শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
আলী আকবর-আওরাঙ্গজেব জৌলুসের সবশেষ ও ম্লান-মলিন প্রতিনিধি দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফর (২৪ অক্টোবর ১৭৭৫- ৭ নভেম্বর ১৮৬২)। তিনশ বছর তাঁর পূর্বপুরুষ মোঘলদের রাজত্ব ছিল বর্তমান দক্ষিণ এশিয়া তথা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিস্তির্ণ এলাকা জুড়ে। ১৮৩৭ সালে বাহাদুর শাহ্ সিংহাসনে আরোহণ করেন।
১৮৫৭ সালে ২২ জানুয়ারি ব্রিটিশ বেনিয়াদের শাসনের শতবর্ষে শুরু হয় স্বাধীনতা অর্জনের নতুন অধ্যায় বা ঐতিহাসিক সিপাহি বিদ্রোহ। সবখানে তখন শ্লোগান উঠলো:
খালক-ই খুদা, মুলক-ই বাদশাহ্, হুকুম-ই সিপাহি অর্থাৎ সৃষ্টিকুলে আল্লাহ্র সার্র্বভৌমত্ব, বাদশাহ্র রাজত্ব, সিপাহির কর্তৃত্ব।
১৮৫৭ সালে দেশপ্রেমিক সিপাহিরা বাহাদুর শাহ্কে ভারতের স্বাধীন সম্রাট ঘোষণা করে। সিপাহিরা ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে ৮২ বছরের বৃদ্ধ সম্রাটকে ‘দেওয়ান-ই খানোসে’ সম্মাননা জানায়।
বাহাদুর শাহ্ ছিলেন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতিভূ। তবে তিনি কোনো বিদ্রোহ বা যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন নি। দু’ধর্মের হাজার হাজার সিপাহি তখন স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা ব্রিটিশদের ভাষায় সিপাহি বিদ্রোহে যোগ দেয়। চার মাস পর ব্রিটিশরা এ সব স্বাধীনতা সাংগ্রামীদের স্তব্ধ করে দেয়। দমন করা হয় সিপাহি বিদ্রোহ। ব্রিটিশরা অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক, আলিম-উলামা, সুফি-দরবেশকে নির্দয়ভাবে ফাঁসিতে মৃত্যুদন্ড দেয়। তাঁদেরকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় বর্তমান বাহাদুর শাহ্ পার্কের বড় বড় গাছের ডালে। আত্মসমর্পণের পরও বিনা বিচারে মেজর উইলিয়াম হাডসন বাহাদুর শাহ্র দু’পুত্র মির্জা মোগল ও মির্জা খলিজি সুলতানকে গুলি করে হত্যা করে।
১৮৫৮ সালের ২৭ জানুয়ারি থেকে ৯ মার্চ মাত্র কয়েকদিনের প্রহসনমূলক বিচারে বাহাদুর শাহ্কে নির্বাসনে দন্ডিত করা হয়। তাঁকে দিল্লি থেকে কোলকাতা হয়ে জাহাজ যোগে পাঠানো হয় বার্মা বা ইয়াঙ্গুনে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী জিনাত মহল, দু’পুত্র, এক পুত্রবধু ও এক নাতনি। ইয়াঙ্গুনের বিখ্যাত শোয়ে ডন প্যাগোডার পূর্বপাশে ৬ জিওয়াকা সড়কের সেনাছাউনির একটি বাড়িতে বাহাদুর শাহ্ ও তাঁর স্বজনদের রাখা হয়। তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র চারটি কক্ষ।
বাহাদুর শাহ্ ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক ও সাহিত্য মনষ্ক। ঐতিহাসিক উইলিয়াম ডালরিম্পিল তাঁর ‘লাস্ট মুঘল’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘বাহাদুর শাহ্ একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। তিনি ইসলামি শিল্পরীতিতে পারদর্শী, তুখোড় কবি, এবং সুফি-পির। তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যকে খুব গুরুত্ব দিতেন’।
বাহাদুর শাহ্ ‘জাফর’ ছদ্মনামে সাহিত্য চর্চা করতেন। প্রেম ও জীবনবোধ সম্পর্কে তাঁর অনুভূতি ছিল শানিত। তাঁর বিখ্যাত গজল বা ‘মুশায়িরাত’ (কবিতাগুচ্ছ) আজো ইয়াঙ্গুনে গীত হয়। নির্বাসিত জীবনে বাহাদুর শাহ্র কাগজ কলম ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা ছিল। বন্দীশালার দেয়ালে দেয়ালে বাহাদুর শাহ্ তাঁর অনুভূতির অমর পঙক্তিমালার স্বাক্ষী রেখে গেছেন। দাঁত মাজার জন্য বন্দীশালায় রাখা কাঠকয়লা দিয়ে তিনি তাঁর কবিতাগুলো লিখেছিলেন।
নেই মোঘলদের জৌলুসের সাম্্রাজ্য। নেই তাঁদের সবশেষ প্রতিনিধি বাহাদুর শাহ্। নেই কিছুই, শুধু হারিয়ে যায়নি বাহাদুর শাহ্র কবিতা। বরং এ গুলো সময়ের অমর কীর্তিগাথা হিসেবে স্বীকৃত। জীবনের অন্তিম সময়ে এক কঠিন বাস্তবতার কল্পচিত্র রচনা করেছিলেন বাহাদুর শাহ্। মানব জীবন সম্পর্কে এ এক অনন্য আত্মোপলব্ধি। তাঁর ভাষায়:
উমর দরাজ মাঙগঁকে লায়েথে চার দিন,
দো আরজুমে কাটগায়ে, দো ইন্তেজার মেঁ।
অর্থাৎ
‘চার দিনের জন্য আয়ু নিয়ে এসেছিলাম,
দু’দিন কাটলো আকাক্সক্ষায় আর দু’দিন অপেক্ষায়’।।
অপমান, অভাব, অপরাধের মিথ্যা অপবাদ-অভিযোগ ও পক্ষাঘাতের মতো দূরারোগ্য অসুস্থতার মধ্যে অতিবাহত হয়েছে তাঁর জীবন। মোঘল আভিজাত্যের সঙ্গে মর্যাদহীন ‘সম্্রাট’ উপাধিকে উপহাস করে চরম বিষাদ-বিষন্নতায় বাহাদুর শাহ্র কঠিন উচ্চারণ:
ইয়ে মুঝে আফছার-ই-শাহানা বানায়া হোতা
ইয়ে মেরা তাজ গাদাইয়্যানা বানায়া হোতা।।
অর্থাৎ
‘আপনি আমাকে রাজাদের প্রধান করা উচিত অথবা,
পরিবর্তে আপনি আমাকে একটি মুকুট,
যা এক ভিক্ষুক পরতে পারে দেওয়া উচিত।।
দার্শনিকতা, অধ্যাত্মপ্রেম, মোঘল আভিজাত্যের সঙ্গে জীবনের অসার-অসহায়ত্ব যখন বাহাদুর শাহ্কে দারুণ মানসিক যন্ত্রণা দিচ্ছিল তখন তিনি তা প্রকাশ করলেন অনন্য উচ্চারণে:
আমি কারো চোখের আলো না,
না আমি কোনো হৃদয়ের সান্তনা করছি না
যে কেউ কখনো দরকারী হতে পারে না।
আমি যে তুচ্ছাতি তুচ্ছ, ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র,
আমার চেহারা ধ্বংস হয়েছে,
আমার প্রেমিক হারিয়ে গেছে।
আমি বসন্ত ফসল,
বাগানের যেটা তার প্রজাপতিতে ভিজে গেছে।।
৭ নভেম্বর ১৮৬২ নিভৃতচারী, নির্বাসিত, নিরপরাধ, নিঃসঙ্গ বাহাদুর শাহ্ মারা যান। স্বাধীনতাকামীদের প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় ব্রিটিশরা তাঁর মৃত্যুর খবর প্রচারে অবলম্বন করে কঠোর সতর্কতা ও গোপনীয়তা। দিল্লিতে খবর পৌঁছে তাঁর মৃত্যুর ১৫ দিন পর। তাঁর তদারকির জন্য থাকা ক্যাপ্টেন ডারিসের বর্ণনায় আছে, ‘বাহাদুর শাহ্র মৃত্যুর দিনটি ছিল শুক্রবার, সময় ভোরবেলা। ঐ দিন বিকালেই মুসলিম রীতিতে তাঁকে সমাহিত করা হয়। কবরের পাশে দেওয়া হয় বাঁশের বেড়া এবং গড়ে ওঠে ঘাসের আচ্ছাদন’।
অযতন্ড, অবহেলায় স্মৃতির অতলান্ত গভীরে হারিয়ে যাচ্ছিল সর্বশেষ মোঘল সম্্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফরের সমাধি। ১৯০৩ সালে তা শনাক্ত করা হয়। ১৯০৫ সালে ঐতিহাসিক সমাধিটি পূর্ণ ধর্মীয় মর্যাদা ও গাম্ভীর্যে সংরক্ষণের জোড় দাবির প্রেক্ষিতে ১৯০৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বাহাদুর শাহ্র সমাধি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। বাহাদুর শাহ্র সমাধিতে পাথরখোচিত স্মৃতিফলকে লেখা হয় তাঁরই পঙক্তিমালা:
কিত্না হায় বদ-নসিব ‘জাফর’
দাফন কি লিয়ে দু’গজ জমিন ভি না মিলি কু-ই-ইয়ার মেঁ।
অর্থাৎ
‘এতই হতভাগা জাফর, যে তার দাফনের প্রয়োজনে,
স্বজনের দেশে (যে জমিন সে ভালবাসত) দু’গজ মাটি-
তাও মিলল না’। বাহাদুর শাহ্
১৯৮৭ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধী, বাহাদুর শাহ্র সমাধি পরিদর্শনে গিয়ে সম্্রাটের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে পরিদর্শকদের জন্য রক্ষিত বইয়ে মন্তব্য করেন:
দু’গজ জমিন তো না মিলি হিন্দুস্তাঁ মে,
পার তেরি কুরবানি ছে উঠি আজাদি কি আওয়াজ।
বদ-নসিব তো নেহি জাফর,
জুড়া হ্যায় তেরা নাম ভারত শান আউর শওকত মে,
আজাদি কি পয়গাম ছে।।
রাজিব গান্ধীর মন্তব্যের অনুবাদ হলো: ‘হিন্দুস্তানে তুমি দু’গজ মাটি পাও নি সত্য। তবে তোমার আত্মত্যাগ থেকেই আমাদের স্বাধীনতার আওয়াজ উঠেছিল। দুর্ভাগ্য তোমার নয় জাফর, স্বাধীনতার বার্তার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের সুনাম ও গৌরবেরর সঙ্গে তোমার নাম চির স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। তার সম্পর্কে অজানা বহু তথ্য রয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।