Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উন্নত প্রযুক্তি ও পুলিশ

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৯ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

সময়ের সঙ্গে পা ফেলে এগিয়ে চলার নাম আধুনিকতা। বলা হচ্ছে একবার নয় বার বার, পুলিশের আধুনিকীকরণ হবে। কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। এই সংস্কার সকলেই চাইছিলেন। দেশ, সমাজ, মানসিকতা পরিবেশ বদলালেও পুলিশ নাকি সেই ইংরেজ আমলের মতই চলছে। কিছু বহুচর্চিত বিষয় ঝালিয়ে নেওয়া যাক। সিপাহিবিদ্রোহের পর ১৮৬১ সালে আধুনিক পুলিশ আইনের সূচনা। মহারানির প্রশাসনের উদ্দেশ্য ছিল, শাসকের ইচ্ছা মোতাবেক জনতাকে নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধ দমন, জনতাকে পরিষেবা দান নয়। মূল উদ্দেশ্য দুটো এক আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা ও দ্বিতীয়ত, অপরাধ দমন। কীভাবে? ফৌজদারি কার্যবিধি ও সেই আইনের রুল হলো পুলিশ রেগুলেশন দিয়ে। সাজা হবে দন্ডবিধিতে এবং সাবুদ গ্রহণযোগ্য হবে সাক্ষ্য আইনে। মূল উদ্দেশ্য কাগজে-কলমে যাই থাক, পুলিশ হয়ে উঠে শাসকের হাতে প্রবাদের সেই জ্যাক, যাকে জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সব করতে হয়। প্রবাদের মতো জ্যাকের পরিণতিও এক। কোনো কাজেই সে সন্তুষ্টি দিতে পারে না।
এই ২০১৮ সালে এসে প্রযুক্তির খপ্পরে পড়ে যখন পুরো দুনিয়ার জীবনযাত্রার খোলনলচে বদলে যাচ্ছে, তখন সেই ভিক্টোরিয়ার আমলের রাইফেলের মতো এই পুলিশও অচল। অচল সেই আইন ও ধীরগতির তদন্তের প্রক্রিয়া। সমস্যা হচ্ছে, আমজনতা কোন রূপে পুলিশকে দেখতে চাইছে, এ নিয়ে কখনও রাষ্ট্র মত চায় না। শাসক যে রূপ দেবে সেটাই মেনে নিতে হবে। জনতার চাহিদা মতো পুলিশ কেন হবে না এই প্রশ্ন কেউ তোলে না।
অভিযোগের তালিকায় উপরের দিকে, অভদ্র ব্যবহার ও ঘুষ নেওয়ার প্রবণতা। দুটোই মানবিক দোষ। ছোট করে বললে, মানবিক বোধ ও সংবেদনশীল গুণসম্পন্ন মেধার বিনিয়োগ জরুরি। পুলিশের কাজটা আর পাঁচটা পেশা থেকে আলাদা, এই কাজে কেরানির সমতুল্য পরীক্ষার বাইরে প্রশাসকের মানসিকতা যাচাই আবশ্যক। সে সব বাছতে বসলে তবেই প্রকৃত পুলিশ পাওয়া যাবে। না হলে বেকার দূরীকরণ কর্মসূচির শিক্ষকের বা ঠগের মানসিকতা নিয়ে পুলিশ আসবে।
ছাত্রমহলে পুলিশ খুব একটা আকর্ষণীয় পেশা নয়। কোলে বসা অবস্থায় পুলিশকে জুজু হিসাবে দেখানোর রেওয়াজ। স্বাভাবিক দুষ্টুমি করলেও পুলিশ দেখিয়ে ধমক, ধরিয়ে দেব। অন্য কারণ, এত সময় ও দায়িত্ব নিয়ে সামান্য বেতন কেন নেব? অতএব, পেশার তালিকায় কালো দাগ। চব্বিশ ঘণ্টা বিরামহীন কাজ কোন মানুষের পক্ষে দক্ষতার সঙ্গে করা সম্ভব? মজার কথা, জনতার মতো নিম্ন স্তরের পুলিশকর্মীরাও দপ্তরের উপর অসন্তুষ্ট। তাদের সঙ্গেও ভালো ব্যবহার খুব কম জনেই করে। সকলে কাজ চায়। না পেলে শাস্তি। শাস্তির খাঁড়া ঝুলিয়ে কাজ আদায় আর যাই হোক আধুনিক ম্যানেজমেন্ট নয়। অন্য কোনো সংগঠনে এমন অতৃপ্তির কাহিনী অজানা। এমন অসন্তুষ্টির কারণ কী? সেটা বললে নাকি বিশৃঙ্খল বলে দেগে দেবে। একমুখী সংযোগ নিচু তলাকে পাত্তা দেওয়ার রেওয়াজ নেই।
তিনি যা বলবেন সেটাই নাকি আইন। আইন যদি ভিন্ন কথা বলে? ঘাড়ে ক’টা মাথা যে প্রশ্ন তুলবেন? সাহেবের মর্জি মতো চলে বিপাকে পড়লে দায় আপনার, কান পাতলে এমন হাজারো কথা শোনা যায়। একজন তো বলেই দিল, সাহেবদের জীবনযাত্রার মান আর বাহিনীর আস্তানা ঘুরলেই টের পাবেন। বাহিনীর বহুজনের নাকি হাড়-ভাঙা খাটুনির পর ভাঙা খাটে বিশ্রামের আয়োজন। ফ্যান চাহিদার তালিকায়। ছাদ দিয়ে পানি পড়ে। খাওয়ার উপযুক্ত পেয় পানির অভাব। ছুটির আকাল। অবসরের দিনেও নাকি রাত জাগতে হয়। শুধু প্রযুক্তি ও পরিকাঠামো পুলিশকে এক ধাক্কায় আধুনিক করে দেবে। পুলিশ যেহেতু রাষ্ট্রীয় পরিষেবার তৃণমূল স্তরের অত্যাবশ্যক পরিষেবা, তার মানবিক মুখ আবশ্যক। জনসংযোগের প্রশিক্ষণসহ নারীবাহিনীকে জনসংযোগের দায়িত্ব দিলে অভিযোগ কমতে বাধ্য। প্রযুক্তির সাহায্যে অনলাইনে অভিযোগ নিলে ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ হ্রাস পাবে। এরপর পুলিশের দ্রুত পদক্ষেপ। বেশ জটিল সমস্যা। লোকবল কম, কাজ বেশি। সমাধান জনসংখ্যার অনুপাতে পুলিশ নিয়োগ। বাকি খামতি প্রযুক্তির হাত ধরে ছেকে ফেলা। যেমন, প্রতি মোড়ে পুলিশ দেওয়া সম্ভব নয়। সিসিটিভি দিয়ে গুরুত্বমতো মুড়ে দেওয়া। তাতে সমস্যা মিটবে না, যদি ছবি দেখে পুলিশ না যায়, তা হলে সেই সব ছবি দেখে বিশ্লেষণ ও দ্রুত পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিলাতে সংসদ হামলায় আট মিনিট লেগেছিল পুলিশের অকুস্থলে হাজির হতে। সেটা নিয়ে বিতর্ক বেঁধেছিল। ইসরাইল সেটা রপ্ত করেছে। ঘন বসতি, যানজট? মোটর বাইক বা সাইকেলে চলো। ঘটনাস্থলে যেতে কম সময় লাগছে এটা আধুনিক পুলিশের শর্ত। হাজির হলেই হলো না, জরুরি সত্বর সমাধান চাই। সেই জন্য এসেছে পুলিশের শরীরে ক্যামেরা। ছবি নিয়ন্ত্রণ কক্ষে পৌঁছলে অভিজ্ঞ ও দক্ষ বিশেষজ্ঞরা তৎক্ষণাৎ পর্যালোচনা করে জানিয়ে দেবে কী করতে হবে। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও সন্ত্রাসবাদের গবেষকদের দরকার। এইসব ধারণা এ দেশে অজানা। পুলিশ ডাকা হলো। এবার সব দায়িত্ব সেই দারোগাসাহেব বা সিপাইজির। তিনি না পারলে অপদার্থতার জন্য সাময়িক বরখাস্ত। ব্যর্থতার কারণ খুঁজে দেখে না কেউ। পুলিশের কাজে গবেষণা ও চর্চার অভাব বড়ো প্রকট।
আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে সেই সমস্যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। ছাত্র আন্দোলন নিয়ে দেখুন, সারা দেশে পুলিশ কেমন বেহাল হয়েছিল। রাজনীতি হবে ধরে নিয়েই পুলিশকে পদক্ষেপ নিতে হবে। সেটা পরিস্থিতি ও বিষয় নির্ভর। নিছক গাড়িদুর্ঘটনা ও বিক্ষোভের ধরন এক হতে পারে না। পুলিশের প্রতিষেধক ভিন্ন হবে, জঙ্গি দমনেও তাই।
রাশিয়াকে দেখুন, শূন্য সংবেদনশীল। ধরো-মারো। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার খবর সংগ্রহে। মোবাইল, অ্যাপস, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক, ই-মেল, সিসিটিভি, বিভিন্ন পাড়ায় রয়েছে। এই বিপুল তথ্য বিশ্লেষণ জরুরি সফটওয়্যার, যা বেছেবুছে প্রয়োজনীয় তথ্যটুকু পুলিশের হাতে তুলে দেবে। এই সবের জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তি বহুজাতিকদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলে লক্ষ্যে পা ফেলতে সুবিধা হবে। মার্কিন দেশে পুলিশ এমন জোট বেঁধে সুফল পাচ্ছে।
অর্থনীতি এই সময়ে অপরাধের বড়ো ক্ষেত্র। ব্যাঙ্কসহ বিভিন্ন বড়ো শিল্পের সঙ্গে নিয়মিত তথ্য আদান-প্রদান বহু অপরাধকে থমকে দিতে পারে। বিভিন্ন রূপে পাওয়া তথ্য যেমন ফোন কল, সিসিটিভি, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক, এক জায়গায় আনা ও তার দ্রæত বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় তথ্য তুলে আনা এই সময়ের দাবি। না পারলে অপরাধীরা প্রযুক্তি ব্যবহারে পুলিশকে টেক্কা দেবে। শুধুমাত্র উন্নত প্রযুক্তি কিনলেই আধুনিক হয় না। দরকার সময়োপযোগী আধুনিক আইন। আধুনিক মানসিকতা ও মেধা না থাকলে গ্রামীণ হাসপাতালের আলট্রা-সোনোগ্রাফি মেশিনের মতো পড়ে থাকবে উন্নত যন্ত্র। সব খতিয়ে আধুনিকীকরণ হলে টাকাটা পানিতে যাবে না। নাহলে ইউরোপে যে প্রযুক্তি পুলিশের কাজে লাগে, এখানে তা বেকার। মজার কথা, আমাদের আমলারা তেমন প্রযুক্তি ভিন্ন দেশে দেখে এ দেশে তা কিনে আনেন। তারপর পড়ে থাকে। করের টাকার অপচয়। ভাঙা ব্যারাকে সিপাইজি তখন ভাগ্যকে অভিশাপ দেন।
পুলিশ হেরে যাক এটা বোধহয় অপরাধীরাও চায় না। কারণ পুলিশকে ফাঁকি দেওয়াতেই তাদের সন্তুষ্টি। আমজনতার সন্তুষ্টি পরিষেবায়। প্রযুক্তির ব্যবহার জরুরি অবশ্যই। কিন্তু আধুনিককীকরণের জন্য সমান প্রয়োজন আইন সংস্কার এবং মানবসম্পদের যথাযোগ্য ব্যবহার, তা বলা বাহুল্য।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পুলিশ


আরও
আরও পড়ুন