পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
অনেকের মধ্যে এই জিজ্ঞাসা রয়েছে, নতুন মন্ত্রীরা কি জনপ্রত্যাশা প‚রণে তাদের দ‚রদর্শিতা, দক্ষতা, সততা ও ন্যায়পরায়ণতা প্রদর্শনে সক্ষম হবেন? চ্যালেঞ্জ গ্রহণ ও চমক প্রদর্শনে দেশব্যাপী প্রধানমন্ত্রীর অনেক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। তবে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সিদ্ধান্ত ও মেধার পরিচয় দেশব্যাপী গ্রহণীয় হয়েছে। মানুষও আশাবাদী নতুন মন্ত্রিসভা নিয়ে। বাংলাদেশকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে নতুন মন্ত্রিসভা মেধা, শ্রম আর সততার স্বাক্ষর রাখবে, এ প্রত্যাশা সবার।
সর্বাগ্রে নতুনদের স্বচ্ছতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। একই সঙ্গে সর্বসাধারণের কাছে জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতার বিষয়েও স্মরণ রাখতে হবে। দেশের উন্নয়ন দরকার, তবে গণতন্ত্রহীন বাকরুদ্ধ উন্নয়ন নয়। বাংলাদেশের সংবিধানে বহুদলীয় গণতন্ত্র স্বীকৃত। কালপ্রবাহে গণতন্ত্রের বিবর্তন হয়েছে। এসেছে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন। এবার সংসদ নির্বাচন কেমন হয়েছে তা কারোই অজানা নয়। এই নির্বাচনে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতিফলন যেভাবে হওয়া উচিত ছিল, তা হয়েছে বলে দেশের বেশির ভাগ মানুষই মনে করছে না।
আমাদের দেশে নির্বাচনে অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ অতীতে ছিল, এখনো আছে; হয়তো আগামী দিনে আরো জোরালো হবে। অতীতে নির্বাচনে সূ² ও স্থ‚ল কারচুপির অভিযোগ ছিল বহুল আলোচিত। ভোট গণনায় অনিয়ম, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের পক্ষপাতিত্ব, একজনের ভোট আরেকজন দেয়ার অভিযোগ অতীতেও ছিলো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেন্দ্র দখল করে বিশেষ প্রার্থীর পক্ষে গণহারে সিল মারার অভিযোগও পুরনো নয়। কিন্তু এবারে সারা দেশেই ভোটারদের ভোটদানে নিরুৎসাহিত করা, হুমকি-ধমকি দেওয়াসহ টিআইবির গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৫০ আসনের মধ্যে ৪১ আসনে জাল ভোট; ৪২ আসনে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর নীরব ভূমিকা; ৩৩ আসনে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল; ২১ আসনে আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো বা কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা; ৩০ আসনে বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মেরে জাল ভোট; ২৬ আসনে ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা; ২০টিতে ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার আগেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা; ২২টিতে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া; ২৯টিতে প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেওয়া, ইত্যাদি দেশব্যাপী নির্বাচনের স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
আমাদের সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হবে এবং প্রশাসনের সবপর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে।’ গণমুখী অনুচ্ছেদগুলো শুধু সংবিধানেই লিপিবদ্ধ রয়েছে; কিন্তু বাস্তব প্রয়োগ থাকছে উপেক্ষিত।
ক্ষমতাসীনরা উন্নয়ন করেছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু ভিন্নমতাবলম্বী ও সাধারণ মানুূষ যে অত্যাচারের শিকার হয়েছে তা বর্ণনাতীত। উন্নয়ন যদি মানবিকতা এবং মানবতাকে উন্নত করতে না পারে, সে উন্নয়ন কার জন্য আর কতোটা স্থায়ী হতে পারে সে প্রশ্ন মোটেই এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। দেশব্যাপী অবকাঠামোগত উন্নয়ন দিয়ে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সড়ক ও অবকাঠামোর উন্নয়ন মানেই উন্নয়ন নয়। মানুষের মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তা সবচেয়ে বড় উন্নয়নের মধ্যে পড়ে। গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ ও আইনের শাসন হতাশাব্যঞ্জক রেখে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করা যায় না।
অতীতে দুর্নীতি রোধে উদাসীনতা, দলীয় কর্মীদের অপরাধের বিচারে নিস্ক্রিয়তা ছিল লক্ষ্যণীয়। নিরপরাধ ও নির্যাতিতদের বিচার না করে বরং অপরাধীদের আশ্রয়, প্রশ্রয়, আনুক‚ল্যে ও পক্ষপাত করা হয়েছে যাতে ব্যক্তির মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। মামলা-হামলা, গুম, খুন ও বিচারবহির্ভ‚ত হত্যাকাÐের মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়েছে এক ভীতি ও ত্রাসের রাজত্ব। পরাধীন দেশে মানুষকে নির্যাতন করা হয় সবাই জানে। কিন্তু স্বাধীন দেশের মানুষ নির্যাতনের স্বীকার হবে কেন? গায়ের জোরে ক্ষমতায় থাকা গেলে আইয়ুব খানের পতন হতো না। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশের ইতিহাসও আইয়ুব খান থেকে ভিন্ন নয়। অতীতে একই মার্জিনে ও রূপে জাতীয় পার্টি, বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে। যখন যারাই ক্ষমতায় ছিলো ততদিন পর্যন্ত অন্য দল আর নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারবে না, আমাদের দেশ, সমাজ, সংস্কৃতিতে এটাই ছিল স্বাভাবিক!
সব সরকারের সময়ই হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে, ব্যাংকগুলো লুট হয়ে যাচ্ছে। দেশে সৃষ্টি হয়েছে দুর্বৃত্তায়ন ও লুণ্ঠনের অর্থনীতি। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, স্বাধীনতা পদকের সোনায় খাঁদ! স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা স্মারক হিসেবে দেওয়া ক্রেস্টে স্বর্ণ জালিয়াতি করা হয়েছিল। ৩৪৪টি ক্রেস্টে ৭ কোটি ৩ লাখ ৪৬ হাজার ২৮০ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। আমলাতন্ত্র ও শোষক ছাউনির উচ্চাভিলাষে প্রমাণ হয়েছে, মানুষের অসীম-অনন্ত চাহিদা বা নিজের কু-মানসিকতা তাকে নিয়ে যায় এক অন্ধ জগতে। নৈতিকতার অবক্ষয় সম্পর্কে কমবেশি সবাই ওয়াকিবহাল। কিন্তু সেটি কোন পর্যায়ে নেমে গেছে, তা ক্রেস্ট জালিয়াতির ঘটনা থেকে বুঝা যায়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকে পরিত্রাণ দিতে হবে জনগণকে। নতুন উদ্যোক্তা ও শিল্পপতীদের অভিযোগগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়ে তা সমাধান ও পরিত্রাণের বিকল্প ব্যবস্থা রাখতে হবে। স্বচ্ছতা, সুনিশ্চিত জবাবদিহির মাধ্যমেই উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। দেশে চলমান উন্নয়নের যে বিশাল বা মেগা প্রজেক্টগুলো আছে, এসবে খুব বেশি খরচ হয়ে যাচ্ছে এবং কাজের সময়ের সঙ্গে সমন্বয় থাকছে না। কাজ শেষ করতে দীর্ঘসূত্রতা হচ্ছে। সময় পার হয়ে যাওয়ার পর আবার সময় বাড়ানো হচ্ছে। এতে আবার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। অনেক সময় দুর্নীতির কারণে খরচ বেড়ে যায়। দুর্নীতি যে হয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সমস্ত উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে দুর্নীতির বিষয়টি জড়িয়ে আছে। এটির পরিবর্তন আনতে নতুন সরকারকে চ্যালেঞ্জ নিতে হবে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।