পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
অনেক দিন পর সুকুমার রায়ের ‘বাবুরাম সাপুড়ে’ ছড়াটি মনে পড়ে গেল। ছোটদের জন্যে লেখা হলেও দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ছড়াটি গভীর অর্থবহতা ধারণ করছে। সব নির্বাচনের আগে পর্যবেক্ষকদের বিধিনিষেধ মেনে চলার কিছু নির্দেশনা দিয়ে থাকে নির্বাচন কমিশন। তবে এবার নির্দেশনার মধ্যে কিছু অবাক হওয়ার মতো বিষয় রয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলছে, পর্যবেক্ষকদের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে হবে। গণমাধ্যমের সঙ্গে পর্যবেক্ষকেরা কথা বলতে পারবেন না, কোনো মন্তব্য করতে পারবেন না। নির্বাচন শেষে একটি প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। এ ছাড়াও বলা হয়েছে, পর্যবেক্ষকেরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না, ইত্যাদি। বর্তমান নির্বাচন কমিশন পর্যবেক্ষকদের বিধিনিষেধ মেনে চলার এসব নির্দেশনা দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যদি তাই হয়, তাহলে তারা স্বেচ্ছায় নিজেদের সুকুমার রায়ের ছড়া ‘বাবুরাম সাপুড়ে’র নিরীহ প্রাণীতে পরিণত হবেন। পর্যবেক্ষকেরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না, এটি কি গ্রহণযোগ্য? ভোটকেন্দ্র থেকে তথ্য পাঠানো ও যোগাযোগ করতে মোবাইল ফোন লাগেই। মোবাইল ছাড়া পর্যবেক্ষকদের কাজটা কঠিনতো বটেই, সম্ভব হবে কিনা সেখানেও প্রশ্ন রয়েছে। পর্যবেক্ষকদের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের এমন বক্তব্যে নির্বাচন নিয়ে আস্থাহীনতার জায়গা তৈরি হবে নাতো? পর্যবেক্ষকদের নিরপেক্ষ থাকতে হবে একথা সত্য। তবে নির্বাচন কমিশন এবার যেভাবে নিরপেক্ষ থাকার কথাটি বলেছে, তা সবার মনে সংশয় জাগিয়েছে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি বাধ্যবাধকতার আনুষ্ঠানিকতা হয়, তাহলে হয়তো সংবিধান রক্ষা হবে, নিয়ম রক্ষা হবে, ক্ষমতা রক্ষা হবে, কিন্তু গণতন্ত্র কি রক্ষা হবে? জনগণের ভোট দেয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার কি রক্ষা হবে? নির্বাচন হয়তো শুধু অংশগ্রহণমূলক হবে। অবাধ হবে কি? এসব প্রশ্নে সর্বসাধারণের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার শেষ নেই। গত মেয়াদের গণতান্ত্রিক বৈধতার ঘাটতির কারণে সাধারণের মধ্যে ধারণা জন্মেছে, ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা ছাড়তে প্রস্তুত নন। এজন্য নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও তা অবাধ ও গ্রহণযোগ্য না হলে কমিশনকে তাদের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের দায় বহন করতে হবে। নির্বাচন অতি সন্নিকটে হলেও নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর জন্য যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়নি, তা এখনও দৃশ্যমান। ক্ষমতাসীন জোটের শরিকেরা যে ধরনের সুবিধা ভোগ করছে, বিরোধীরা এখনো ততোটাই প্রতিক‚লতার মুখোমুখি হচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে খোদ নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে যদি প্রশ্ন ওঠে তাহলে এ ধরনের পক্ষপাতমূলক আচরণ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক হবে না। সুষ্ঠু নির্বাচন করতে কমিশন যে আগ্রহী, তাদের আচরণে সেটা প্রমাণ করতে হবে।
প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কোনোটিই এবার নির্বাচন বর্জনের কথা ভাবছে না। বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলো কিছুদিন আগেও ঘোষণা দিয়েছিল, নির্বাচন কমিশনের প্রতি তাদের আস্থা নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়, এ শর্তও তাদের ছিল। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্ন আসে না- এ দাবি থেকেও তারা সরে এসেছে। ঐক্যফ্রন্টসমেত বিএনপি নির্বাচনে আসায় ক্ষমতাসীনদের একটি শক্তিশালী নির্বাচনী প্রতিপক্ষ তৈরি হয়েছে, তা স্পষ্ট । এই নির্বাচন অতীতের যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে ভিন্ন। নির্বাচনের আগে ও পরে শান্তি বজায় থাকবে তো? নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে তার প্রতিক্রিয়া হবে অনাকাক্সিক্ষত এবং সবার জন্যই ক্ষতিকর। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের আশঙ্কা, নির্বাচনের মাঠে প্রভাব বজায় রাখতে সব দলই নিজেদের শক্তির মহড়া দিতে পারে। এই সুযোগে নতুন করে মাঠে নামতে পারে পেশিশক্তি ও অপরাধীচক্র। স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচনের আগে-পরে বড় ধরনের সংঘাত-সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে জনমনে। সকলের অংশগ্রহণের পরেও নির্বাচন যদি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন না হয়, তাহলে অনিয়মের অভিযোগে নির্বাচন পরবর্তী সময়টা দেশের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি ডেকে আনবে। বিএনপি নির্বাচনকে এবার আন্দোলনের অংশ হিসেবেই নিয়েছে। নির্বাচনে কোনো রকম কারচুপি হলে সবাই যে বিক্ষোভে জড়িয়ে পড়বে, এটা অনেকটাই অনুধাবন করা যাচ্ছে।
ক্ষমতাসীন থেকে নির্বাচনে যারা প্রতিদ্ব›িদ্বতা করছেন তাদের লক্ষ্য হবে নিজেরা অতিরিক্ত সুবিধা নেওয়া এবং ক্ষমতাহীনদের নাজুক অবস্থায় রাখা। এই লক্ষ্যই নির্বাচনে প্রতিদ্ব›দ্বী পক্ষগুলোর জন্য সমসুবিধা ও লেভেল প্লেয়িং নিশ্চিত হওয়ার প্রতিবন্ধক। ইসিকে সেই প্রতিবন্ধকতা দূর করার চেষ্টা, ইচ্ছা ও প্রমাণ দেখাতে হবে। বিশেষ করে নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে তার ক্ষমতার যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। নির্বাচন কমিশন ও রিটার্নিং কর্মকর্তারা কোনো প্রার্থী ও দলকে প্রতিপক্ষ হিসেবে নেবেন না। আইনের মধ্যে থেকে তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। কমিশনের কোনো কাজ যদি ভোটারদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে তাহলে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বর্তমানে সংসদ সদস্য পদে থেকে নির্বাচনে লড়ার সুযোগ পাচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যরা। ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার, অবৈধ সুযোগ নেয়া এবং প্রতিদ্ব›দ্বীদের নাস্তানাবুদ করার কোনো সুযোগ যেন না নিতে পারে নির্বাচন কমিশনকে তা ঠেকাবার জন্য কঠোর হতে হবে। নির্বাচনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাঠ প্রশাসনসহ পুলিশ প্রশাসনও সরকারের সাজানো। এ কথা মনে করার কারণ নেই যে, ভোটাররা এসব লক্ষ করছেন না। সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে যেসব সংশয় তৈরি হচ্ছে, সেগুলোকে অবজ্ঞা করা কমিশনের জন্য বিবেচকের কাজ হবে না। একাদশ সংসদ নির্বাচন যে সুষ্ঠু হবে না তার অনেক আলামত প্রকটভাবে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। নির্বাচন আয়োজনে সব দলের জন্য কমিশনের সমসুযোগ সৃষ্টিতে ব্যর্থতা প্রতিষ্ঠানটির প্রতি আস্থা তৈরির বদলে সংশয়ের জন্ম দেবে।
প্রশাসন ও পুলিশে দলীয়করণের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। যেকোনো সরকারের বেলায় এই অভিযোগ ওঠে। অতীতে নির্বাচনের আগে স্থানীয় প্রশাসনে পরিবর্তন করার উদ্যোগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারই গ্রহণ করেছিল। নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হওয়ার পর এই দফায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার না থাকায় সে দায়িত্ব বর্তেছে কমিশনের ওপর। নির্বাচনে নিযুক্ত প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও পোলিং কর্মকর্তাদের সম্পর্কে পুলিশের তথ্য সংগ্রহ ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অনুসন্ধান করার খবরটি শুধু উদ্বেগজনক নয়, এখতিয়ারবহির্ভূত। এ ঘটনায় নির্বাচনকে নতুনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। নির্বাচন কর্মকর্তাদের বিষয়ে পুলিশ যে অননুমোদিত এবং বেআইনি অনুসন্ধান চালিয়েছে তা স্পষ্ট। নির্বাচন কর্মকর্তাদের সম্পর্কে পুলিশের গোয়েন্দাগিরির কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে? পুলিশের অহেতুক নাক গলানোই প্রমাণ করছে, তারা নির্দিষ্ট কারো উদ্দেশ্য হাসিলের পাঁয়তারা করছেন! কমিশন যদি বলতে চায়, তার অজ্ঞাতেই পুলিশ ও প্রশাসন এ ব্যবস্থা নিয়েছে; তাহলে তার অর্থ হচ্ছে তফসিল ঘোষণার পরে প্রশাসনের ওপরে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
তফসিল ঘোষণার পর সরকারের জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুরোপুরি নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারে। ইসির আদেশ বা নির্দেশের বাইরে তারা যেতে পারে না। কিন্তু প্রকাশিত খবর থেকে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে, ইসিকেই তারা পরিচালিত করতে চাইছে। ইসি কাকে নির্বাচনের দায়িত্ব দেবে, কাকে দেবে না, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। তারপরও যদি কারো সম্পর্কে কোনো অভিযোগ আসে, তারা বড় জোর নির্বাচন কমিশন কিংবা রিটার্নিং কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানাতে পারে। এরপর কমিশন যদি মনে করে কারো বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া প্রয়োজন, সে ব্যবস্থা তারা নেবে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক জোট ও দলের হয়ে মনোনয়ন চাইছেন ১২ হাজারেরও বেশি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর অনুষ্ঠিত ১০টি জাতীয় সংসদের কোনোটিতেই এত সংখ্যক ব্যক্তি প্রার্থী হতে আগ্রহ প্রকাশ করেননি। রাজনীতির অঙ্গনে দীর্ঘদিন সক্রিয়, এমন ব্যক্তিরা মনোনয়ন চাইবেন, এটা স্বাভাবিক। কালোটাকা ও পেশিশক্তির জোর আছে, এ কারণেও কিছু ব্যক্তি বড় দলের মনোনয়ন লাভে মরিয়া। সেদিকেও ইসিকে খেয়াল রাখতে হবে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।