Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কায়েস আহমেদের ‘লাশ কাটা ঘর’ সমাজের অগ্নি আলেখ্য

মুসাফির নজরুল | প্রকাশের সময় : ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

বাংলা কথাসাহিত্যের ধারায় কায়েস আহমেদ (১৯৪৮-১৯৯২) এক অনন্য প্রতিভা। ষাটের দশকের তরুণ গল্পকারদের মধ্যে যে নিরীক্ষাপ্রবণ প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার প্রকাশ ঘটেছিল কায়েস আহমেদ ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ। দেশ, কাল, জাতি সমাজ ও মানুষের সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণ শক্তি ছিলো তীক্ষ্ন। কায়েস আহমেদ ছিলেন প্রবলভাবে সত্য সন্ধানী কথাসাহিত্যিক। ছোটগল্পের প্রচলিত ও ধরাবাঁধা ছক তার অনুসন্ধান প্রকাশের জন্য যথেষ্ঠ বিবেচিত হয় নাই। প্রকরণ ভেঙে তিনি বেরিয়ে পড়েছেন নতুন ও অনিশ্চিত পথের দিকে। তাঁর গল্পে একই বৃত্তে ঘুরপাক খাওয়া মানুষগুলোর মধ্যে কেউ কেউ নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত, কেউবা জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত, কেউবা ক্ষণিক সুখে বিভোর। অবক্ষয়বাদী সমাজ ব্যবস্থায় বেড়ে উঠা মানুষগুলো খোলা দরজা দিয়ে বেড়িয়ে এসে নিজেদের প্রকাশ করেছে কায়েসের ছোটগল্পের হাতে। আর এ কারণেই তাঁর গল্পের মানুষগুলো কৃত্রিমভাবে গড়ে ওঠেনি, তা হয়ে উঠেছে রক্তেমাংশে গড়া জীবন্ত চরিত্র। 

কায়েস আহমেদ তাঁর গল্পে ছোটগল্পের আঙ্গিকগত দিক ও তার প্রকাশরীতিতে যে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাতে তাঁর প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। দেশ, কাল, জাতি ও সমাজ মানুষের সম্পর্কে তিনি তীক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। অতীতের স্মৃতি চারণা তাঁর মধ্যে থাকলেও প্রবল নৈঃসঙ্গও তাকে তাড়া করতো। আর এ কারণেই তাঁর গল্পে একক আর বিচ্ছিন্ন মানুষেরা সারি বেঁধে ছুটে চলেছে। কিঞ্চিত সুখ অন্বেষণই তাদের এ অন্তহীন যাত্রা। এ চলা গতিময়। জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাত অন্তর্ময় বেদনা তাঁর গল্পের চরিত্রসমূহে জীবন্ত রূপ লাভ করেছে। যার প্রেক্ষিতে সমাজ বাস্তবতার চিরন্তন প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে তাঁর চরিত্রসমূহে। কায়েস আহমেদ লাভ করেছেন প্রবলভাবে সত্যসন্ধানী গল্পকারের মর্যাদা।
‘লাশ কাটা ঘর’ কায়েস আহমেদের সর্বশেষ গ্রন্থ। এ গ্রন্থে তাঁর প্রতিভার পরিণত প্রকাশ লাভ করেছে। এ গ্রন্থের বিভিন্ন গল্পের মাধ্যমে তিনি প্রতিভার পরিণত প্রকাশ লাভ করেছে। এ গ্রন্থের বিভিন্ন গ্রল্পের মাধ্যমে তিনি মানুষের নানা রকম বেদনা অশান্তিকে দেখেছেন। নানা রকম সামাজিক মূল্যবোধের নামে প্রচলিত সংস্কারকে ঝেড়ে ফেলে মানুষের মুক্তির প্রেরণা যুগিয়েছেন। দেশের রাজনীতি, সমাজ অর্থনীতি সবকিছুর বিশ্লেষণ ধরা পড়ে তাদের তৎপরতা এমনকি নীরব অবস্থানের ভিতরেও। “আমার বুকের ভেতর আতংক গুরুগুরু করে উঠছে। আমি দেখতে পাচ্ছি আমাকে একটি দেওয়ালের ধারে দাঁড় করিয়েছে, আমার সামনে একটি উদ্যত রাইফেল। আমি সেই রাইফেলের নলের দিকে তাকিয়ে ভয়ে কু’কড়ে যেতে যেতে দেওয়ালের সঙ্গে মিসে যেতে চাইছি, আর আমার মুখ দিয়ে জন্তর মতো আওয়াজ বেরুচ্ছে, সেই ভীতির মধ্যে স্বাধীনতার যে আকাংক্ষা তেমন করে স্বাধীনতাকে তুমি কখনো অনুভব করবে না।” (নচিকেতাগণ, লাশ কাটা ঘর)।
কায়েস আহমেদের ‘লাশ কাটা ঘর’ গ্রন্থে সর্বমোট চৌদ্দটি গল্প স্থান পেয়েছে। এ গ্রন্থের ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটে ও মালপদিয়ার রমনী মুখুজ্জ্যে’ রচনাটি ঠিক গল্প বলা যাবে না। রচনাটি লেখকের একটি ব্যক্তিগত ভ্রমণ বৃত্তান্তের বাণীবন্ধ রূপায়ণ। অন্য গল্পগুলো যেমন ‘পরাণ’ ‘মহাকালের খাঁড়া’ ‘দুই গায়কের গল্প’, ‘নিয়ামত আলীর জাগরণ’, ‘লাশ কাটা ঘর’, ‘গগনের চিকিৎসা’, ‘তৎপরতা’, নিরাশ্রিত অগ্নি’, প্রতীক্ষিত লন্ঠন’, ‘গোপাল কামারের তলোয়ার’, ‘নচিকেতাগণ’, ‘প্রতারক জোসনা’, ফজর আলীর গল্প’ ও ‘পরপার’ প্রভৃতি গল্পে কায়েস আহমেদের প্রতিভার পরিণত রূপ লাভ করেছে।
‘লাশকাটা ঘর’ এর প্রথম গল্প ‘পরাণ’ উত্তর-দক্ষিণে লম্বা গ্রামটির ধার ঘেঁসে যে খালটি বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে ধলেশ্বরীতে গিয়ে নেমেছে তার সঙ্গে জেলেপাড়ার মেঘলাল রাজবংশী, তরণী মাঝি ও পরেশ হালদারের একটি অন্তরঙ্গ সম্পর্ক আছে। এ গল্পে কায়েস আহমেদ অজ্ঞাত ধীবর সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন জীবনচিত্র নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন। যুগের পরিবর্তনের ফলে পৈতৃক ব্যবসায় এখন কেউ কেউ লাখপতি হয়ে উঠেছে। তারা তাদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার স্বপ্নে বিভোর। টাকার জোরে ওপাড়ার পরেশ হালদার তার ছেলেকে ঢাকা ইউনিভার্সিটির জগন্নাথ হলে রেখে ইকোনমিক্সে পড়ায়। তবে একই পাড়ার মেঘলাল, ল²ণ দাস খেয়ে পড়ে ভালো আছে। তাদের জীবন যাপনের তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। তাই মেঘলালকে দেখা যায় ঘরে বসে ছেড়া জাল সেলাই করতে। অন্যদিকে কানাইয়ের বউ আর রবীন্দ্রের বোন কাখে কলসি নিয়ে জগবন্ধু বর্মনের চাপকলে পানি আনতে যায়। নকুলের লাল-সাদা কুকুরটা খাল পেরিয়ে এ পাড়ে আসবে কিনা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবে। শ্রীমন্তর টাকুরমা ম্লান সেরে লক্ষী ঠাকুরণ প্রণাম করে ভিজে কাপড়ে বাড়ি ফেরে। ধীবর পল্লীর নিত্যদিনের যে জীবন প্রবাহ, তারমধ্যে সুখ-দুঃখ, হাসি আনন্দ সবই বিদ্যমান। এখানে জেলেদের পূজা-পার্বন, যাত্রপালা, কীর্ত্তনের আসর, চৈত্র-সংক্রান্তির মেলা-সবই আছে। “জেলের ঘরে ঘরে লাভ লোকসান, অভাব দারিদ্র্য, জন্ম-মৃত্যু বিবাহ আছে, উৎসব-আনন্দ, প্রেম-ভালোবাসা আছে। মোহনগঞ্জ, গোবিন্দগঞ্জ, ভৈরবনগর, কানাইপুরের সাতশ জেলেরা একখানা সমিতি নিয়ে একদিকে পরমেষ হালদার, ল²ণ দাস, রামপ্রসাদ, অন্যদিকে ভৈরবনগরের হরেকেষ্ট বর্মণ, ঠাকুর দাসের দলাদলি, কোন্দল-তাও আছে।” (পরাণ, লাশকাটা ঘর)।
এসবের সাথে আছে ডাকাতির উৎপাত। দেশ স্বাধীন হওয়ার দু’বছরের মধ্যে বার দশেক ডাকাতি হয়েছে এ পাড়ায়। জেলে পল্লীতে ডাকাত ঢুকে সবকিছু তছনছ করে দেয়। রাত্রিবেলা মুহুর্তের মধ্যে সবকিছু লন্ডভন্ড করে। শুরু হয় দৌঁড়াদৌঁড়ি ছুটাছুটি। জেলে পল্লীর মানুষের বুকফাটা চিৎকার গভীর রাতের নিঃস্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে যায়। ভেঙে যায় আনন্দ উৎসব। পদ্মচরণের যুবতি মেয়েকে ছো মেরে নিয়ে যায় ডাকাতরা। কিছুক্ষণ পর “পিঠে ধুলো, লুটানো আঁচল, বিবস্ত্র স্খলিত পদক্ষেপে আলোরাণী টলতে টলতে আসতে থাকে।”
কায়েস আহমেদ অত্যন্ত দরদ দিয়ে সমাজের এই নিম্ন শ্রেণির অন্ত্যজ ধীবর সম্প্রদায়ের জীবনচিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। এ গ্রল্পের কাহিনী বিন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাদ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসের কাহিনীর আবহ পরিলক্ষিত হয়। তথাপিও এ গল্পে কায়েস আহমেদের শিল্প কুশলতা ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান।
‘মহাকালের খাঁড়া’ গল্পে লেখক পশ্চিমবঙ্গের নকশালপন্থীদের নিষ্ঠুর ধনীক শ্রেণির বীভৎস্য ইতিহাসের কিয়দংশ রূপায়ণ করেছেন। এ গল্পে ভরত নামে এক মদ ব্যবসায়ীর চোরাই কারবার করে মান্যগণ্য ধনী লোক হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠার কাহিনী বিধৃত হয়েছে। এতকিছুর পরও ভরতের জীবনে নেমে আসে অশান্তি। তার ছেলে সুরেণকে দুর্বত্ত নকশালপন্থীরা হত্যা করে ফেলে রেখে যায়। নকশালদের নিষ্ঠুরতার একটা বীভৎস্য দিকের সঙ্গে পরিচিত করার জন্য হয়তবা কায়েস আহমেদ সুরেণের এ মর্মান্তিক মৃত্যুর চিত্রটি ভয়ঙ্করভাবে উপস্থাপন করেছেন।
‘নিয়ামত আলীর জাগরণ’ গল্পে নিয়তির নির্মম রসিকতার শিকার আধপাগলা নিয়ামতের জীবনের কাহিনী রূপায়ণের মাধ্যমে কায়েস আহমেদ অত্যন্ত সু²ভাবে একটি উপেক্ষিত জীবনের বেদনাদায়ক আলেখ্য রূপায়ণ করেছেন। নিজেকে ব্রিটিশ আমলের একজন প্রাক্তন সোলজার-বার্মা ফ্রন্টের জাপানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে আনন্দ অনুভব করে। সে নকশাল কতৃক ধনীদের সম্পদ লুণ্ঠনের কথা বলতে বলতে পরিমলের কাছে একটা বিড়ি চায়, পরিমল বিড়ি না দেওয়ায় সে ক্ষুব্ধ হয়। আপন মনে বকতে বকতে সে মল্লিকদের বাগানবাড়ির পুকুরঘাটে শানের উপর শুয়ে স্বপ্নের আবেশে ‘নির্ঝঞ্ঝাট বার্মা ফ্রন্টে চলে যায়’। স্বপ্নে দেখে কত কী! এমন সময় পুলিশ এসে তাকে নকশাল সন্দেহে আটক করে। তখন সে বলে ওঠে, ‘আমি নকশাল নই, স্যার আমি নিয়ামত।’ কিন্তু পুলিশ শোনে না তার কথা। প্রচন্ড ঘৃণায় নিয়ামত ওসির মুখ বরাবর বমি করে দেয়।
‘লাশকাটা ঘর’ গল্পটির কাহিনী গড়ে উঠেছে একটি বিশাল পুরোনো বাড়ির ছাড়া ছাড়া খুপড়ি ঘরে বসবাসরত কতগুলো নিন্মবিত্ত হিন্দু পরিবারের মানবেতর জীবনযাপন নিয়ে। খুপড়ির ভিতরে কম্পাউন্ডার কালিনাথ ও তার স্ত্রী গিরিবালার সংসারের নিত্যদিনের কথোপকথন-কার্যকলাপ লেখক সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এ গল্পে। অন্যদিকে আর এক বাসিন্দা মনোতাষ মাস্টার ও তার স্ত্রী জয়ার জীবনচিত্র, বাসুদেব ও সুর্বণীর জীবনের ঘটে যাওয়া কাহিনী, গিরিবালা ও তার যুবক ছেলে সুকুমারের দুঃসহ জীবনযন্ত্রণা প্রভৃতি এ গল্পের কাহিনীকে বিশেষভাবে চিত্রময় করে তুলেছে। “কালীনাথ নিঃশব্দে দরজার খিল খোলে। বাইরে এসে চারপাশে তাকায়, নিথর বাড়িটাই শুধু নিশিকান্তর শ্বাস টানার শব্দ। কালিনাথ সুরঙ্গের মুখে এসে দাঁড়ায়, তার বিভ্রম আসে, মনে হয় আরেকটু এগোলেই কঠিন কয়লার বিশাল চাংটায় ঘা খেয়ে তার নাক মুখ থেতলে যাবে। কালিনাথ হাত বাড়ায়, তার হাত অন্ধকার শূণ্যতায় কোথাও ঠাই পায় না।” (লাশকাটা ঘর)
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ধীবর পল্লী, হারিপাড়া, রাজবংশী আর ঘরুইদের ¤েøচ্ছ জীবন যাপনের যে বাস্তব ঘন ছবি তিনি এতে অঙ্কন করেছেন, তা একটি বিশেষ শিল্পব্যঞ্জনা সৃষ্ট করেছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন