Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অসমতল মাঠ এবং নির্বাচনী অনিশ্চয়তা

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২৮ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

দায়সারা গোছের রাজনৈতিক সংলাপে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা দাবীর কোনো দাবি মেনে না নেয়া সত্তে¡ও আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে ২০দলীয় ঐক্যজোটসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। জাতীয় সংলাপের ধারাবাহিকতায় নির্বাচনের তফসিল পিছিয়ে দেয়ার দাবী ও বাস্তবতা অগ্রাহ্য করে গত ৭ নভেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হওয়ার পর ইতিমধ্যে প্রায় ৩ সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনো নির্বাচন নিয়ে নানাবিধ সংশয় ও অনিশ্চয়তা কাটেনি। নির্বাচনের পরিবেশ-পরিস্থিতি এখনো ক্ষমতাসীন দলের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে। ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ বলে কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রীর সংলাপে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলার তালিকা চাওয়া হয়েছিল। নেতাকর্মীদের ধরপাকড় করা হবে না বলে আশ্বস্ত করা হলেও নির্বাচনে অংশগ্রহণের যোঘণা নিশ্চিত করার পর নতুন মামলা ও ধরপাকড়ের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ঢাকায় দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে এসে যশোরের বিএনপির এক নেতা গুম হওয়ার পর বুড়িগঙ্গা নদীতে তাঁর লাশ পাওয়া গেছে। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)বলছেন. নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে এবং ইসির নির্দেশ ছাড়া পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করছেনা। তাহলে বিএনপি’র পক্ষ থেকে সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া বিএনপি নেতাদের যে তালিকা কয়েক দফায় নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া হয়েছে, তারা কি নির্বাচন কমিশনের নির্দেশেই গ্রেফতার হয়েছেন? নির্বাচন কমিশনের দাবীর প্রেক্ষিতেই এই প্রশ্ন উঠে আসে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড মানে সব রাজনৈতিক দলের জন্য সমান সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করা। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের সময় মাঠ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা নির্বাচন কমিশনের আ্ওতায় পরিচালিত হওয়ার কথা। ক্ষমতাসীন মন্ত্রী-এমপিরা এমনভাবে রুটিন ওয়ার্ক করবেন যেন নির্বাচনী আচরণ বিধির লঙ্ঘন না হয়। ক্ষমতার চর্চা যেন তাদেরকে নির্বাচনে প্রতিপক্ষ প্রার্থীদের চেয়ে বাড়তি সুবিধা না দেয়, সেদিকে বিশেষ নজর রাখা নির্বাচন কমিশনের দায়ীত্ব। নির্বাচনের তফসিল ঘোষনার শুরুতেই নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ জনসমক্ষে ধরা পড়ে। নির্বাচনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করার সময় কোন প্রার্থী জনসমাবেশ বা শো-ডাউন করতে পারবে না মর্মে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি একটি চিঠি ইস্যু করার পরও ধানমন্ডিতে একাধিক রাস্তা বন্ধ করে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন প্রত্যাশিরা শুধু শো-ডাউনই করেনি, তাদের অন্তর্দলীয় কোন্দলে দুই কিশোরের মৃত্যু হওয়ার পরও নির্বাচন কমিশন দৃশ্যত কোন পদক্ষেপই নেয়নি। কিন্তু ১২ নভেম্বর থেকে বিএনপির মনোনয়ন বিক্রিতে অভাবনীয় সাড়া এবং দলীয় কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় লাখো মানুষের শান্তিপূর্ণ জমায়েত ও সহাবস্থানের উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টির পর নির্বাচন কমিশন যেন কিছুটা বেচইন হয়ে পড়ে। মাত্র তিনদিনের মাথায় কমিশন দলীয় প্রার্থীদের শোডাউন সংক্রান্ত আচরণ বিধি স্মরণ করিয়ে দিয়ে আরেকটি চিঠি দেয়ার পর বদলে যায় দৃশ্যপট। পরেরদিন সকালেই নয়াপল্টনের রাস্তা থেকে বিএনপি নেতাকর্মীদের সরিয়ে দিতে যুদ্ধংদেহি ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়, নয়াপল্টনে বিএনপি অফিসের রাস্তাটি বন্ধ থাকলেও আরো অন্তত ৩টি বিকল্প রাস্তা থাকায় এবং মনোনয়নপত্র বিক্রির ধার্য তারিখের ১দিন বাকি থাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য ১৩ তারিখের অপ্রীতির ঘটনা ছিল খুবই অপ্রত্যাশিত। যেখানে সরকারীদলের নেতাকর্মীদের নিবৃত্ত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলপ্রয়োগ করেনি, বিএনপির নেতামর্কীরাও পরপর ২দিন নির্বিঘে শান্তিপূর্ণ জমায়েত বজায় রেখেছিল, সেখানে নির্বাচন কমিশনের দ্বিতীয় পত্রটিকে গুরুত্ব দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাধারণ মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, তাদের কাছে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা সরকারী দল ও বিরোধিদলের জন্য সমান নয়। এরপরও সরকারীদলের মন্ত্রী এমপিরা বিএনপি নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করছেন। অন্যদিকে বিএনপি নেতারাও আওয়ামী লীগ নির্বাচন থেকে পিছু হইতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
ক্ষমতাসীন সরকার, নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনের ভ‚মিকা এখনো নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের অনুকুল নয়। প্রধানমন্ত্রীর সরকারী কার্যালয় গণভবনকে আওয়ামীলীগের নির্বাচনী কার্যালয়ে পরিনত করা হয়েছে বলে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের তরফ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান ও সংসদীয় দলের নেতা যখন একই ব্যক্তি, তখন সংসদ ও মন্ত্রী পরিষদ অক্ষুন্ন রেখে নির্বাচনে সব দলের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা দুরূহ ব্যাপার। তবে নির্বাচন কমিশন তার সাংবিধানিক ক্ষমতা এবং নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্য অর্জনে কাজ করলে সরকারী ক্ষমতার দলীয় ব্যবহার রোধের মাধ্যমে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ও জনগনের আস্থা প্রতিষ্ঠিত করা হয়তো অসম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীল ভ‚মিকার পাশাপাশি নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও বিচার বিভাগের নিরপেক্ষ ও দায়িত্বশীল ভ‚মিকা থাকতে হয়। বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যত ভেঙ্গে পড়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ এবং সিটি কর্পোরেশনের মত স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে সরকার, নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ন্যুনতম গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে। দলীয় প্রতিকে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় ব্যক্তির চেয়ে প্রতিক অনেক বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণেই ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের শক্ত প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতেই পারেনি বলে অভিযোগ উঠেছিল। যারা মনোনয়নপত্র জমা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাদেরকে স্বাভাবিক নির্বাচনী কার্যক্রম চালাতে এবং সম্ভাব্য পোলিং এজেন্টদের ধরপাকড়, ভয়ভীতির মাধ্যমে নিস্ক্রিয় করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বাত্মক প্রয়াস দেখা গেছে। বিনা ভোটের এমপি-মন্ত্রী থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের দলীয় জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের নিজস্ব প্রভাব কাজে লাগাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন থেকে জারি করা এ সংক্রান্ত একটি পরিপত্রে স্থানীয় পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বার ও মেয়র-কাউন্সিলররা নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে তাদের পরিচয় ও সরকারী সুযোগ সুবিধা ব্যবহার করতে পারবেন না মর্মে একটি নির্দেশনা জারি করেছে বলে জানা যায়। তবে শুধু নির্দেশনা জারি করেই নির্বাচন কমিশন যদি তাদের দায়িত্ব শেষ করেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচনী কর্মকর্তারা যদি দলীয় প্রভাবমুক্ত না হয় তবে এসব স্থানীয় প্রভাবশালীদের ভোটকেন্দ্রে প্রভাববিস্তার থেকে নিবৃত্ত করবে কে? আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি এখনো অনিশ্চিত। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিরোধি জোটের দাবী-দাওয়া অগ্রাহ্য করা এবং নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের আলামত দেখে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে অনীহা প্রকাশ করা হয়েছে। আল জাজিরার মত আন্তজার্তিক গণমাধ্যম বাংলাদেশে একটি ‘ম্যানেজড ইলেকনের’ আলামত দেখা যাচ্ছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরীতে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখার কথা থাকলেও নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পরও আমাদের বিটিভিসহ বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সরকারী দলের পক্ষে একতরফা প্রচারণাই চলছে। সরকারীদলের নেতা-কর্মী ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের নানা ধরনের ব্যানার, পোষ্টার ও ফেস্টুনে ছেয়ে আছে সারাদেশের দেয়াল। তফশিল ঘোষণার পর এসব অপসারণের বাধ্য বাধকতা থাকলেও এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের তেমন কোন গরজ দেখা যাচ্ছে না। ক্ষমতাসীনদের বাড়তি সুবিধা ও অতিতৎপরতা বহাল রেখে নির্বাচনের সমতল মাঠ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অক্ষমতা-অদক্ষতা ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। বিগত বেশ কয়েকটি নির্বাচনের দিকে পুরো জাতি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। সর্বশেষ ৫ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের প্রকৃত অবস্থা কি ছিল তা সকলেই জানে। নির্বাচনের মাঠে বিরোধিদলের হাজার হাজার নেতাকর্মী সক্রিয় থাকলেও শেষ পর্যন্ত অনেক ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্টরাও যেতে পারেনি। বরিশাল, খুলনা, রাজশাহীতে নৌকা প্রতিকের মেয়র প্রার্থী ছাড়া প্রায় সবদলের মেয়র প্রার্থীরা নির্বাচনের মাঠ ত্যাগ করতে বা বর্জন করতে বাধ্য হয়। ফ্রি-স্টাইলে কেন্দ্র দখল ও নৌকায় সিল মেরে বাক্স বোঝাই করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এভাবে নৌকার বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার সংবাদ সম্মেলন ডেকে সুষ্ঠু ও সংঘাতহীন পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সরকারীদলের জবরদস্তির নির্বাচনের পর সিইসি নির্বিকার থাকলেও বলা যেত যে, তিনি হয়তো সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাবের কাছে অসহায়। নিরবতা ও অসন্তোষ প্রকাশেরও কিছু দেহভঙ্গি আছে যা সাধারণ মানুষও বুঝতে পারে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনেও এমন দু’য়েকজন সদস্য আছেন যারা বিগত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ এবং আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে সিইসির সাথে সুস্পষ্টভাবে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন। বিশেষত: নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার একাধিকবার নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে কমিশনের বৈঠক থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজের আপসহীন ভ‚মিকা জাতির সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে এবারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে জনগনের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়া এবং নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার নির্বাচন বলে উল্লেখ করেছেন। নির্বাচন কমিশনের ডাকা সংলাপে অংশহ্রজনকারী অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সঙ্গত কারণেই নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিপক্ষে মত দিয়েছিল। এরপরও হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ইভিএম মেশিন ক্রয় এবং নির্বাচনে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন কমিশন। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের আপত্তিও আমলে নেয়নি ইসি। তবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের তীব্র বিরোধিতার মুখে এখন ৬টি আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, রির্টানিং অফিসার তথা জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের প্রতি দিক নির্দেশনামূলক একাধিক বৈঠক করেছেন নির্বাচন কমিশন।এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে বিশেষ বৈঠক করেছে নির্বাচন কমিশন। সেই বৈঠকে সিইসি এবং নির্বাচন কমিশনের অন্য সদস্যদের গতানুগতিক বা দায়সারা ভ’মিকায় দেখা গেলে ব্যতিক্রমী ভ‚মিকায় দেখা গেছে কমিশনার মাহবুব তালুকদারকে। সভায় তাঁর দেয়া লিখিত বক্তব্যটি ‘গায়েবি মামলা গায়েবি আওয়াজ নয়’ শিরোনামে ২৫ নভেম্বর দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুত্রে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের সুত্রে মাহবুব তালুকদার নির্বাচনী কর্মকর্তা হিসেবে এবং সাম্প্রতিক সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজের অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশার ঢালি কিছুটা মেলে ধরেছেন। বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে একক দায়িত্বে থাকার অভিজ্ঞতায় নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা, নির্বাচন কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষপাত ও নির্লিপ্ততার সবিশদ বর্ননা দিয়ে তিনি আক্ষেপ করে প্রশ্ন রেখেছেন, নির্বাচনে অনিয়ম সম্পর্কে হাজার হাজার পৃষ্ঠার সংযুক্ত ডকুমেন্টসসহ একাত্তর পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্টটি আলোর মুখ দেখেনি। দলীয় প্রতিকে অংশগ্রহণমূলক স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সংঘটিত অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা থেকে শিক্ষা নিয়ে নির্বাচন কমিশন হয়তো বা জাতীয় নির্বাচনে এমন সব আশঙ্কা দূর করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারতো। কিন্তু কোন সংঘাত বা প্রাণহানি ছাড়াই সিল মেরে, বিরোধিদলের পোলিং এজেন্ট ও নেতা-কর্মীদের তাড়িয়ে দিয়ে নির্বাচনী বৈতরনী পার হওয়ার ঘটনাকেই সফলতা হিসেবে দাবী করেছে নির্বাচন কমিশন
খুলনা ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বøুম বার্নিকাট ও স্টেট ডিপার্টমেন্ট কোন রকম ক‚টনৈতিক রাখঢাক ছাড়াই নির্বাচনে অনিয়ম-বিশৃঙ্খলার প্রসঙ্গ তুলে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। তবে নির্বাচনে ভায়োলেন্স বা সংঘাত কমে আসায় নির্বাচন কমিশনসহ ক‚টনৈতিক মহলে প্রসংশিত হলেও কোন বাস্তব পরিস্থিতিতে ভোটকেন্দ্র দখল ও সিলমেরে বাক্স বোঝাই করার পরও ভোটকেন্দ্রে সংঘাত সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। যে পুলিশ শত শত গায়েবী মামলা দিয়ে বিরোধিদলের নেতাকর্মীদের ধরপাকড় করছে, নির্বাচনের দেড়মাস আগেই নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা ছাড়া অতি উৎসাহী হয়ে সম্ভাব্য প্রিজাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসারদের তথ্য সংগ্রহ করছে তাদের দিয়ে নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভ‚মিকা পালন করা কতটা সম্ভব তা সহজেই অনুমেয়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অধিকাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর নির্বাচনের দিন অধিকাংশ ভোটকেন্দ্র ছিল ফাঁকা, ভোটারশূন্য। সুনসান নিরবতায় ভোটকেন্দ্রের সামনে কুুকুর শুয়ে থাকার দৃশ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। ভোটার উপস্থিতি না থাকায় কোথাও কোথাও ব্যালট বইয়ে সিলমেরে বাক্স বোঝাই করার দৃশ্যও গণমাধ্যমে উঠে এসেছিল। এসব দৃশ্য ও তথ্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে বিব্রত করে। তারা আর এমন বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে চান না। এ থেকে উত্তরণের দ’ুটি পথ খোলা আছে প্রথমত: নির্বাচনে সব দলের জন্য সমান সুযোগ ও প্রশাসনের পক্ষপাতহীন ভ‚মিকা নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত: নির্বাচনে অনিয়ম, দখলবাজি, ভোট ডাকাতি ও জালিয়াতির দৃশ্য এবং খবর যেন গণমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকরা দেখতে এবং প্রকাশ করতে না পারে, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আয়োজনে নির্বাচন কমিশন কি এখন দ্বিতীয় কৌশলটি বাস্তবায়নের পথে হাঁটছে? নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা এবং নির্বাচনকে ভোটার এবং বিরোধি রাজনৈতিক দলের কাছে স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে আস্থায় আনার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের বদলে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নিরুৎসাহিত করা এবং অদ্ভুত সব বিধি নিষেধ আরোপের ফরমান জারি করে গণমাধ্যমকে কার্যত ঠুটো জগন্নাথে পরিনত করার পদক্ষেপ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষন করতে আসছে না বলে ইতিমধ্যে তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। অথচ গত ৫ বছর ধরেই তারা বাংলাদেশে একটি ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড পারটিসিপেটরি ইলেকশনের তাগিদ দিয়ে আসছে। তবে নির্বাচন পর্যবেক্ষনে ইউরোপীয় নীতি হচ্ছে, যে দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সে দেশের সরকার এবং এবং নির্বাচন কমিশন যদি সত্যিকার অর্থেই ক্রেডিবল ইলেকশন করতে চায় তবেই নির্বাচন পর্যবেক্ষনের জন্য তাদেরকে আহ্বান জানাবে। এ ক্ষেত্রে ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঘোষনার মধ্য দিয়েই নির্বাচন কমিশন প্রমান করেছেন তারা পশ্চিমা নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের ব্যাপারে তেমন সিরিয়াস নয়। ক্রিসমাস এবং ইংরেজী নববর্ষ উপলক্ষে যে সময়ে পশ্চিমারা বিশেষ ছুটি কাটাতে অভ্যস্থ, ঠিক সে সময় বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের তারিখ নির্ধার করার অর্থই হচ্ছে পরোক্ষভাবে পশ্চিমা নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের অগ্রাহ্য করা। নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দিন বলেছেন, গণমাধ্যমকর্মী এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা ভোটকেন্দ্রে মোবাইল ফোন বা ক্যামেরা ব্যবহার করতে পারবে না। প্রিজাইডিং অফিসারের অনুমতি ছাড়া ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারবে না। ভোটকেন্দ্রে যাই ঘটুক এ বিষয়ে কাউকে প্রশ্ন করতে বা কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন না। তাদেরকে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে হবে। নির্বাচনে আওয়ামীলীগকে জেতাতে নির্বাচন কমিশন সচিবসহ জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কতিপয় কর্মকতার গোপণ বৈঠকের অভিযোগ করেছে বিএনপি। গত ২০ নভেম্বর মঙ্গলবার রাতে ঢাকার অফিসার্স ক্লাবের চারতলার একটি কনফারেন্স রুমে প্রায় আড়াই ঘন্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের নাম-ধাম সহ জানিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমদ। গত শনিবার রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেনে ‘সেন্টার ফর গর্ভনেন্স স্টাডিজ’ আয়োজিত এক সেমিনারে দেশবরেণ্য আইনজ্ঞ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা এ মর্মে মত প্রকাশ করেছেন যে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ফেয়ার না হলে দেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। তবে ক্ষমতাসীন সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মতৎপরতা থেকে প্রতিয়মান হচ্ছে, তারা ফেয়ার ইলেকশনের চেয়ে যে কোন প্রকারে ক্ষমতাসীনদের বিজয় নিশ্চিত করতেই বেশী তৎপর রয়েছেন।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নির্বাচন

২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন