শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
কোন জাতির জ্ঞানের জ্যোতির বিচ্চুরণ ঘটে সে দেশের সাহিত্য সংস্কৃতি ও ভাষার মাধ্যমে। লৈখ্য ভাষা আছে মানব জাতির কিন্তু কথ্য ভাষা আছে মানুষ সহ অন্যান্য প্রানীর। একটি শিশু যে সমাজে জন্ম গ্রহন করে সে সমাজের ভাষা সাহিত্য তাকে পরাধীন করে ফেলে। আর এই পরাধিনতার মধ্যেই সে স্বাধীন। মানুষের জন্ম কোন সমাজে হবে তা মানবীয় জ্ঞানের সীমানায় অতীত। এই ভাষা নিয়ে লড়াই করেছে বাঙালি জাতি এবং শহীদ হয়েছে অনেকে। যার ফলশ্রুতিতে মায়ের ভাষার মর্যাদা বিশ্বে স্বীকৃত। ২১ শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস। বাঙালি জাতি বিশ্বের বুকে এ স্বাক্ষর রেখেছে এবং তারা হীরক খন্ড, রত্ন রাজির উপরে পেয়েছে মূল্য ও মর্যাদা। বিশ্ব আজ তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। ইউনেষ্কো ২১ শে ফেব্রুয়ারি কে ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ঘোষনা করে। ৫ ডিসেম্বর ২০০৮ জাতিসংঘ সাধারন পরিষদ ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আমরা শহীদদের আত্নার মাগফিরাত কমনা করি। যে জাতি ভাষার জন্য জীবন দিতে পারে সে জাতির ভাষা ও সাহিত্য কত সমৃদ্ধ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাঙালি মুসলিম সমাজে বাংলা ভাষার কদর দেখলে আমরা বিমোহীত হই। তবে হিন্দু বাংলা এবং মুসলমান বাংলা আমরা চাই না। এই বাংলার সবাই সম স্বরে বলি আমরা সবাই বাঙালি। বিদ্যা সাগরের পূর্বে বাংলা সাহিত্যে আরবী, ফার্সি, উর্দূ, ভাষা ব্যবহৃত হত। তবে বিদ্যাসাগর আরবী, ফার্সি, উর্দূ প্রভূতি ভাষার পরিবর্তে সংস্কৃতি ভাষার প্রয়োগ করেন বেশি। ফলে সাহিত্য পটবদল হতে থাকে। তবে বাংলা সাহিত্যে শুধু হিন্দুত্ব ও মুসলিমত্ব নয় বরং উভয় সমন্বয়ে আজ একটি সমৃদ্ধ সাহিত্য। এ ব্যাপারে বলতে যেয়ে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ তাঁর-‘‘বাঙালি মুসলমানের সাহিত্যিক জাগরন’’ প্রবন্ধে বলেন-
‘‘ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে বাঙলার বৈষব সম্প্রদায় ও মুসলমানগন তাহাদের সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিগত বৈশিষ্ঠ্য ও বৈচিত্র দিয়া এই সাহিত্যকে পরিপুষ্ট না করিলে আজ মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যকে শুধু শাক্ত হিন্দুদের সাহিত্য প্রচেষ্ঠায় এত উন্নত অবস্থায় পাওয়া কখনই সম্ভব হইত না।’’
বাঙালি মুসলমানরা শুধু আরবী ফার্সি এবং উর্দূ চর্চা করেনি। তারা শুধু স্বর্গীয় দের দুতের চিন্তা এবং পরকাল নিয়ে ব্যস্ত থাকেনি। তারা সৃষ্টি করেছে এক কল্যানকর সাহিত্য সমাজ। মুসলিম সামাজের জাগরন উনিশ শতকে নব নব উদ্মদনায় সূচিত হয়। বাঙালি মুসলমান সাহিত্য জাগরন সম্পর্কে বলতে যেয়ে আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর ‘‘বাংলা সাহিত্যে মুসলমান’’ গ্রন্থে বলেন-’’(১) বাঙালি মুসলমানের সর্বযাত্রিক জাগৃতি (২) উর্দূ থেকে মুক্ত করে বাংলাকেই মাতৃভাষা হিসেবে। কালক্রমে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহন (৩) বাঙালি মুসলমান নারীর জাগরন; (৪) হিন্দু মুসলিম মিলন কামিতা। যেখানে বাঙালি হিন্দু সাধারনত বাঙালি মুসলমান বিষয়ে নিঃশব্দ অথবা বিদ্বেষী ছিলেন। সেখানে বাঙালি মুসলমান সব সময় হিন্দুর সঙ্গে একযোগে উথান কামনা করেছেন। মুসলমান সম্পাদিত সংখ্যাহীন সাময়িকপত্রে এবং মীর মশাররফ হোসেন থেকে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য সৃষ্টিতে এর সাক্ষ্য রয়েছে।’’
বাংলা এবং বাঙালির দিক দিয়ে পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম বাংলার দৈশিক পার্থক্য থাকলেও ভাষাগত তেমন পার্থক্য নেই। জাতি এবং সংস্কৃতি বর্ন অনুসারে ভাষাগত পার্থক্য লক্ষনীয় তবে আবশ্যকীয় নয়। সাহিত্যের অবনতি তখনই হবে যখন জাতিগত বিচ্ছেদ এবং ব্যবধান বৃদ্ধি পাবে এবং ভাষাগত ব্যবধান যত বৃদ্ধি পাবে সাহিত্য ক্ষেত্রে তত নিম্নগামী হবে। বাংলাদেশে আজ আছে বিচিত্র সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের মানুষ। তারা যদি বহুত্বের মধ্যে একত্ত্বের সন্ধান পায় তাহলে আমাদের জীবনের সমস্যা দ্রুত ঘূনিভূত হওয়া থেকে রেহাই পাবে। এ ব্যাপারে বলতে যেয়ে খান বাহাদুর আহছানউল্লা তাঁর ‘বঙ্গভাষা ও মুসলমান সাহিত্য-’’ প্রবন্ধে বলেন- ‘‘সমাজ সেবাই সাহিত্যের মূখ্য উদ্দেশ্য হওয়া বাঞ্চনীয়। দুঃখের বিষয়, অনেক স্থলে ইহার ব্যভিচার দৃষ্ট হয়। পাঠকের রুচিকর করিতে গিয়ে অনেক নাটক, নোবেলের অবতারনা- করিয়া ধনোপার্জনের উপর স্থির করেন। রুচি মার্জিত করাই সাহিত্যের উদ্দেশ্য, কলুষিত করা উদ্দেশ্য নহে। আমাদিগকে সাহিত্য দ্বারা ভাবী সমাজের উন্নতির পথ পরিষ্কার করিতে হইবে। বালক দিগের মনে প্রথম হইতেই ধর্ম ভাবের বীজ উত্ত করিবারে প্রয়াসী হইতে হইবে।’’
মানুষ হিসেবে জন্ম গ্রহন করলেই জীবনের স্বার্থকতা হয় না। কারন মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ প্রানী। ইন্দ্রিয় সুখ দ্বারা একটি শুকর সুখী হতে পারে। কিন্তু একটি সুখী শুকর হওয়ার চেয়ে অসূখী সক্রেটিস হওয়া বহু গুনে ভাল। মানুষের জীবনে পূর্নতা তখনই আসবে যখন সে নিজকে পরার্থে বিলিয়ে মানবতার মুক্তির কথা চিন্তা করবে। তাই তো কবি বলেন ভোগে সুখ নেই ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। এই সুখের সন্ধান পাওয়া সম্ভব নয়। কারন মানুষ স্বভাবতই কতৃত্ত্ব ও ভোগ সুখ দ্বারা তাড়িত। সে আত্ন সুখ ছাড়া বোঝে না। পরসুখের মত উপযোগবাদী মানষিকতা তৈরী হওয়া সম্ভব নয়। আর তার জন্য দরকার সত্য জ্ঞানে উদ্ভাসিত সুশীল সমাজ। কারন সত্যই সুন্দর সত্যই মুক্তি। যে ব্যক্তি সত্যের সন্ধান পায়নি তার জীবনে মুক্তি আসেনি। সে শান্তিতে থাকতে পারে না। মানুষের জীবন এখানেই শেষ নয়। তার আছে যেমন দায় দায়িত্ব তেমন আছে স্বার্থক হওয়ার প্রচেষ্টা। এই সত্য শিক্ষার দ্বার যত উন্মোচিত হবে ততই মানব সমাজ শান্তিতে ভরে যাবে।
খানবাহাদুর আহছানউল্লা তাঁর-‘‘বঙ্গভাষা ও মুসলিম সাহিত্য’- প্রবন্ধে আরো বলেন-
যদি আমরা জাতীয় ভাষা দ্বারা মনোভাব সম্যক প্রকারে আদান প্রদান করিতে সক্ষম হইতাম, হযরত ওসমানের ন্যায়পরতা, শিশু শ্রেষ্ঠ হযরত মহীউদ্দিনের সত্য প্রিয়তা, হযরত এনাম হোসেনের ধৈর্য্য ও প্রতিজ্ঞা, হযরত ওয়ায়েস করনীয় গুরুভক্তি, হযরত গাজ্জালির পন্ডিত্য, হযরত রাবেয়ার ঐশী প্রেম সর্বদা মনে জাগরুক দেখিতাম ও তাঁহাদের দৃষ্টান্ত অনুসরন করিতে প্রয়াসী হইতাম তবেই আমাদের শিক্ষা পূর্ণত্ব প্রাপ্ত হইত। তবেই আমরা মানব নামের বাচ্য হইতে পারিতাম। আমাদের ফরম আছে স্প্রীট নাই। আমাদের দেহ আছে শক্তি নাই, আচার আছে ভক্তি নাই। শিক্ষা আছে জ্ঞান নাই।’’
ধর্ম ও মতদর্শ আসছে মানুষের মুক্তির জন্য তবে সত্য মতদর্শে বিভেদের স্থান নেই। মানুষের ভিতর যারা বিভক্তি করেন তারা সত্যকার অর্থে মানব প্রজাতির সদস্য ভাবা যায় না। এবং যার মাধ্যমে উন্নতি সম্ভব নয়। তার দ্বারা খন্ডিত মুক্তির সম্ভাবনা থাকতে পারে কিন্তু মানুষের সার্বিক মুক্তির চিন্তা সুদূর পরাহত। আমরা মানব জাতির জীবনের অন্ধকার মোড়ে মোড়ে আলোর ঝলকানি দেখতে চাই নয়তো একটা সম্ভাবনাময় বিশ্ব অন্ধকার অতলে চলে যাবে। মুসলিম সাহিত্য সমাজের উচিত এই মশাল প্রজ্বলিত রাখা। যে ত্যাগ, তিতিক্ষা, ধৈর্য্য ও অধ্যাবসায় দরকার তার প্রতি অবিচল থাকা একমাত্র তাদের পক্ষে সম্ভব যারা মুক্তিকামী জনতা। এর জন্য মুক্ত বুদ্ধির যুদ্ধ আবশ্যক। আর যার স্থান ভাষা ও সাহিত্যে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।