Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৫ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গণতন্ত্রের ভূমিকা

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ৮ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

একাদশ জাতীয় সংসদ প্রশ্নে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। তবে সব বিষয়ে যে সব দল এক হয়েছে তা নয়। হলে ভাল হত। নির্বাচনে সকল দল এক পর্যায়ে থাকতে পারলে নির্বাচন অধিকতর অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হত। কিন্তু তা হয়নি। আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন প্রশ্নে শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রশ্নে অনড়।
জাতীয় নির্বাচনে সকল দলের সমান অবস্থান নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু আমাদের দেশে এটা এখন অসম্ভব। কারণ বাংলাদেশের সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনী মোতাবেক সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনে। এর আগে এক সময় নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হত।
পাকিস্তান আমলে শাসনকার্য পরিচালনায় সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের অতিরিক্ত প্রভাব থাকায় সে আমলে গণতন্ত্র কখনও স্থিতিশীলতা লাভ করতে পারেনি। একারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে গণতন্ত্রকে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু দু:খের বিষয়, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমলেই গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি মাত্র সরকারী দল রেখে দেশে একদলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়।
পরে কিছু দু:খজনক ঘটনার মধ্যদিয়ে দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুন:প্রবর্তিত হলেও এক পর্যায়ে একটি নির্বাচিত সরকারকে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত করে রাষ্টীয় ক্ষমতা দখল করে বসেন তদানীন্তন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। তখন সারা দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে ঐ ক্যুর প্রতি সমর্থন জানিয়ে বসেন দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা। এই অকল্পনীয় ঘটনা বাস্তবে সম্ভবপর হয় সম্ভবত এই বিবেচনায় যে, সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত হওয়া রাজনৈতিক দলটি ছিল নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধানতম প্রতিপক্ষ বিএনপি
সংবাদপত্রের পাঠকমহলের স্মরণ থাকার কথা, এরপর শুরু হয় জেনারেল এরশাদের দীর্ঘ একটানা স্বৈরশাসনের পালা। পাশাপাশি চলতে থাকে বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের এরশাদ বিরোধী আন্দোলন। আওয়ামী লীগ প্রথম দিকে অনেক দিন এসব আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকলেও পরে এক পর্যায়ে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়। কিন্তু ততদিনে বিএনপি চেয়ারপার্সন রাজনীতিতে তুলনামূলকভাবে নবাগতা বেগম খালেদা জিয়া স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনে একটানা নেতৃত্ব দিয়ে আপোষহীন নেত্রী হিসাবে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন, যার প্রমাণ মেলে পরবর্তী নির্বাচনে। এদিকে আরও পরে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুন:প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নে একমত হয় দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। নির্বাচন যাতে অবাধ ও নিরপেক্ষ হয় সে জন্য এ প্রশ্নেও তারা একমত হয় যে, এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সুপ্রীম কোর্টের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।
যেমনটা আশা করা গিয়েছিল, নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়। নির্বাচন চলাকালে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতাকালে এক পর্যায়ে বলেন, আমি সকল জেলার খবর নিয়েছি। নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু হয়েছে। আপনারা লক্ষ্য রাখবেন, ভোটে হেরে গিয়ে এর মধ্যে কেউ যেন আবার কারচুপি আবিষ্কার না করে।
ভোট গণনা শেষ হলে যখন জানা গেল, আওয়ামী লীগ নয়, নির্বাচনে জয়ী হয়েছে বিএনপি, শেখ হাসিনা অবলীলাক্রমে বলে ফেললেন, নির্বাচনে সু² কারচুপি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কেউ তাঁর এ অবাস্তব স্ববিরোধী মন্তব্যে গুরুত্ব না দেয়ায় সাধারণ নিয়ম মোতাবেক বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হল। শেখ হাসিনা হলেন জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী। বেগম খালেদা জিয়ার প্রধান মন্ত্রীত্বের মেয়াদ শেষে নতুন নির্বাচনের প্রশ্ন উঠলে প্রধানত শেখ হাসিনার দাবীর মুখেই দেশের সকল জাতীয় নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের বিধান রেখে সংবিধান সংশোধনীর প্রস্তাব গৃহীত হয়।
বাংলাদেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই ব্যবস্থা গণতন্ত্রের জন্য সব চাইতে উপযোগী প্রমাণিত হয়। এই ব্যবস্থা অনুযায়ী দেশে বেশ কয়েকটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল পর পর পালাক্রমে জয়ী হয়ে দেশ পরিচালনার সুযোগ লাভ করে। তবে কিছু রাজনীতিকের অতিরিক্ত ক্ষমতা-ক্ষুধা এই সুন্দর ব্যবস্থাটিকেও এক পর্যায়ে পচিয়ে ফেলে। এক পর্যায়ে শেখ হাসিনার প্রধান মন্ত্রীত্বের আমলে সংবিধান পুনরায় সংশোধন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবর্তে দলীয় নির্বাচিত সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা ঘোষিত হয়। এই পরিবর্তন দুই প্রধান দলের মধ্যেকার অতীত সমঝোতার লংঘন অভিযোগ এনে বিএনপি সে নির্বাচন বয়কট করে।
দেশের দুই প্রধান দলের একটি (বিএনপি) নির্বাচন বয়কট করায় সে নির্বাচন অনেকটাই গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। দেশের মানুষও নির্বাচনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আমাদের দেশের মানুষ যেখানে সাধারণত ভোটের দিনে সকল কাজ ফেলে প্রথমে ভোটের লাইনে দাঁড়াতে অভ্যস্ত, সেখানে ভোটের নির্ধারিত সময়েও অধিকাংশ ভোট কেন্দ্র ছিল ফাঁকা, প্রায় জনশূণ্য। বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা তো দূরের কথা, শাসক দলের নেতাকর্মীরাও অনেকে ভোট দিতে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার গরজ অনুভব করেননি। কারণ তারা জানতেন তারা ভোট কেন্দ্রে না গেলেও তাদের ভোট দানের ব্যবস্থা ঠিকই করা হবে দলের পক্ষ থেকে।
বাস্তবে হয়ও সেটাই। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অনুপস্থিতির সুযোগে শাসক দলের অল্পসংখ্যক নেতাকর্মীই শাসকদলের প্রার্থীদের ব্যালটপত্রে ইচ্ছামত সীল মেরে তাদের অকল্পনীয় বিশাল ভোটে ‘বিজয়ী’ হওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন। তবে পরদিন সকল পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে জনগণের কাছে প্রকৃত তথ্য স্পষ্ট হয়ে পড়ে। এ কারণে জনগণ এ নির্বাচনের নাম দেয় ভোটারবিহীন নির্বাচন। বর্তমানে যে সরকার দেশ চালাচ্ছে সে সরকার এই ভোটারবিহীন নির্বাচনেরই ফসল। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ভোটারবিহীন এই নির্বাচনে বিজয়ী হয়েও এ সরকারের নেতাদের মনে এতটুক লজ্জা বা অসম্মানবোধ নেই। প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে ভাষণ দিতে গিয়ে এক পর্যায়ে বলেছেন, বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় এক হিসাবে ভালই হয়েছে। সংসদে তাদের আবোল তাবোল সমালোচনা শুনতে হচ্ছে না। বিরোধী দলের জনপ্রতিনিধিদের বক্তব্যকে যারা আবোল তাবোল সমালোচনা মনে করেন তারা যে গণতন্ত্রকে কোন গুরুত্ব দেন না, সে কথা বলা বাহুল্য।
যা হোক এও তো গেল যেসব আসনে ত্রুটিপূর্ণ হলেও ভোটের একটা মহড়া হয় সে সবের কথা। জাতীয় সংসদের মোট ৩০০ আসনের অধিকাংশ (১৫৩) আসনে তো ভোটের এ মহড়াও হয়নি। সেসব আসনে সরকারী দলের প্রার্থী ছাড়া কোনো প্রার্থী না থাকায় তারা বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হয়ে দেশের নির্বাচনের ইতিহাসে এক কলংকজনক অধ্যায় রচনা করেন।
এই যেখানে ছিল দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের আসল ঘটনা, যেখানে একাদশ সংসদের নির্বাচনের অবস্থা কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্নে ওঠা স্বাভাবিক। এ ব্যাপারে বিরোধী দলের চাইতে শাসকদলের দায়িত্ব যে অধিক তা বলাই বাহুল্য। সামনের একাদশ সংসদ নির্বাচন যাতে অবাধ নিরপেক্ষ হয় সে লক্ষ্যে এখন থেকেই সরকারী দলকে সচেতন ও সক্রিয় হতে হবে। নির্বাচনের নামে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মহড়া যে শাসক দলের জন্য চরম লজ্জার ব্যাপার হয়েছে এটা শাসক দলের সময় চলে যাওয়ার আগেই বুঝতে হবে। এবং এই লজ্জাজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি থেকে মুক্ত থাকার প্রচেষ্টায় অবিলম্বে কর্মক্ষেত্রে ঝাপিয়ে পড়তে হবে। নইলে শাসকদলের এবং দেশের যে দুর্নাম হবে তা সহজে দূর হবার নয়।
বাংলাদেশের যে চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি রয়েছে তার মধ্যে সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে গণতন্ত্র। অন্যান্য তিনটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা শাসকদলভেদে একাধিক বার পরিবর্তন করা হলেও গণতন্ত্রের গায়ে আঁচড় কাটতে কোনো সরকারেরই সাহস হয়নি। জনগণের কাছে এতো গুরুত্ব রয়েছে যে রাষ্ট্রী মূলনীতিটির, বাস্তবে যদি তাকে অবহেলা করা হয় তা হবে চরম লজ্জা ও দু:খজনক ব্যাপার। এটা যেন আমরা কখনও না ভুলি।
শুধু আমাদের চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতির মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হিসাবে নয়, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ও গৌরবজনক দিক হিসাবে রয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের গোলামী থেকে আমরা প্রথম যে স্বাধীনতা লাভ করি ১৯৪৭ সালে, তার মূলে একটি নির্বাচন পালন করে ঐতিহাসিক ভূমিকা। ১৯৪৬ সালের সে নির্বাচনের ফলেই আমরা গণতান্ত্রিক পথে আমরা বৃটিশ শাসন থেকে মুক্তি লাভ করি। এরপর পর শুরু হয় ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন। এই ভাষা আন্দোলনের সৃষ্ট আবহেই আমরা জনবিচ্ছিন্ন মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করি ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রণ্টের সে বিজয় গণতন্ত্রের পথে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের পৃথক স্বতন্ত্র সত্ত্বাকে সামনে নিয়ে আসে। ফলে বাংলাদেশে স্বায়ত্ত্বশাসন আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠতে থাকে এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন তা স্বাধিকার চেতনার রূপ পরিগ্রহ করে।
অত:পর আসে ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচন যা আমাদের স্বাধিকার চেতনাকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে এদেশের জনগণের সে অপ্রতিরোধ স্বাধিকার চেতনাকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পশু বলে ধ্বংস করে দিতে চেষ্টা করা করলে সমগ্র জাতি বিদ্রোহ ঘোষণা করে মাত্র নয় মাসের সংগ্রামের মাধ্যমে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে এদেশকে স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত করে। আজ আমরা বাংলাদেশ নামক সে স্বাধীন রাষ্ট্রের গর্বিত নাগরিক। আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তিভূমি নির্মাণের পেছনে যেমন ছিল পলাশী পরবর্তী প্রায় একশ বছরের সশস্ত্র সংগ্রাম এবং একাত্তরের নয় মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রাম, তেমনি ছিল এর মধ্যকার দিনগুলিতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ঐতিহাসিক ভূমিকা। তাই আমাদের ২১৪ বছরের সুদীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে যেমন অস্বীকার করা যায়, সশস্ত্র সংগ্রামের গুরুত্ব তেমনি অস্বীকার করা যায় না গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্ভাসিত আমাদের সংগ্রামের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গণতন্ত্র

২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন