটি বোমার গোডাউনে পরিণত হয়ে থাকলেও এগুলো সরানোর ব্যাপারে কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি। ২০১০ সালে নিমতলী ট্র্যাজেডিতে ১২৪ জনের মৃত্যুও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়াতে পারেনি। বোমা সদৃশ কেমিক্যালের গোডাউন ও কারখানাগুলো বহাল তবিয়তেই রয়ে গেছে। এ নিয়ে অবশ্য সে সময় শিল্পমন্ত্রী, শ্রমমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন ও কর্তৃপক্ষ গোডাউনগুলো সরিয়ে নেয়ার অনুকূলে জোর বক্তব্য প্রদান করে। দেখা গেছে, তাদের এই বক্তব্য বক্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়ায়, আরেকটি ট্র্যাজেডি না ঘটা পর্যন্ত যেন অপেক্ষা করতে হবে। হয়েছেও তাই। চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। এতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৮১ জনের মৃত্যু ও দুই শতাধিক আহত হয়েছে। নিমতলী ট্র্যাজেডির পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন এর অপেক্ষায়ই ছিল। এবারও শ্রম প্রতিমন্ত্রী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রসহ অন্যান্য কর্তাব্যক্তি বক্তব্য দিয়েছেন। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। স্বরাষ্ট্র সচিব জানিয়েছেন, সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটি সাত দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেবে। শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম সরাতে তারা দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ। এখন তারা জোর পদক্ষেপ নেবেন। দেখা যাচ্ছে, নিমতলীর ট্র্যাজেডির পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও কর্তাব্যক্তিরা যে ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন, এখনও একই বক্তব্য দেয়া হচ্ছে। দেখার বিষয় হচ্ছে, পুরন ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন ও দোকান কবে সরবে এবং তা আদৌ সরে কিনা।
নিমতলী ট্র্যাজেডির পর বিশেষজ্ঞরা সতর্ক বার্তা দিয়েছিলেন, পুরান ঢাকায় একইসঙ্গে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন ব্যবহার করায় যে কোনো সময় পুনরায় এ ধরনের ট্র্যাজিক ঘটনার সূত্রপাত হতে পারে। তখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব ভবনকে বিধিবিধানের আওতায় আনা এবং আবাসিক ভবন থেকে রাসায়নিক গুদাম ও দোকান সরিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিল। প্রায় এক দশক হয়ে গেলেও তার কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। তখন রাসায়নিক গোডাউন ও কারখানা কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ওই সিদ্ধান্ত আজও বাস্তবায়িত হয়নি। এখনো জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ করতে পারেনি শিল্প মন্ত্রণালয়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এ প্রকল্প আটকে আছে বলে মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এ থেকে বোঝা যায়, আমাদের দেশে একটি দুর্ঘটনা ঘটলে তা নিয়ে কিছুদিন হইচই হয় এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তরফে প্রতিকারের নানা ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়। তারপর দিন যত গড়াতে থাকে তা চাপা পড়ে যায়। আরেকটি ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত উদ্যোগ ও সিদ্ধান্তের কথা উঠে আসে না এবং সেগুলো কোন পর্যায়ে রয়েছে তা জানা যায় না। এ ধরনের মানসিকতা যে আত্মঘাতী ছাড়া কিছুই নয়, তা বলা বাহুল্য। নিমতলীর ঘটনার পর রাজধানীর আবাসিক এলাকা থেকে অনুমোদিত রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা সরিয়ে নিতে শিল্পমন্ত্রণালয়ের এক যুগ্মসচিবের নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল। টাস্কফোর্সের সুপারিশে এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন ও বিধিমালা উপেক্ষা ও অনুমোদন ছাড়াই কিভাবে বিপজ্জনক দাহ্য পদার্থ আমদানি, উৎপাদন, মজুদ, পরিবহন ও বিক্রি হয় তা তুলে ধরা হয়েছিল। এসব বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে আরও বড় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। দুঃখের বিষয়, এসব সুপারিশ আমলে নেয়া হয়নি। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে উদাসীনতা ও শৈথিল্যের পাশাপাশি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর নির্দেশনা ব্যবসায়ীরা থোড়াই কেয়ার করে চলেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, পুরান ঢাকা যুগের পর যুগ ধরে জরাজীর্ণ ও ঘিঞ্জি এলাকা হয়ে আছে। এক প্রকার কংক্রিটের বস্তিতে পরিণত হয়েছে। এ এলাকার সংস্কার নিয়ে অনেক পরিকল্পনার কথা শোনা যায়। দেখা যাচ্ছে, এসব পরিকল্পনা পরিকল্পনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকছে। কবে বাস্তবায়িত হবে, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। এক ভয়াবহ বিপজ্জনক অবস্থার মধ্য দিয়েই সেখানে মানুষ বসবাস করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরান ঢাকার একেকটি ভবন, ‘সেল্ফ মেইড এক্সপ্লোসিভ’। তবে এই বিপদ যে শুধু পুরাতন ঢাকায় সীমাবদ্ধ, তা নয়। নতুন ঢাকাও ক্রমেই এ বিপদের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। এখন অনেক বাসা-বাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে, গাড়িতেও গ্যাস সিলিন্ডার রয়েছে। মাঝে মাঝে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আহত-নিহত হওয়ার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। বিস্ফোরণের মূল কারণ হচ্ছে, সিলিন্ডারগুলোর মেয়াদ যথাযথভাবে পরীক্ষা করা হয় না এবং তা নিরাপদ বা তদারকি করা হয় না। দিন যতই যাবে, দেখা যাবে এসব অনিরাপদ গ্যাস সিলিন্ডারও একেকটি বোমায় পরিণত হবে। ফলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরান ও নতুন ঢাকা বলে কথা নয়, বিষয়টি সার্বিকভাবে বিবেচনা করতে হবে। পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যালের গোডাউন, কারখানা যেমন সরিয়ে নিতে হবে, তেমনি গ্যাস সিলিন্ডারগুলোও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথাযথভাবে নিরাপদ করতে হবে।
পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন ও কারখানা কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ দ্রæত বাস্তবায়ন করতে হবে। একই সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে, সেখানে স্থানান্তরিত গোডাউন ও কারখানাগুলো যাতে আবার অনিরাপদ না হয়ে উঠে। আমরা দেখেছি, এক বুড়িগঙ্গার দূষণ রোধে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থানান্তরের পর সেগুলো সেখানের ধলেশ্বরী নদী, কৃষিজমি এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ দূষণ করে চলেছে। তাতে এ স্থানান্তর অনেকটা অর্থহীন হয়ে পড়েছে। কেমিক্যাল ও দাহ্য পদার্থের মতো বিপজ্জনক দ্রব্য যেখানে স্থানান্তর করা হবে, সে স্থানটি আরও বেশি নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব হওয়া প্রয়োজন। তা নাহলে সেখানেও ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থেকে যেতে পারে। আমরা আশা করব, নিমতলী ও চকবাজারের ট্র্যাজিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে আশ্বাস, প্রতিশ্রæতি নয়, অনতিবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।