পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
পরিবেশের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো মাটি, পানি ও বায়ু। বর্তমানে মানুষের কার্যকলাপের কারণে এই তিনটি উপাদান প্রতিনিয়তই দূষিত হচ্ছে। যে হারে দূষণের পরিমাণ দিনে দিনে বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে মানুষ সুপরিবেশের মধ্যে নয় দূষণ কবলিত পরিবেশের মধ্যে বেঁচে থাকবে। দূষণের চিত্র এতটাই ভয়াবহ যে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ দূষণজনিত কারণে আহত বা নিহত হচ্ছে। এই দূষণ জনজীবনকে ক্ষতিগস্ত করছে, প্রচুর জীবন ও জানমাল ধ্বংস করছে। দূষণের মধ্যে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, প্লাস্টিকদূষণ, পানিদূষণ, মাটিদূষণ, নদীদূষণ ও বর্জ্য অব্যবস্থাপনার প্রভাব মানুষের উপর সবচেয়ে বেশি।
বায়ুদূষণ: বর্তমানে দূষণগুলোর মধ্যে বায়ুদূষণের ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি-এনভায়রনমেন্টাল অ্যানালাইসিস (সিইএ) ২০১৮ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বায়ুদূষণজনিত মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৪৬ হাজার। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ৫৮% বায়ুদূষণের উৎস ঢাকার আশেপাশে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ইটের ভাটা। জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস) পোড়ানোর ফলে, শিল্পকারখানা, দহন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, ঘনঘন রাস্তা খনন, ড্রেনের ময়লা রাস্তায় পাশে উঠিয়ে রাখা, যানবাহনের অসম্পূর্ণ থেকে নির্গত বিভিন্ন ধরনের প্যার্টিকুলেট ম্যাটার (চগ২.৫ ও চগ১০), অ্যাশ, ধূলিকণা, সীসা, কার্বন, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইডসমূহ এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রতিনিয়তই দূষিত করছে বায়ু। বায়ুদূষণের ক্ষণস্থায়ী সমস্যাগুলোর মধ্যে নাক মুখ জ্বালাপোড়া করা, মাথা ঝিম ঝিম করা, মাথা ব্যাথা, বমি বমি ভাব ইত্যাদি অন্যতম। ফুসফুসের ক্যান্সার, হাঁপানি, ব্রংকাইটিস, যক্ষা, কিডনির রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, জন্মগত ত্রুটি, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব, হার্ট অ্যাটাক, যকৃত সমস্যা, গর্ভবতী মায়েদের ওপর প্রভাব, চর্মরোগ ও নিউমোনিয়া ইত্যাদি দীর্ঘস্থায়ী রোগ হয়। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ-এর পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ ও ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ-এর যৌথ উদ্যোগে ঢাকার ১২টি স্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণা করে। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, ঢাকার বায়ুতে চগ২.৫ এর পরিমাণ আদর্শ মানমাত্রার চেয়ে অনেকাংশে বেশি। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ধানমন্ডি এলাকার সীসা দূষণের উপরও অন্য এক গবেষণায় ১০ স্থান থেকে নমুনায় সীসার উপস্থিতি পাওয়া যায়। ইটভাটা ও যানবাহনে ক্যাটালাইটিক কনভাটর ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখতে হবে, ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ধারা ৬ এর উপধারা (১)-এ বলা হয়েছে, ‘স্বাস্থ্য হানিকর বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ধোঁয়া বা গ্যাস নিঃসরণকারী যানবাহন চালানো যাইবে না বা ধোঁয়া বা গ্যাস নিঃসরণ বন্ধ করার লক্ষ্যে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোনভাবে উক্ত যানবাহন চালু করা যাইবে না।’
শব্দ দূষণ: যানবাহনের হাইড্রলিক হর্ন, সড়ক যানবাহন, রেল ও নৌযানের হর্ন, ভিআইপি/ইর্মাজেন্সি হর্ন, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহবনের/মেশিনের যান্ত্রিক শব্দ, যত্রতত্র মাইকের ব্যবহার, রাজনৈতিক সমাবেশ, ওপেন কনসার্ট, ভবন নির্মাণ, জেনারেটর, কারখানা থেকে নির্গত উচ্চ শব্দ দূষণের জন্য দায়ী। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ট্রান্সপোর্ট ও এনভায়রনমেন্ট এর গবেষণা অনুযায়ী, ২০০৮ সালে ৫ লক্ষ লোক রেল এবং সড়ক পরিবহন থেকে শব্দ দূষণের ফলে মারাত্মক হার্ট অ্যাটাক আক্রান্ত হয় এবং ২ লক্ষ লোক কার্ডিও-ভাস্কুলার রোগের শিকার হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-এর ক্ষমতাবলে শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। কঠিন কিছু নয় সচেতনতা, সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও আইনের প্রয়োগই পারে শব্দ দূষণ কমিয়ে আনতে।
প্লাস্টিক দূষণ: প্লাস্টিক দূষণ এখন কোনো নতুন বিষয় নয়। এক সময় প্লাস্টিক বলতে শুধু পলিথিন ব্যাগ, বোতল ইত্যাদিকে ধরা হতো, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে প্লাস্টিকের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর হলো মাইক্রোপ্লাস্টিক, যা বর্তমানে মাইক্রোবিডস নামে খুব পরিচিতি লাভ করেছে। ফেইসওয়াস, ডিটারজেন্ট, সাবান, বডিওয়াস, টুথপেস্ট ইত্যাদিতে প্রচুর মাইক্রোবিড পাওয়া যায়। প্লাস্টিক ও মাইক্রোবিডসের ফলে মানুষ থাইরয়েড, হরমোনের অতিরিক্ত ক্ষরণ, কিডনি রোগ, চর্মরোগ ইত্যাদি সমস্যাতে ভোগে। এছাড়া এর কারণে সামুদ্রিক প্রাণির (তিমি, পাখি) খাদ্য চক্রে প্লাস্টিকের উপস্থিতি ও ভক্ষণের ফলে মৃত্যু হয়। নদী নাব্যতা হারায়, ভূ-গর্ভস্থ পানি দূষিত হয়, মাটির উর্বরতা হ্রাস পায়। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ মাইক্রোবিডের উপর একটি গবেষণায় ৮ ধরনের ১০৪ টি প্রসাধনী সামগ্রীর মধ্যে ৫১ টিতে মাইক্রোবিডের উপস্থিতি পায়। গবেষণানুযায়ী, ফেইস ওয়াস এবং স্ক্র্যাবের মধ্যে মাইক্রোবিডের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে বেশি এবং সাবান, ডিটারজেন্ট ও টুথপেস্টে এর উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কম। প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করতে হলে প্রথমেই পলিথিন নিষিদ্ধকরণ আইন ২০০২ বাস্তবায়ন করে প্লাস্টিকের পরিবর্তে পাট, কাগজ, কাপড়ের তৈরি ব্যাগ (সোনালি ব্যাগ) ব্যবহারে জনগণকে উৎসাহী করতে হবে। মাইক্রোবিড যুক্ত পণ্য নিষিদ্ধ করতে হবে।
নদী দূষণ: নদী দূষণের মূল কারণ ৭০-৮০ ভাগ শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে নদী কেন্দ্র করে। এছাড়া কারখানা শুধুমাত্র দিনের বেলায় ইটিপি চালু রাখে, পৌর কর্তৃপক্ষ পরিশোধন ছাড়া পয়ঃপ্রণালীর বর্জ্য নদীতে ছেড়ে দেওয়ার ফলে নদী দূষিত হচ্ছে। ডকইয়ার্ডের বর্জ্য, নদী পথে চলাচলকারী জাহাজ, লঞ্চ, স্টিমার, ট্রলারের লিকেজের ফলে কয়লা ও তেল, আরোহী কর্তৃক কঠিন বর্জ্য ও পয়ঃপ্রণালীর, কৃষিকার্যক্রমের ফলে আগত রাসায়নিক এবং নদীর পাশে গড়ে ওঠা জনমানুষের অপরিকল্পিত স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও গৃহস্থলী বর্জ্য, নদী দখল করে গবাদি পশুর বাসস্থান নির্মাণ ইত্যাদি ও নদী দূষণের জন্য দায়ী। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ-এর পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে চলতি বছরের বর্ষা মৌসুমে ঢাকার আশপাশের ৫টি নদী (তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা, বালু) পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং ১৯টি স্থানের নমুনা পানি সংগ্রহ করে Temperature, PH, DO, TDS, EC I Salinity পরীক্ষা করা হয়। যদিও বর্ষাকালে এই পর্যবেক্ষণ করা হয় তথাপি ১৯টি স্থানের নমুনা পানির কয়েকটিতে আদর্শ মানমাত্রার সাথে অসামঞ্জস্য ছিল। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী শাস্তির বিধান রয়েছে। আইনের ৯ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যদি কোনো প্রতিষ্ঠান কোনো প্রকার দূষক নদীতে ছেড়ে দেয় তাহলে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। নদী দূষণ থেকে পরিত্রাণের জন্য নদী ও নদী পাড় হতে অবৈধ দখল উচ্ছেদ, শিল্প বর্জ্য পরিশোধনের জন্য ইটিপি/সিইটিপি এবং সিউয়েজ বর্জ্যরে জন্য এসটিপি ব্যবহার করতে হবে।
অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: যে কোনো এলাকার হোটেল ও রেস্টুরেন্ট এর আবর্জনা, শিল্প কারখানা হতে উৎপাদিত আবর্জনা, মেডিকেল বর্জ্য, রান্নাঘরের পরিত্যক্ত আবর্জনা, হাটবাজারের পচনশীল শাকসবজি, কসাইখানার রক্ত, ছাপাখানার রঙ ইত্যাদি বর্জ্যের অন্যতম উৎস। বর্জ্যরে মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মেডিকেল বর্জ্য। যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা উন্মুক্তভাবে ফেলে রাখায় বাতাস ও মাটি দূষিত হচ্ছে, অপরিকল্পিতভাবে বর্জ্য স্তূপীকরণের ফলে আশেপাশে দুর্গন্ধের পাশাপাশি দেখা যায় মশা, মাছি ও পোকামাকড়ের মাত্রাতিরিক্ত উপদ্রব। বর্ষা মৌসুমে বর্জ্যগুলোর অবস্থা হয় আরো ভয়াবহ। বর্ষা মৌসুমে সময় মত বর্জ্য অপসারন না করায় বর্জ্যসমূহে দ্রুত পচনপ্রক্রিয়া শুরু হয়, পঁচা বর্জ্য থেকে তরল, কালো রঙের দুর্গন্ধযুক্ত লিচেট (রস) তৈরি হয়। এই লিচেট বৃষ্টির পানির সঙ্গে নদীনালাতে এবং মাটির বুনটের ফাঁকা স্থানের মধ্য দিয়ে গ্রাউন্ড ওয়াটারে গিয়ে মিশে গিয়ে ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত করছে। ফলে বাড়ছে পানিবাহিত রোগ ও বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকি। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ-এর পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এক জরিপে দেখা যায় যে, শুধুমাত্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে প্রতিদিন ১ দশমিক ৮০ টন থেকে ২ টন মেডিকেল বর্জ্য উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে ৬৫ ভাগ বিপজ্জনক বর্জ্য। এসব বর্জ্য নাড়াচাড়ায় যারা জড়িত তাদের প্রায় সবাই কোনো ধরনের নিরাপত্তা উপকরণ যেমন: গ্লাভস, গামবুট, মাস্ক ইত্যাদি ব্যবহার ছাড়াই কাজ করে, যা কর্মীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির জন্য দায়ী। শুধু সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে হবে না, সচেতন হতে হবে নাগরিককে।
দূষণগুলো আমাদের জীবনের সাথে এমনভাবে জড়িত আছে যে, আমরা দূষণ নিয়ে এখন আর মাথা ঘামাতে রাজি নই। প্রতিদিনই কোনো না কোনো দূষণ নিয়ে খবরের কাগজে ছাপা হয়। কিন্তু তাও আমরা সচেতন নই। আমাদের উচিৎ নিজেদেরকে ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দূষণ কমিয়ে আনা। দূষণ রোধে কিছু সাধারণ অভ্যাস গড়ে তোলা।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।