Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সার্থকতা এবং সামনের সাধারণ নির্বাচন

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ১৫ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

অবশেষে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়। নির্বাচনে দেশের প্রধান দুই দলের অংশগ্রহণ সম্বন্ধেও নিশ্চিত হওয়া গেছে। দশম সংসদের নির্বাচন দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি বয়কট করায় সে নির্বাচনের গুরুত্বই অনেকটা হারিয়ে গিয়েছিল। দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি কর্তৃক বর্জিত হওয়ার কারণ ছিল নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপির সমঝোতায় লংঘন করে আওয়ামী সরকারের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা।
সংবাদপত্র পাঠক মহলের স্মরণ থাকার কথা, দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের একটি (বিএনপি) কর্তৃক ৫ জানুয়ারীর সে নির্বাচন বর্জিত হওয়ায় সে নির্বাচন তার সকল গুরুত্ব-হারিয়ে ফেলে। জনগণও সে নির্বাচন সম্পর্কে তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বিরোধী দলের নেতা কর্মীরা তো দূরের কথা, শাসক দলের নেতা কর্মীরাও অনেকেও ভোট দেয়ার উদ্দেশ্যে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার গরজ অনুভব করেননি। কারণ তারা জানতে বিএনপির মত দেশের একটি বড় দল নির্বাচন বয়কট করায় যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তাতে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে তাদের ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। তারা সেই কৌশল অবলম্বনের দিকে মনযোগী ছিলো। সে কৌশল ছিল বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে শাসক দলের নির্দিষ্ট সংখ্যক নেতা কর্মীদের দিয়ে শাসক দলের প্রার্থীদের ব্যালটপত্রে স্বাধীনভাবে সীল মেরে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হওয়া নিশ্চিত করা।
ফলে ভোট দানের নির্ধারিত সময়ে অধিকাংশ ভোটকেন্দ্র প্রায় ফাঁকা জনশূণ্য থাকা সত্তে¡ও শাসক দলের প্রার্থীদের ‘বিপুল ভোটে’ নির্বাচিত হওয়া নিশ্চিত করা হলো। তবে পরদিন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ভোট দানের জন্য নির্ধারিত সময়কালের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ায় জনগণের কাছে প্রকৃত সত্য প্রকাশ হয়ে পড়ল। এ জন্য জনগণ ৫ জানুয়ারীর এ নির্বাচনের নাম দেন ভোটারবিহীন নির্বাচন। বর্তমানে যে সরকার দেশ শাসন করছে সে সরকার এই ভোটারবিহীন নির্বাচনেরই ফসল। তবে লক্ষ্য রাখার ব্যাপার এই যে, এ সরকারের নেতৃবৃন্দ একটি ভোটারবিহীন নির্বাচনের ফসল হলেও এ নিয়ে তাদের কোন লজ্জা না অসম্মানবোধ নেই। সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে এই প্রসঙ্গে একদিন ভাষণ দানকালে বলেছেন, বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় এক হিসাবে ভালই হয়েছে। সংসদে তাদের আবোল তাবোল সমালোচনা শুনতে হচ্ছে না। অর্থাৎ সংসদে বিরোধী দলের সদস্যদের বক্তব্যকে তারা আবোল তাবোল বক্তৃতার চাইতে উৎকৃষ্ট কিছু ভাবেন না। এটা কিন্তু তাঁর গণতন্ত্র-প্রীতির প্রমাণ বহন করে না। কারণ গণতন্ত্রে বিরোধী দলীয় সদস্যদের বক্তব্যকেও যথাযথ মূল্যায়ণ করতে হয়।
গণতন্ত্রে বিরোধী দলের বক্তব্যের গুরুত্ব দিতে হয় এই জন্য যে মানুষ সাধারণত: নিজের ভুল নিজে বুঝতে বা ধরতে পারে না। যে সমাজে গণতন্ত্রের গুরুত্ব থাকে না, সে সমাজের লোকেরা তাদের মধ্যকার ভুল ধারণার বিপরীতে সঠিক ধারণা জানার সুযোগ না পাওয়ায় সারা জীবন ভুলের মধ্যেই বসবাস করতে বাধ্য হয়। পক্ষান্তরে যে সমাজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মূল্যায়নের সুযোগ থাকে সে সমাজে মানুষেরা তার নিজেদের ভুল ধারণার বিপরীতে সঠিক ধারণার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাওয়ায় নিজেদের ভুল ধারণার সংশোধন করে নিজেদেরকে সঠিক ধারণার বশবর্তী উন্নত করে তুলতে পারে। এখানেই গণতন্ত্রের গুরুত্ব। বাংলাদেশ যে আজও অনেকটা অনুন্নত রয়েছে, তার অন্যতম কারণ আমাদের দেশে এখনো পর্যাপ্ত গণতন্ত্র চর্চার অভাব রয়েছে। এর কুপ্রভাব পড়েছে আমাদের দেশের সমাজে ও রাজনীতিতে। বিগত দশম সংসদের নির্বাচন যে সঠিক হতে পারেনি তারও অন্যতম কারণ আমাদের দেশে গণতন্ত্র চর্চা এখনও সঠিকভাবে জোরদার হয়ে উঠতে পারেনি।
এই ঐতিহাসিক পটভূমিতেই আমাদের আসছে একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন। আমাদের দেশে যে গণতন্ত্র একটি আদর্শ হিসাবে যথেষ্ট জোরদার হয়ে উঠতে পারেনি এ সত্যকে স্বীকার করে নিয়েই এ সমস্যার কারণ খুজে দেখতে হবে এবং সমস্যা থেকে সঠিকভাবে মুক্তি পাওয়ার আন্তরিক চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এ সমস্যার কারণ খুঁজতে গেলে আমরা দেখতে পাব পাকিস্তান আমলে দেশ পরিচালনায় সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের অতিরিক্ত প্রভাব থাকায় আমরা গণতন্ত্রের পথে যথেষ্ট অগ্রসর হতে পারেনি। এ কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে গণতন্ত্রকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য যে চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নির্ধারিত হয়েছে তার মধ্যে সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে গণতন্ত্র। আমাদের জনগণের দৃষ্টিতেও গণতন্ত্র সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি। এ কারণে অন্যান্য তিনটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ শাসক ভেদে মাঝে মাঝে সংশোধন ও পরিবর্তন করা হলেও কোন সরকারই গণতন্ত্রের গায়ে আঁচড় কাটতে সাহস করেন নাই। তবে দু:খের বিষয়, কাগজে-কলমে আমরা গণতন্ত্রকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিলেও বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা গণতন্ত্রকে খুব কমই গুরুত্ব দিয়ে থাকি। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমলেই গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরে আমরা দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি মাত্র সরকারী দল রেখে দেশে একদলীয় বাকশালী শাসন কায়েম করি। এরপর কিছু দু:খজনক ঘটনার মধ্যদিয়ে দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুন:প্রতিষ্ঠিত হলেও পরবর্তীকালে একটি নির্বাচিত সরকারকে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে বসেন তদানীন্তন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। তখন সারা দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে ঐ সামরিক ক্যুর প্রতি সমর্থন জানিয়ে বসেন দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা
এই অকল্পনীয় ব্যাপার সম্ভবপর হয়েছিল সম্ভবত এই বিবেচনায় যে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে ঐ উৎখাত হওয়া নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। বলা বাহুল্য, এটা আওয়ামী লীগের গণতন্ত্র-প্রীতির প্রমাণ বহন করে না।
এই প্রেক্ষাপটে দেশে পুনরায় সাধারণ নির্বাচন আসছে আগামী ৩০ ডিসেম্বর। এই নির্বাচনের ওপর নির্ভর করবে দেশের ভবিষ্যৎ-দেশ গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হবে না ক্ষমতালোভী সুবিধাবাদীদের ক্ষমতা-ক্ষুধার কবলে হারিয়ে যাবে বাংলাদেশের লক্ষ কোটি মানুষের গণতন্ত্রের আকাঙ্খা।
বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রকে কতটা গভীরভাবে ভালবাসে গণতন্ত্রকে তার প্রমাণ তারা দিয়েছে ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে যে নির্বাচনের ফলাফলের আলোকে তারা ১৯৪৭ সালে তারা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের গোলামীর শৃংখল থেকে মুক্তি পায় স্বাধীন পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে। এরপর ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে তারা জনবিচ্ছিন্ন মুসলিম লীগ সরকারের হাত থেকে মুক্তি পায় যুক্তফ্রণ্টের বিজয়ের মাধ্যমে। যুক্তফ্রণ্টের বিজয়ের মাধ্যম তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্ত¡শাসন আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে জনগণের মধ্যে। এই স্বায়ত্ত¡শাসন আন্দোলন ক্রমে ক্রমে স্বাধিকার আন্দোলনে পরিণত হয় এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে যে স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি ভূমি হিসাবে স্বাধিকার দাবীর পক্ষে একচেটিয়া রায় প্রদান করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পশু বলে বাংলার মানুষের যে স্বাধিকার চেতনা ধ্বংস করে দিতে উদ্যত হলো আমাদের জনগণ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে ৯ মাসের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েম করে বসে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে।
আজ বাংলাদেশ কাগজে-কলমে স্বাধীন হলেও বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে সার্থক এ কথা দাবী করা যায় না। বাংলাদেশকে প্রকৃত স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে সার্থক করে তুলতে আমাদের আরও অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
সামনের ৩০ ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচন আমাদের শিখিয়ে দিক সে সার্থক স্বাধীন রাষ্ট্রের সঠিক পথের দিশা। আমাদের মনে রাখতে হবে শুধু নামে স্বাধীন দেশ হলেই চলবে না, বাস্তবেও হতে হবে স্বাধীন। আর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে সার্থক হতে হলে অবশ্যই গণতন্ত্রকে মনে প্রাণে স্বাধীনতার আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। এবং বাস্তবে তা আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে তা প্রতিষ্ঠিত করে বুঝিয়ে দিতে হবে, আমরা শুধু কাগজে কলমেই নয়, বাস্তবেও আমরা স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নির্বাচন

২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন